আইনস্টাইনের খাবার-দাবার

কবি-সাহিত্যিকদের ব্যক্তিগত খাবার-দাবার সম্পর্কিত গবেষণা প্রায়ই হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথের খাদ্যরুচি কেমন ছিল, কয়টি পদ দিয়ে তিনি রাতের ভোজন সারতেন, প্রাতঃরাশে রুটি খেতেন নাকি লুচি, ইত্যাদি প্রসঙ্গও খুবই গুরুত্ব পায় রবীন্দ্র-আলোচনায়। হুমায়ূন আহমেদ খেতে ভালোবাসতেন, খাওয়াতে ভালোবাসতেন, রান্না ও খাবারের প্রতি তাঁর বিশাল আগ্রহের কথাও খুব জানা যায়। ড. আনিসুজ্জামান কিংবা আবু হেনা মোস্তফা কামালের কঠিন-পানীয় প্রীতির কথাও অজানা নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও খেতে পছন্দ করতেন, কঠিন-পানীয় পেলে তো কথাই ছিল না। নতুন নতুন খাবার সে কাঁচা ঝিনুকই হোক কিংবা ব্যাঙের স্যুপ, সুনীল খেতেন খুব আগ্রহ নিয়ে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যে খাদ্যের ব্যাপারে কট্টর রক্ষণশীল- অনুকূল ঠাকুরের বাণী সহযোগে সিদ্ধ চাল-ডাল ছাড়া আর কিছুই তেমন খান না, আমেরিকায় যাবার সময়েও গামছা বেঁধে নিজের চাল-ডাল সাথে নিয়ে যান, তাও আমরা জানি।

কিন্তু বিজ্ঞানীদের প্রসঙ্গ যখন আসে তখন তাঁদের বৈজ্ঞানিক অবদান এতটাই প্রাধান্য পায় যে তাঁরা কী খান, কী পান করেন, কী কী খেতে ভালোবাসেন, কী কী খাবারের গন্ধও সহ্য করতে পারেন না এসব ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। তবে কোন বিজ্ঞানী যদি তাঁর বৈজ্ঞানিক সীমা-রেখা ছাপিয়ে ঢুকে পড়েন একেবারে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তখন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়ে আমাদের কৌতূহল হয়। আইনস্টাইনের ক্ষেত্রে তেমনটিই হয়েছে।

আইনস্টাইনের মতো এতটা প্রচার আর কোন বিজ্ঞানীই পাননি কখনো। আইনস্টাইনের আবিষ্কার পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক ভাবনাকে বদলে দিয়েছে, মহাবিশ্বের অজানা রহস্য সন্ধানে তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে এড়িয়ে চলার কোন উপায় নেই। এটা তো বৈজ্ঞানিক সত্য। এর বাইরে বিশাল সংখ্যক মানুষ আছেন যাঁরা আইনস্টাইন ঠিক কী আবিষ্কার করেছেন তা হয়তো ঠিকমতো বলতে পারবেন না, কিন্তু আইনস্টাইনের বড় ফ্যান। আইনস্টাইন সম্পর্কে এত বেশি ঘটনা ও মিথ প্রচারিত হয়েছে প্রচারমাধ্যম এবং লোকের মুখে মুখে – যে আইনস্টাইন নিজেও এক এক সময় আশ্চর্য হয়ে গেছেন ওসব দেখে এবং শুনে। ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখ আইনস্টাইন তাঁর বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে লেখা চিঠিতে এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমার সম্পর্কে ইতোমধ্যে এত বেশি মিথ্যা আর বানানো কথা প্রচার করা হয়েছে যে আমি যদি ওসবের দিকে মনযোগ দিতাম তাহলে এতদিনে আমাকে কবরে ঢুকে যেতে হতো।”

এত প্রচারের মধ্যেও আইনস্টাইনের খাওয়াদাওয়া সম্পর্কে কিন্তু তেমন কোন মিথ বা গুজব কিছুই নেই। কারণ খাবার-দাবারের ব্যাপারে আইনস্টাইন ছিলেন একেবারে যাচ্ছে-তাই সাধারণ মানের। আইনস্টাইন পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য খেতেন, রসনার তৃপ্তির জন্য নয়। খাবার সময়েও তিনি এত অন্যমনস্ক থাকতেন যে কী খাচ্ছেন ঠিক খেয়ালও করতেন না।

