অর্ক ও সূর্যমামা’র প্রথম অধ্যায়

[বাংলাভাষী কিশোর-কিশোরীদের জন্য একটা বিজ্ঞান সিরিজ লেখা শুরু করেছি। অর্ক ও সূর্যমামা এই সিরিজের প্রথম বই। এবারের বইমেলায় বইটি প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তমনার পাঠকদের জন্য বইটির প্রথম অধ্যায় এখানে প্রকাশ করছি। বইটির ইলেকট্রনিক ফরম্যাট শীঘ্রই পাওয়া যাবে রূপান্তর প্রকাশনী থেকে।]

Arko o Surjomama Cover FB

বৃহস্পতিবার থার্ড পিরিয়ড

সেকেন্ড পিরিয়ড শেষ হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর থেকে বৃহস্পতিবার এলেই মন খারাপ হয়ে যায় আমার। বৃহস্পতিবারে ফোর্থ পিরিয়ডের পরেই আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে যায়। স্কুল ছুটি হয়ে যায় বলেই যে আমার মন খারাপ হয় তা নয়। স্কুল ছুটি হলেই বরং আমার জন্য ভালো। স্কুলের বাঁধাধরা পরীক্ষার পড়া আমার ভালো লাগে না। আমার মন খারাপ হবার আসল কারণ অন্যখানে।

বৃহস্পতিবার থার্ড ও ফোর্থ পিরিয়ডে আমাদের পড়াশোনার বদলে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নামে এক ধরনের প্রহসনে অংশ নিতে হয়। ক্লাসটিচার সবিতা ম্যাডাম এসে বলেন, “এই শোন, যারা গান গাইতে জানো তারা গান করবে। আর বাকিরা চুপচাপ শুনবে। কেউ বদমাইশি করলে কান ছিঁড়ে ফেলবো। ক্লাসে আমি ডিসিপ্লিন চাই।” বলেই তিনি চেয়ারে বসে মোবাইল টিপতে শুরু করেন। আমাদের ধারণা তিনি ফেসবুকে ঢুকে পড়েন।

আমাদের ক্লাসের অনেক ছেলেমেয়েই গান গাইতে পারে। তারা সবাই নতুন নতুন গান শিখে আসে সবিতা ম্যাডামের বাহবা পাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি গান গাইতে পারি না। একটুও পারি না বললে ভুল হবে। গাইতে পারি, তবে গানের কথাগুলো ঠিকমতো বলতে পারলেও সুর আমার গলায় নেই। তাই আমার মন খারাপ হয়। মনে হয় বৃহস্পতিবারের এই দুই পিরিয়ডের নব্বই মিনিট শুধু শুধু নষ্ট হলো। এই নব্বই মিনিটে আমি একটা বই পড়ে শেষ করতে পারতাম। স্কুলের বই ছাড়াও একটা দুটো ‘আউট বই’ আমার ব্যাগে সবসময় থাকে। আমাদের বাসায় সবাই সময় পেলেই বই পড়ে। কিন্তু স্কুলের স্যার ম্যাডামরা ক্লাসের বই ছাড়া আর কিছু পড়ছি দেখলেই তেড়ে মারতে আসেন।

পেছনের বেঞ্চে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ার চেষ্টা করেছিলাম গত বৃহস্পতিবার। কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম। বাঁজখাই গলায় চিৎকার দিয়ে উঠেছিলেন সবিতা ম্যাডাম, “হেই অর্ক, বদমাইশ ছেলে, এতো সুন্দর গান তোমার পছন্দ হচ্ছে না? মাথা নিচু করে বদমাইশি হচ্ছে?”
“বদমাইশি হচ্ছে না ম্যাডাম। বই পড়া হচ্ছে।”
“বই পড়া হচ্ছে? কী বই পড়া হচ্ছে?”
“থিওরি অব রিলেটিভিটি”
“কী থিওরি?”
“রিলেটিভিটি থিওরি ম্যাডাম। আলবার্ট আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি। রিলেটিভিটি সম্পর্কিত আইনস্টাইনের দুটো থিওরি আছে ম্যাডাম। একটি স্পেশাল থিওরি, অন্যটি জেনারেল থিওরি।” বেশ উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করেছিলাম। ভেবেছিলাম সবিতা ম্যাডাম সাহিত্যের মানুষ হলেও আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বে কিছুটা আগ্রহ দেখাবেন। বলতে যাচ্ছিলাম, পৃথিবীর সব কিছুই আপেক্ষিক। এই যে নব্বই মিনিটের গানের ক্লাস – আমার কাছে অনন্ত দীর্ঘকাল বলে মনে হয়, আবার যারা গান করে – যেমন নয়ন, স্বাতী, চিত্রা, ফারজানা, তাদের কাছে এই নব্বই মিনিট সময়কে নিশ্চয় নয় মিনিটের মতো স্বল্প সময় বলে মনে হয়। আপেক্ষিকতার সূত্রের কী চমৎকার ব্যবহার আমরা দেখি চারদিকে।

