সনু নিগম ও আজান

অফিস যাবার পথে গলির সামনে ভীড় দেখে উঁকি দিলাম। দেখি টাকনুর উপর প্যান্ট তোলা আমাদের পাড়ার বড় ভাই বাসেত আলী গলার রগ ফুঁলিয়ে চেঁচামেচি করছে। বাসেত ভাই এক সময় বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’র সঙ্গে জড়িত ছিল। প্রফেসার আবদুল্লাহ আবু সাঈদের সঙ্গে তার কত ছবি দেখেছি। তার কাছ থেকেই গোর্কি-দস্তয়ভস্কির বই নিয়ে প্রথম পড়া। কালের বিবর্তণে তিনি এখন আমাদের পাড়ার তাবলিগ দলের ইমাম! বাসেত ভাইকে দেখেই আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে, সাহিত্য স্রেফ বিনোদন ছাড়া আর কিছু নয়। কিংবা মানুষকে অগ্রসর হবার মত সাহিত্য সাহিত্যিকরা লেখেন না বা সাহিত্যের কাজও সেটা নয়। যাই হোক, অফিস টাইম, বেশি দেরি করা যাবে না। কিন্তু না দাঁড়িয়েও পারছি না, দেখি আমাদের বন্ধু রামকৃষ্ণ বাসেত ভাইয়ের শ্রোতাদের একজন। বাসেত ভাই, হুংকার দিচ্ছেন, কুলাঙ্গার নাস্তিকদের দাঁত ভেঙ্গে দেয়া হবে। সাহস থাকলে প্রকাশ্যে এসে যেন কথা বলে। তখন দেখা যাবে কত বড় কইলজার নাস্তিক তুই…।

রামকৃষ্ণের পেটে খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, সাত সকালে জাকির নায়েক চ্যাতছে কেরে?

রামকৃষ্ণ আমাকে দেখে আজকাল আর খুশি হয় না। সে শুকনোভাবে বলল, আজান নিয়া কটুক্তি করছে জানস না?

-কে সনু নিগম?

-দুর! ঐটা তো ইন্ডিয়াতে। বাংলাদেশের নাস্তিকরাও আজান নিয়া ফেইসবুকে কি সব লিখছে দেখেছ নাই?

-করলে করছে তাতে তর কি?

-তুই তো এসব বলবিই। তোদের কারণেই তো এসব অশান্তি। কি দরকার তোদের এসব কটুক্তি করার? জানিস আজান শুনতে আমার কত ভাল লাগে! আমার বাবা আজান শোনার জন্যই মসজিদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন যাতে ভোরবেলা আজান শুনে বাবার ঘুম ভাঙ্গতে পারে!

-তারপর যখন মসজিদ কমিটি তাদের জায়গা জমি দখল করতে গেছিল তখন আমরা মানববন্ধন করেছিলাম নারে? আর যেখানে তোদের পারিবারিক দুর্গা পুজা হতো সেখান থেকে মসজিদটা ছিল বরাবর তাই তোদের মন্ডব পরের বছর ঘুরিয়ে নেয়া হয়েছিল বাড়ির পিছনে- ঠিক না?

রামকৃষ্ণ মুখ শক্ত করে হাঁটতে লাগল। রামকৃষ্ণের সদর মাকের্টে জামা-কাপড়ের পাইকারী দোকান। সে পর্যন্ত আমরা একসঙ্গেই যাবো। এতখানি পথ আমার সঙ্গে যেতে যেতে রামকৃষ্ণ আর একটাও কথা বলল না। আমি মনে মনে হাসলাম। রামকৃষ্ণ অনেক চেষ্টা করছে মানিয়ে নিতে। চাইছে সবাইকে খুশি করতে। এসব করতে গিয়ে সে নিজের কাছেই হয়ত ছোট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটুকু পরিস্কার করে বুঝতে না পেরে আমার মত নাস্তিক কারুর উপর রাগ বিরক্তি দেখিয়ে অবদমিত বাষ্পটা বের করে দিচ্ছে…।

ক্লাশ সিক্স থেকে একই ক্লাশে আমি আর রামকৃষ্ণ একই বেঞ্চিতে বসতাম। একসঙ্গে এসএসসি দিয়েছিলাম। ছোটবেলা থেকেই সাম্প্রদায়িক কটুক্তির মুখে তাকে মুসলিম প্রেমি ইসলাম প্রেমি হবার আপ্রাণ চেষ্টা দেখেছি। নিজেকে উদার ধর্মনিরপেক্ষ, কিছুটা হিন্দু সমালোচক হিসেবে প্রমাণ করেও পাড়ায় ‘মালাউনের বাচ্চা’ গালি থেকে রেহাই মেলেনি। রামকৃষ্ণ একবার ক্লাশে সবাইকে সুরা ফাতেয়া মুখস্ত শুনিয়ে চমকে দিতে চেয়েছিল। ইসলামের নবীর মহানুভবতার গল্পকে স্বীকার করে তার প্রশংসা করেছিল। তবু সে তার মা কালি আর দুর্গার গোপানাঙ্গ নিয়ে তার সহপাঠিদের আদিরসাত্মক রশিকতা থামাতে পারেনি। একেক সময় সে সহ্য করতে না পেরে আরক্ত মুখে শুধু এটুকুই বলতে পেরেছে, আমিও কিন্তু কইতে পারি, কমু… কমু… থাক, কইলাম না…।