ছোটবেলায় আইনস্টাইনের মা পলিন ভালোমন্দ রান্না করে ছেলেকে খাওয়াতেন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই কোন খাবারের প্রতিই বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল না আইনস্টাইনের। তারপর কিশোর বয়স থেকেই তো আইনস্টাইন বাড়ির বাইরে। স্কুলের দিনগুলি খুব একটা সুখের কাটেনি তাঁর। খাবার-দাবারের ব্যাপারটা তাই কোনদিনই সেরকম ভাবে উপভোগ করার অভ্যেস তৈরি হয়নি।

পলিটেকনিকে পড়ার সময় মিলেইভার প্রেমে পড়ার পর মাঝে মাঝে হোস্টেল রুমে আইনস্টাইনের জন্য রান্না করতেন মিলেইভা। কিন্তু আইনস্টাইন বৈজ্ঞানিক আলোচনা কিংবা প্রেমে এতটাই মশগুল থাকতেন যে মিলেইভা কী রান্না করেছেন তা খেয়ালও করতেন না। সেই সব দিনগুলিতে চুমু ছাড়া আর কোন কিছুই আগ্রহ নিয়ে খেতেন না আইনস্টাইন।

আইনস্টাইন ও মিলেইভা

১৯০০ সালে পড়ালেখা শেষ হবার পর থেকে প্রায় তিন বছর একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে চেষ্টা করেছেন আইনস্টাইন। সেই সময়টাতে কিছুই তেমন করতে না পেরে বিজ্ঞাপন দিয়ে টিউশনি খুঁজেছেন। যেকোন খন্ডকালিন চাকরির খবর পেলেও ছুটে গেছেন সেখানে। অনেক চেষ্টার পর এক বন্ধুর সুপারিশে ১৯০১ সালের মে জুন ও জুলাই – এই তিন মাসের জন্য একটা ছুটিজনিত পদে শিক্ষকতার চাকরি পান আইনস্টাইন। উইন্টারথুর টেকনিক্যাল স্কুলের কাছাকাছি একটা এক রুমের বাসা ভাড়া করে আইনস্টাইন স্কুলে পড়াতে শুরু করলেন। সেই সময় তিনি যখন যা পেতেন তাই খেতেন।

দ্রুত শেষ হয়ে গেলো তিন মাসের চাকরি। আরেকটা চাকরির চেষ্টা শুরু করলেন উইন্টারথুরের বাসা থেকেই। ওখান থেকে পনেরো মাইল দূরে জার্মান সীমান্তঘেঁষা সুইজারল্যান্ডের শ্যাফুসেন নামক গ্রামে একটা চাকরির খবর পাওয়া গেলো। আইনস্টাইনের বন্ধু কনরাড হ্যাবিশ্‌ট চাকরিটার খবর দিয়েছেন। চাকরিটিও আহামরি কিছু নয়। স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ফেল করা একজন ছাত্রকে প্রাইভেট পড়িয়ে পাস করিয়ে দেয়া। উইন্টারথুরের পাট চুকিয়ে আইনস্টাইন চলে গেলেন শ্যাফুসেনে। গিয়ে দেখলেন ওটা একটা প্রাইভেট বোর্ডিং স্কুল। ধনী লোকের গাধা টাইপ ছেলেদের স্কুল সার্টিফিকেট পাস করিয়ে দেয়ার একটা প্রাইভেট প্রকল্প। জ্যাকব নুয়েশ নামে মিলিটারি মেজাজের একজন লোক এই প্রকল্পের পরিচালক। মাসিক দেড়শো ফ্রাঙ্ক বেতন ঠিক হলো আইনস্টাইনের জন্য। আইনস্টাইন আরেকটু বেশি বেতনের আশা করেছিলেন। কিন্তু এই দেড়শো ফ্রাঙ্কের চাকরিও তিনি আর কোথায় পাবেন। তবে এখানে তিন বেলা খাওয়া-দাওয়া ফ্রি। খেতে হয় নুয়েশের বাড়িতে।

