লিখেছেন:তানভীর আহমেদ
[১৮৫৯ সালের ২৪ নভেম্বর প্রকাশিত হয়েছিলো ডারউইনের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিজ’। দুনিয়া কাঁপানো সেই ঘটনার ১৫৫ বছর উপলক্ষ্যে]
বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলোচনা কিংবা বিতর্কের দিক্ দিয়ে এমন অনেক বিজ্ঞানীর নামই করা যাবে যাঁরা সমালোচিত কিংবা বিতর্কিত হয়েছিলেন। গ্যালিলিও তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি ‘E pur si muove’ অর্থাৎ ‘তবুও পৃথিবী ঘুরবে’ – এর জন্য তাঁর কালে এবং এই সেদিন পর্যন্ত চার্চের সঙ্গে যে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন তার কথা উল্লেখ করতে হবে প্রথমেই। তাঁর মৃত্যুর সাড়ে তিনশ’ বছর পর চার্চ স্বীকার করে নিয়েছে গ্যালিলিওর সত্যভাষণকে। কিন্তুএর জন্য গ্যালিলিওকে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিলো তা তো এখন হয়ে আছে অমর ইতিহাস। কোপার্নিকাসও একই কারণে বিতর্কিত হোন, তবে তা তাঁর মৃত্যুর পর। এবং ঠিক এই একই কারণে অর্থাৎ – সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘুরে – এই প্রতীতীতে আস্থা রাখার ‘অপরাধে’ পুড়িয়ে মারা হয় জিওর্দানো ব্রুনোকে, সেই ১৬০০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। এমনিভাবে আরো অনেকের নামই করা যাবে যাঁরা জন্ম দিয়েছিলেন নানা বিতর্কের; প্রগতি আর প্রতিক্রিয়ার লড়াইয়ে সামিল করেছিলেন নিজেদের; বিজ্ঞানকে ধর্মীয় অন্ধ নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে মহৎ অবদান রেখেছেন। আসবে নিউটন, আইন্সটাইনের নাম; আসবে এ কালের স্টিফেন হকিং-এর কথাও। তবে এই তালিকার শীর্ষে নিশ্চিতভাবেই অবস্থান করবেন অনন্যসাধারণ একজন – চার্লস ডারউইন; কারণ মানুষের মিথ্যে অহংকারকে তছনছ করে দিয়ে ১৮৫৯ সালের ২৪ নভেম্বর প্রকাশিত তার সেই বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিজ’-এ তিনি দেখালেন জগতের আদি অকৃত্রিম অবস্থা বলে কিছু নেই; সবকিছুই ক্রমাবিকাশের অন্তর্গত; এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে। এতোসব ঘটনার মধ্যে ওই বিষয়টিও আর চাপা রইলো না যে, মানুষ নিজেও ক্রমবিবর্তনেরই এক ফল। এতোদিন লোকে মনে করে এসেছে প্রজাতির পরিবর্তন অসম্ভব, কেননা সব প্রজাতিই সরাসরি স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমে এসেছে আদি অকৃত্রিম চেহারায়, এবং মানুষ জীবজগতের কেন্দ্রবিন্দু, তার দাসত্ব করবার জন্যই প্রকৃতির জন্ম হয়েছে। ডারউইন তছনছ করে দিলেন সেই চিরচেনা পৃথিবীটাকে। মানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছিল যে পরিবর্তনহীন জীবজগত – সেটাকে প্রত্যাখান করলেন তিনি। বললেন শরীরতাত্ত্বিক বিবর্তনের যে নিয়ম তা সকল প্রাণীর ক্ষেত্রে একই। মানুষের জন্য এ এক কঠিন আঘাত। তাই ডারউইন খুব সহজেই হয়ে পড়লেন বিতর্কিত। মোল্লা-পুরুত-পাদ্রীদের কূ-প্ররোচনায় সাধারণ মানুষ ডারউইনকে শত্রু ভাবতে লাগলো; শয়তানের সাক্ষাৎ দূতও তাঁকে মনে করলো অনেকে। মধ্যযুগ হলে ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিজ’-র ভাগ্যে জুটতো নির্ঘাত মৃত্যুদন্ড। ডারউইন এক চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন বিষয়টি ইঙ্গিতে। যুগটা মধ্যযুগ ছিলো না, যে কারণে বিজ্ঞানের একটা বন্ধ দরোজা খোলার সুযোগ পেলো। ভাগ্য ভালো – তাঁর, আমাদেরও; সমগ্র মানবজাতিরই।