না, রামকৃষ্ণ জীবনেও তার ধর্ম নিয়ে কটুক্তির পাল্টা কটুক্তি করতে পারেনি। আমার খুব ঘনিষ্ঠ বলে স্বীকার করত, আমরা হিন্দু মানুষ। আমরা কিছু কইলেই দোষ হইয়া যাইব…।

কথাটা সত্য। সনু নিগম মাইকে উচ্চ শব্দে আজানের সমালোচনা করেছে বলে মুসলমানদের ঈমানের তেজে টেকাই দায় হয়ে পড়েছে। এদিকে সৌদি আরব বহুদিন আগেই তাদের মসজিদের লাউডস্পীকার থেকে উচ্চ মাত্রায় আজান দেয়া নিষিদ্ধ করেছে। সৌদি প্রেস এজেন্সী (SPA) জানিয়েছিল, সৌদি সরকার মসজিদের লাউডস্পীকার থেকে শব্দ দুষন প্রতিরোধে একটি বিশেষ অভিযান চালাবে। এর অংশ হিসেবে সৌদির পশ্চিমাঞ্চলের আল-বাহাহ্ এলাকার একশটি মসজিদ থেকে লাউড স্পীকার খুলে নিয়ে গেছে সৌদি ধর্মীয় পুলিশ। সৌদি আরব উচ্চ শব্দে আজানের বিরোধীতা করলে দুনিয়ার কোন মুসলমানের অনুভূতিতে চুলকানি লাগে না। কিন্তু সনু নিগম মাইকে আজানের নামে তাকে বিরক্ত করার কথা বললেই দোষ! সনু নিগম কি মসজিদের মাইক খুলে নিয়ে গেছে? ৩ ডেসিবেলের উপরে আজানও যে শব্দ দূষণ এটা কোন মুসলমানকে বুঝানো যাবে না।

রাতে বাসায় গিয়ে পিসি অন কইরতেই ফেইসবুক দেখি রামকৃষ্ণের পোস্ট। সে লিখেছে, আমি হিন্দু, কিন্তু আজানের মত সুমধুর সুর আর কিছুর মধ্যে পাই না। যারা আজানকে শব্দ দূষণ বলে তারা মুসলিম বিদ্বেষী! তারা ইসলাম বিদ্বেষী! সনু নিগম ও এদেশের কিছু নাস্তিক নামধারীরা আসলে বিজেপি আরএসএসের সদস্য। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করছি…।

রামকৃষ্ণের ফেইসবুক ফলোয়ার এখন সাংঘাতিক রকম বেড়ে গেছে। ফারাবী জেলে যাবার পর তার ফলোয়াররা রামকৃষ্ণের মত আরো কিছু আইডিতে হিযরত করেছে। রামকৃষ্ণের আজকের পোস্টে মুমিন সমাজ আলহামদুলিল্লাহ, মাশাল্লাহ, সোবাহানল্লাহ বলতে বলতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সবাই কমেন্টস লিখছে, আলহামদুলিল্লাহ দাদা, আপনি হিন্দু হয়ে যা বুঝেন সেটা কুলাঙ্গার নাস্তিকরা বুঝতে পারে না।… মাশাল্লাহ দাদা, আল্লাহ আপনাকে কবুল করুন আমীন… দাদা, আপনি কেন ইসলাম গ্রহণ করছেন না? আল্লাহ আপনাকে ইসলাম গ্রহণ করার তৌফিক দিক আমীন…।

শেষের কমেন্টসটা পড়ে হাসলাম। রামকৃষ্ণ দুঃখ করে আমাকে বহুদিন বলেছে, বাংলাদেশে জীবনে সে যতবার ইসলাম গ্রহণ করার দাওয়াত পেয়েছে তার তুলনায় সে যদি একবার কাউকে হিন্দু হবার কথা বলত তাহলে তার জীবন হতো শ্যামল কান্ত্রি স্যারের মত…!