যে ছেলেকে পড়াতে হবে তার নাম লুইস ক্যাহেন। ধনী মায়ের সন্তান লুইস গণিতে মহাগর্দভ। আইনস্টাইন যত্ন করে নিজের সহজাত এলোমেলো ঢিমেতাল পদ্ধতিতে পড়ানো শুরু করলেন লুইসকে। লুইস এতদিন শুধু মিলিটারি মেজাজের শিক্ষকই দেখেছে। আইনস্টাইনের মতো ভোলাভালা শিক্ষক পেয়ে বেশ খুশি হয়ে গেলো সে। আইনস্টাইনের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেলো তার। ক্রমে আইনস্টাইন জানতে পারলেন লুইসের পড়াশোনার জন্য তার মা বছরে চার হাজার ফ্রাঙ্ক দেন নুয়েশের হাতে। আর নুয়েশ আইনস্টাইনকে দিচ্ছেন মাসে দেড়শো করে? তার মানে বছরে ২২০০ ফ্রাঙ্ক মেরে দিচ্ছেন নুয়েশ? আইনস্টাইনের টাকার টানাটানি চলছে তখন ভীষণ। হঠাৎ রেগে গেলেন তিনি। নুয়েশকে গিয়ে বললেন, “লুইসের মায়ের কাছ থেকে চার হাজার নিয়ে আমাকে শুধু আঠারো শ’ দিতে লজ্জা করে না আপনার?”

নুয়েশ বুঝতে পারলেন কী বলতে চাইছেন আইনস্টাইন। কিন্তু চোরদের গলা সব কালেই বড় হয়। নুয়েশ বাজখাঁই বলায় বললেন, “কী বললেন? আমি টাকা মেরে দিচ্ছি? আপনি যে তিন বেলা আমার বাড়িতে খাচ্ছেন তা কি আকাশ থেকে আসছে? সেজন্য খরচ হচ্ছে বছরে আড়াই হাজারেরও বেশি। লুইসের মা যা দিচ্ছে তার চেয়েও বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে আমার।”

আইনস্টাইন অবাক হয়ে গেলেন। নুয়েশের বাড়িতে তিন বেলায় তিনি যা খান তাতে মাসে বড় জোর বিশ-পঁচিশ ফ্রাঙ্ক লাগতে পারে। আইনস্টাইন পরিষ্কার বুঝতে পারলেন নুয়েশ একজন নির্লজ্জ মিথ্যাবাদীও বটে। আইনস্টাইন নুয়েশকে বললেন, “আপনি যে খাবার আমাকে দেন ওসব অখাদ্য। আমি আপনার বাড়িতে খাবো না। আপনি ওই বারো মাসের বাইশ শ’ অর্থাৎ মাসে ১৮৩ ফ্রাঙ্ক করে আমাকে দিয়ে দেবেন।”
” না, তা হবে না। আপনাকে আমার বাড়িতেই খেতে হবে।”
“না, ওই অখাদ্য আমি খাই না।” – এই প্রথম আইনস্টাইন খাদ্যাখাদ্য বিচার করেছেন। তাও ঠিক খাদ্যের জন্য নয়, একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। আইনস্টাইন জোর দিয়ে বললেন, “তাহলে অন্য চাকরিতে যোগ দিতে হবে আমাকে। আপনার বাড়িতে খেয়ে আমার পোষাচ্ছে না।”

আইনস্টাইন জেদের বশে বলে ফেলেছেন বটে যে চাকরি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু মনে মনে জানেন যে চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি চলতে পারবেন না। এদিকে নুয়েশ ভয় পেয়ে গেছেন যে তাঁর কুকীর্তির কথা লুইসের মায়ের কানে গেলে অর্থ আর মান দুটোই যাবে। তাই আইনস্টাইনের সাথে একটা রফায় এলেন নুয়েশ। ঠিক হলো আইনস্টাইন হোটেলে খাবেন। তাতে যা বিল আসবে তা নুয়েশ মিটিয়ে দেবেন। কিন্তু হোটেলে খেতে গিয়েও আইনস্টাইন প্রতিদিনই একটা স্যুপ কিংবা সাধারণ কিছু খাবার খেয়ে চলে আসেন।

নুয়েশ আইনস্টাইনকে কোনদিনই সহ্য করতে পারেননি। বার্নের প্যাটেন্ট অফিসে আইনস্টাইনের চাকরি হচ্ছে হবে করতে করতেও অনেকদিন চলে গেলো। নুয়েশ জানতে পারলেন যে চাকরির বাজারে আইনস্টাইনের দাম খুব একটা নেই। তাছাড়া এও জানতে পারলেন যে আইনস্টাইন লুইসকে বার্নে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করছেন। নুয়েশ তা হতে দিতে পারেন না। তিনি আইনস্টাইনকে বরখাস্ত করলেন।