তবে ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ লিখবার কথা নয় ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী ইংল্যান্ডের শ্রিউজবারি শহরে এক ডাক্তার পরিবারে জন্ম নেয়া ডারউইনের। হয়তো লিখবার কথা ছিলো ধর্মপুস্তক। স্কুলে ভালো করেননি, কেননা পাঠ্যপুস্তকে নয় – তাঁর চোখ ছিল জালানার বাইরে। চিকিৎসাবিদ্যা পড়তে গেছেন, কিন্তু হাসপাতালে অসম্পূর্ন অচেতন অবস্থায় একটি ছেলেকে অপারেশন করার দূশ্য দেখে যথারীতি পালিয়েও এসেছেন। আইনবিশারদ হবেন, তা-ও হলো না। বিরক্ত পিতা তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন কেম্ব্রিজে ধর্মতত্ত্ব শিখবার জন্য। কিন্তু গীর্জার পাদ্রী হবার বদলে ডারউইন হয়ে গেলেন প্রকৃতিবিজ্ঞানী। প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের এক পর্যবেক্ষক দল যাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপ আর দক্ষিণ আমেরিকায়; জাহাজের নাম এইচ এম এস বীগল। বহুদিনের ভ্রমনসূচি। আমন্ত্রন পেলেন ডারউইনও, তাঁর আগ্রহের কারণে। ১৮৩১-র শেষের দিকে বেরিয়েছিলেন, ফিরলেন প্রায় পাঁচ বছর পর, ১৮৩৬-এ। ইতিহাস গড়বার জন্য বিপুল আয়তনের তথ্যভান্ডার তখন ডারউইনের হাতে। প্রাণী জগতের সুক্ষাতিসূক্ষ্ণ পার্থক্যগুলোও তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়নি। তাঁর সে সুতীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের সার সংকলন করলেন ‘অরিজিন অব স্পিসিজে।’ তাঁর সেই বহুবিখ্যাত তত্ত্ব ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ও সন্নিবেশিত হয়েছে এ বইয়ে।
তবু ‘অরিজিন অব স্পিসিজে’র একটা সীমাবদ্ধতা ছিল। অর্জিত গুনাবলী কী নিয়মে পরিবাহিত হয় তার জবাব ডারউইন সঠিকভাবে দেননি। প্রকৃতপক্ষে রহস্যটি লুকানো ছিলো বংশগতির নিয়মের মধ্যে। ডারউইন হতে পারতেন এই বংশগতিবিদ্যার জনক, কিন্তু গণিতশ্রাস্ত্রে তাঁর অনীহার কারনেই তিনি তা হতে পারলেন না। বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদের সংকরায়ন ঘটিয়ে তিনি কয়েক বংশধারায় অর্জিত বৈশিষ্ট্যের যে অনুপাতগুলো পেয়েছিলেন সেগুলোকে একটা গানিতিক কাঠামোতে আবদ্ধ করার মতো ধৈর্য তাঁর ছিলো না। ১৮৬৬-তে প্রায় একই ধরণের পরীক্ষা চালিয়ে চেক ধর্মযাজক গ্রেগর মেন্ডেল আবিষ্কার করেছিলেন বংশগতির সূত্রটি।
ইতিপূর্বে পদার্থবিদ্যার বৈপ্লবিক চিন্তা-ভাবনাগুলো মানুষকে ওইভাবে নাড়াতে পারেনি যেভাবে নাড়িয়েছিলো ডারউইন-র বিবর্তনবাদ। কেননা তিনি ঝাঁকুনি দিলেন স্বয়ং মানুষকেই। আজকের এই মানুষ যে কোন স্বর্গীয় ছক মাফিক আসেনি, বরং তা ভিন্ন এক নিম্নতর আদি প্রজাতিরই ক্রমবিবর্তনের ফল – এ অমোঘ তথ্যটি হাজির করে এতোদিনের গড়ে তোলা অহমিকাজাত শিক্ষাধারণার দেয়ালটি ভেঙ্গে দুর করে দিতে চাইলেন তিনি।
তাই স্বাভাবিকভাবেই ‘অরিজিন অব স্পিসিজের’ সবচে’ বড়ো শত্রু মৌলবাদ। কেননা তাদের স্থির অচল দৈব বিধিবিধানের মূলে সে করেছিল কঠিন কুঠারঘাত। অতি আধুনিককালে আমেরিকার টেনেসী ও আরকান্সাসে ডারউইন চর্চা সম্পূর্ন নিষিদ্ধ হয়েছিল। মৌলবাদীদের প্ররোচনায় রাষ্ট্র নিষিদ্ধ করেছিলো ডারউইনকে। ডারউইনের শত্রুরা আজও তৎপর। সারা দুনিয়াতেই। এবং বাংলাদেশেও। এরা বিজ্ঞান চায় না, চায় অন্ধ আনুগত্য। এই রাষ্ট্রে বিজ্ঞান নেই। এই রাষ্ট্রে সমাজ বন্ধ্যা। ‘অরিজিন অফ স্পিসিজের’ শত্রুরা যেখানে শক্তিশালী সেখানে বিজ্ঞান এগোবে কী করে, কীভাবেই বা এগোবে মানুষ!?