রাককৃষ্ণের পোস্টে কমন্টেস করলাম, ভ্রাতা রামকৃষ্ণ, সনু নিগম আজানের বিরুদ্ধে কিছু বলেনি। উনি বলেছেন উচ্চ মাত্রায় মাইকে আজান বাজানোর বিরুদ্ধে। সৌদি আরব নিজেই উচ্চ মাত্রার আজান প্রচার আইন করে বাতিল করেছে। তাহলে সনু নিগম দোষের কি বলেছে?

আমাদের পাড়ার হেফাজত ইসলামের নেতা মাওলানা ইদ্রিস আলী আমার কমেন্টেসের জবাবে লিখল, তোমার কথার প্রমাণ দেও! সৌদি আরব কবে এই সিদ্ধান্ত নিছে তার প্রমাণ দেও!

-ইদ্রিস আলীকে নিউজ লিংক দিলাম-http://stfrancismagazine.blogspot.com/…/saudi-arabia-clamps…

ডিগ্রী কলেজের সায়েন্সের মাস্টার ওবাইদুল হক কমেন্টস করল, সৌদি আরব ইসলামের কে যে তারা যা করবে সেটাই আমাদের মানতে হবে?

স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা হাসান মোস্তাক কমেন্টস দিলো, আজানের বিরুদ্ধে কটুক্তি সহ্য করতে হবে তার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হয়নি।… নাস্তিকদের এইদেশ থিকা বের করে ছাড়বই ইনশাল্লাহ… জয় বাংলা!

বাসেত ভাই কমেন্টস করলেন আমাকে ম্যানশেন করে।– সুপা তোর মাত্রা কিন্তু ছাড়িয়ে যাচ্ছে! ইসলাম নিয়ে কোন নয়ছয় কথা একদমই সহ্য করা হবে না…।

রামকৃষ্ণ নিজে লিখল, বাংলাদেশে বিশ্বের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের রোল মডেল! এখানে আমরা হিন্দু মুসলমানরা ভাই ভাই হয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করি। কতিপয় নাস্তিক, ভারতের র’ অনুচর চায় না বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িকতা বিরাজ করুক। তারাই অপপ্রচার চালিয়ে, আজানের মত সুমধুর ধ্বনিকে কটুক্তি করে ঘৃণা ছড়াচ্ছে…।

রামকৃষ্ণের কমেন্টস পড়ে হাসলাম খালি। রাগ করব না ঠিক করেও নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। আমি জানি সে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা চালাচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ অসহিষ্ণুদের কাছে নিজেকে ভাল অমুসলিম সাজিয়ে নিরাপত্তা চাইছে। রামকৃষ্ণের আপন জ্যাঠাতো ভাই কয়েক বছর আগে মুসলমান হয়ে গেছে। সেই ঘটনা আমি জানি। তার ইসলাম গ্রহণের একমাত্র কারণ ছিল এদেশে হিন্দুত্ব পরিচয় ঘোচানো। রামকৃষ্ণকে ইনবক্সে লিখলাম, এইসব সাম্প্রদায়িক জামাতী-হেফাজতী আর লীগকে তেল মেরে, দালালী করে কোন ফয়দা হবে না। এই রাস্তাটা ভুল। স্পষ্ট করে সেক্যুলারিজমকেই সমর্থন করা উচিত। নয়ত তোর জ্যাঠাতো ভাইর মত মুসলিম হয়ে ঝাঁকের কৈয়ের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। সেটা না পারলে দেশ ত্যাগ করতে হবে- কথাটা মনে রাখিস…।

রামকৃষ্ণ রিপ্লাই দিলো, তুই নাস্তিক না, ইসলাম বিদ্বেষী, এটা আমি বুঝে গেছি।

আমি লিখলাম, তা-ই সই। সমসায় পড়লে বলিস, আবার মানববন্ধন করব তোর জন্য…

আমাকে ব্লক করার মাস ছয় পর নাসিরনগরের মত ঘটনা ঘটে আমাদের পাড়ায়। কোন হিন্দু পোলা নাকি ইসলামের নবীকে নিয়ে ফেইসবুকে কটুক্তি করেছে। পরে জানা গিয়েছিল কাজটা করেছিল ছাত্রলীগের হাসান মোস্তাক হিন্দু একটা ছেলের আইডির পাসওয়ার্ড চুরি করে। কিন্তু তার আগেই বাসিত ভাই, ওবাইদুল স্যার, মাওলানা ইদ্রিস আলী আর হাসান মোস্তাকরা রামকৃষ্ণদের বাড়িঘর সব মাটিতে ধসিয়ে গিয়েছিল। আগুন দেয়া হয়েছিল ওদের দোকানে। পঞ্চাশটা হিন্দু বাড়ি ধ্বংস হয়েছিল। এই ঘটনার তিন মাসের মধ্যে সব বেচেবুচে রামকৃষ্ণরা চিরতরে দেশ ত্যাগ করেছিল…।