প্যাটেন্ট অফিসে চাকরি হবার ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিন্ত আইনস্টাইন। কিন্তু তার জন্য আরো কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা জানেন না তিনি। চাকরি হারিয়ে বার্নে চলে এলেন আইনস্টাইন। বার্নে একটা বাসা ভাড়া করে তাতে ছাত্র পড়াবার বিজ্ঞাপন দিলেন। আইনস্টাইনের ‘পড়াইতে চাই’ বিজ্ঞাপন দেখে একজন মাত্র ছাত্র এসেছিলেন – মরিস সলোভাইন। পরে মরিস আইনস্টাইনের বন্ধু হয়ে ওঠেন। আরেক বন্ধু হ্যাবিশ্‌ট বার্নেই থাকতেন। আইনস্টাইন হ্যাবিশ্‌ট আর সলোভাইনকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন অলিম্পিক একাডেমি। তিন সদস্যের এই একাডেমিতে দিন-রাত বিজ্ঞানচর্চা চলে।

জ্ঞানচর্চা অব্যাহত গতিতে চললেও উপার্জনের কিন্তু কোন উপায় হয়নি তখনো। আইনস্টাইনের জমানো টাকা ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঠিকমতো খাবারই জোটে না – এমন অবস্থা। আইনস্টাইন বেশ কয়েকদিন ধরে শুধু রুটি খেয়ে থাকছেন দেখে বন্ধুদের খুব কষ্ট হলো। তাঁরা প্ল্যান করলেন আইনস্টাইনের জন্মদিনে তাঁকে ক্যাভিয়ার খাওয়াবেন।

১৯০২ সালের ১৪ মার্চ আইনস্টাইনের ২৩তম জন্মদিনে বার্নে আইনস্টাইনের বাসায় বসেছে অলিম্পিক একাডেমির আসর। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাভিয়ার এনে প্লেটে সাজিয়ে আইনস্টাইনের সামনে রেখেছেন সলোভাইন ও হ্যাবিশ্‌ট। তাঁদের দুজনের খুব ইচ্ছে – ক্যাভিয়ার খেয়ে আইনস্টাইনের কী প্রতিক্রিয়া হয় তা দেখার। এদিকে আইনস্টাইন বস্তুর জড়তার ধর্ম নিয়ে চিন্তা করছেন বেশ কয়েকদিন থেকে। তিনি ঠিক করে রেখেছেন সেদিন সেটা নিয়ে আলোচনা করবেন। সলোভাইন আর হ্যাবিশ্‌ট সামনে আসার সাথে সাথেই আইনস্টাইন শুরু করে দিয়েছেন তাঁর আলোচনা। খেতে খেতেই বলে চলেছেন প্রোপার্টি অব ইনারশিয়া প্রসঙ্গে। আলোচনা শেষ হবার আগেই প্লেটের খাবার শেষ হয়ে হেলো। হ্যাবিশ্‌ট জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আজ কী খেয়েছো বুঝতে পেরেছো?”
“কী খেলাম আজ?”
“ক্যাভিয়ার”
“ক্যাভিয়ার! ওটা ক্যাভিয়ার ছিলো? আগে বললে না কেন? বস্তুটাকে একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখতাম। আহা হা, ক্যাভিয়ার। দেখলে তো কেমন চাষার মতো খেলাম! ক্যাভিয়ারের অপমান হলো আজ।”

হ্যাবিশ্‌ট, সলোভাইন ও আইনস্টাইন

সলোভাইন আর হ্যাবিশ্‌ট ভাবলেন ক্যাভিয়ারের কথা আগেই আইনস্টাইনকে জানিয়ে দেয়া উচিত ছিল। কিছুদিন পরে তারা আবার ক্যাভিয়ার নিয়ে এলেন আইনস্টাইনের জন্য। আইনস্টাইন খেতে শুরু করতেই তাঁরা চিৎকার করে স্লোগান দিতে শুরু করলেন, “কী খাচ্ছে আইনস্টাইন?” “ক্যাভিয়ার, ক্যাভিয়ার”।

জেনেশুনে ক্যাভিয়ার খাওয়ার পরেও আইনস্টাইনের মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। বরং সলোভাইন আর হ্যাবিশ্‌টের ছেলেমানুষী উচ্ছ্বাস দেখে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, “ক্যাভিয়ার খেতে ভালো তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তা নিয়ে ওরকম লাফালাফি করার মতো কিছু নেই ক্যাভিয়ারের মধ্যে।” সলোভাইন ও হ্যাবিশ্‌ট বুঝলেন ভালো খাবার-দাবারের সমঝদার আর যেই হোন – আইনস্টাইন নন।

বিয়ের পর মিলেইভা খাবার দাবারের ব্যাপারে আইনস্টাইনকে কিছুটা ভদ্র বানানোর চেষ্টা যে করেননি তা নয়। নানা রকম রান্না করতেন মিলেইভা। কিন্তু আইনস্টাইনের অনাগ্রহ এতটাই বেশি যে তাঁকে খাইয়ে কোন আনন্দ পাওয়া যায় না। বিয়ের আগে চুমু খাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা উৎসাহ থাকলেও বিয়ের পর আইনস্টাইনের সেই উৎসাহেও ভাঁটা পড়েছে। আইনস্টাইন ইতোমধ্যে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত তাঁর পাঁচটি গবেষণাপত্র বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে। বার্লিন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হয়েছেন আইনস্টাইন। স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটির পর জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে গবেষণা করছেন দিন -রাত। মিলেইভার দিকে ফিরে তাকানোর আগ্রহও নেই আইনস্টাইনের। তবে তাঁর নতুন আগ্রহ দেখা দিয়েছে তাঁর চেয়ে চার বছরের বড় মাসতুতো বোন এলসার প্রতি।

১৯১৩-১৪ সাল দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে মিলেইভা আলাদা হয়ে বার্লিন ছেড়ে চলে যান সুইজারল্যান্ডে। বার্লিনের বাসায় একা আইনস্টাইন কাজ করছেন জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে। নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই তাঁর। যখন প্রচন্ড ক্ষুধা লাগে কিছু একটা রাঁধতে হয় তাঁকে। রান্নাঘরে যথাসম্ভব কম সময় কাটানোর জন্য কিছু সংক্ষিপ্ত রন্ধনপ্রণালী আবিষ্কার করলেন আইনস্টাইন। দোকান থেকে কেনা স্যুপের টিন খুলে তা একটা পাত্রে ঢেলে চুলায় বসিয়ে দেন। স্যুপের সাথে ডিমটাও সিদ্ধ হয়ে যায়। একদিন এলসার মেয়ে মার্গট গিয়ে দেখেন আইনস্টাইন স্যুপের মধ্যে ডিম ভেঙে খাচ্ছেন। স্যুপে দেয়ার আগে ডিমটা যে ধোয়া দরকার সেদিকে কোন খেয়াল নেই তাঁর। মার্গটের প্রায় বমি এসে গেলো আইনস্টাইনের খাওয়া দেখে।

এলসার সাথে বিয়ের পরেও আইনস্টাইনের খাওয়া-দাওয়ার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। তারপর অনেক বছর পরে আইনস্টাইন যখন প্রিন্সটনে চলে গেলেন তাঁর জার্মানির জীবন-যাপনের সাথে আমেরিকান জীবন-যাপনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলেও খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা আগের মতোই এলোমেলো রয়ে যায়। আইনস্টাইনের সেক্রেটারি হেলেন ডুকাস আইনস্টাইনকে চোখে চোখে রাখেন, আড়াল করে রাখেন সব উটকো ঝামেলা থেকে। কিন্তু আইনস্টাইন নিজের পড়ার ঘরে এলোমেলো যাচ্ছেতাই রকমে থাকতে পছন্দ করেন। মার্সার স্ট্রিটের দোতলা বাড়ি থেকে নিচে নেমে এসে আশেপাশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে ভাব করেন আইনস্টাইন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা জানেও না আইনস্টাইন কত বড় বিজ্ঞানী, কত বড় সেলিব্রেটি।

পাশের বাড়ির আট বছর বয়সী মেয়ের সাথে বেশ ভাব আইনস্টাইনের। বাড়ির দরজা খোলা পেলেই মেয়েটা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে সোজা আইনস্টাইনের পড়ার ঘরে ঢুকে যায়। আইনস্টাইন মেয়েটিকে অংক শেখাতে শুরু করেন। একদিন মেয়েটির খোঁজে সেখানে হাজির হয় মেয়েটির চৌদ্দ বছর বয়সী বড় বোন জেন সুইং এবং তার বান্ধবী। নিচের তলার বসার ঘরে সবকিছু চমৎকার সাজানো গোছানো। কিন্তু দোতলায় আইনস্টাইনের পড়ার ঘরে ঢুকে জেন অবাক হয়ে গেলো। এত অগোছালো ঘর সে আগে কখনো দেখেনি। টেবিল চেয়ার ঘরের মেঝে সবখানেই এলোমেলো কাগজ, খাতা, বইপত্র ডাঁই করে রাখা। আইনস্টাইনের পোশাক পরিচ্ছদ, মাথার চুল সবই এলোমেলো। ঘরের মাঝামাঝি একটা লম্বা টেবিলে বই খাতা খোলা কলমের পাশে খাবারের ময়লা প্লেট। ঘরের এক কোণে একটা ময়লা স্টোভ। দেখে মনে আইনস্টাইন এই ঘরেই রান্নাবান্না করে খান।

কিশোরী জেন ও তার বান্ধবীকে দেখে আইনস্টাইন খুশি হয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি আমার সাথে লাঞ্চ করতে চাও?”
আইনস্টাইন কী খান এবং কী খাওয়ান দেখার ইচ্ছেয় জেন বললো, “অবশ্যই”।
“তবে বসে যাও।”

জেনকে বসতে বলেই আইনস্টাইন কোণার স্টোভটা টেনে নিয়ে এলেন ঘরের মাঝখানে। জেন কোথাও বসার জায়গা দেখলো না। কারণ ঘরের দুটো চেয়ারের উপরেই বইয়ের স্তূপ। আইনস্টাইন ক্যান ওপেনার দিয়ে একটা একটা করে তিনটা স্যুপের ক্যান খুললেন। তারপর একটা একটা করে ক্যান স্টোভের উপর রেখে গরম করলেন। বই খাতার স্তূপ থেকে হাতড়ে হাতড়ে কয়েকটি ময়লা চামচ বের করে ক্যানের ভেতর দিয়ে গরম ক্যানগুলো এগিয়ে দিলেন জেন ও তার বান্ধবীর দিকে – “খাও”। জেন ও তার বান্ধবীর বমি এসে যাবার অবস্থা। তারা মুখে হাত চাপা দিয়ে দেখে যে আইনস্টাইন আরাম করে ক্যান থেকে স্যুপ খাচ্ছেন। স্যুপ লেগে গেছে তাঁর গোঁফে, গোঁফ থেকে টপ টপ করে ঝরে পড়ে সোয়েটার ভিজিয়ে দিচ্ছে। সেদিকে কোন নজর নেই আইনস্টাইনের, তিনি অনবরত কথা বলে যাচ্ছেন গণিতের নিয়ম কানুন প্রসঙ্গে।

আইনস্টাইন মদ পান করতে পছন্দ করতেন না। অ্যালকোহলের প্রতি কোন আগ্রহই তাঁর ছিল না। নোবেল পুরষ্কার পাবার পর তিনি যখন সেলিব্রেটিদেরও সেলিব্রেটি হয়ে গেছেন, তখন এক আমেরিকান সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমেরিকায় মদের ওপর ট্যাক্স যে বাড়ছে তাতে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?”
আইনস্টাইন তাৎক্ষণিক ভাবে উত্তর দিলেন, “মদের ট্যাক্স বাড়ুক বা কমুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কারণ আমাকে মদ পান করতে হয় না।” পানি ছাড়া আর যে পানীয় আইনস্টাইন পান করতেন তা হলো কফি। কিন্তু কফির ব্যাপারেও তাঁর কোন বিশেষ পছন্দ অপছন্দ ছিল না। যে কোন কফি হলেই তাঁর চলতো।

albert-einstein

একটা নেশাই আইনস্টাইনের ছিল – তা হলো পাইপ টানা। আইনস্টাইন পাইপ ধরেছিলেন ১৮৯৯ সালে বিশ বছর বয়সে। আর ছাড়তে পারেননি। বিজ্ঞানী হিসেবে যে আইনস্টাইন ছিলেন প্রচন্ড উত্তেজক, খাদ্যাভ্যাসে সেই আইনস্টাইনই ছিলেন ভীষণ একঘেঁয়ে। তাতে অবশ্য বিজ্ঞান-জগতের কোন ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না।