কিন্তু সবিতা ম্যাডাম থামিয়ে দেন আমাকে। “থাক্‌, আর পন্ডিতি ফলাতে হবে না। আইনস্টাইনের থিওরি বোঝাতে এসেছে বদমাইশ। বার্ষিকে বিজ্ঞানে কত পেয়েছো?”

আমার সব উৎসাহ মুহূর্তেই থেমে যায়। মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। ক্লাস সিক্সের বিজ্ঞান বইতে যা আছে তার সবকিছুই খুব ভালোভাবে জানা আছে আমার। বার্ষিক পরীক্ষায় বিজ্ঞানের সব প্রশ্নের উত্তর বেশ গুছিয়ে লিখেছিলাম। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ১০০ নম্বরের মধ্যে আমি পেয়েছি মাত্র ৪১। আর দু’নম্বর কম পেলে তো পাসই করতে পারতাম না। রেজাল্টের আগে খাতা দেখিয়েছিলেন হালিমা ম্যাডাম। কোন প্রশ্নেরই উত্তর ভুল হয়নি আমার, কিন্তু ম্যাডাম ব্যাপক নম্বর কেটেছেন ইচ্ছেমতো। কী কারণে নম্বর কাটা গেছে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ধমক খেয়ে ফিরে এসেছি। হালিমা ম্যাডামকে যে স্কুলের সবাই ‘কট্‌কটি বেগম’ বলে ডাকে তাতে আমার সামান্য ভূমিকা আছে। সারাক্ষণ কট্‌কট্‌ করেন বলেই নাম দিয়েছি কট্‌কটি বেগম। কিন্তু ম্যাডামের তো তা জানার কথা নয়। আমার আপুর ধারণা আমি যদি হালিমা ম্যাডামের কাছে প্রাইভেট পড়তাম তাহলে এত কম নম্বর পেতাম না। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না, যেটা আমি নিজে নিজে পড়তে পারি তার জন্য আবার প্রাইভেট পড়তে হবে কেন।

“কী? চুপ করে আছো কেন? কত পেয়েছো বিজ্ঞানে?” সবিতা ম্যাডামের ধমকে মুখ তুলে মিনমিন করে বললাম, “ম্যাডাম ৪১”।
“৪১ পেয়েই আইনস্টাইনের ভাব দেখাতে শুরু করেছো, ৮১ পেলে না জানি কী করতে। বদমাইশ কোথাকার।”

সবিতা ম্যাডামের প্রিয় গালাগাল – বদমাইশ। আমি সবিতা ম্যাডামের নাম দিয়েছি ‘বদমাইশ ম্যাডাম’। কিন্তু তা কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া আর কাউকে বলিনি এখনো। আমার বিশ্বাস আমাদের ক্লাসে সবিতা ম্যাডামের গুপ্তচর আছে কয়েকজন। তারা কে কে তা আগে জানতে হবে। নইলে দেখা যাবে বাংলা পরীক্ষাতেও বিজ্ঞানের দশা হবে।

যাক্‌। সেটা ছিল গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা। আজ দেখতে পাচ্ছি ক্লাসের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। নয়ন, চিত্রা, স্বাতী আর ফারজানার চতুরঙ্গ গ্রুপ ‘আকাশ ভরা সূর্যতারা’ গাইবার প্রস্তুতি নিচ্ছে নিচুস্বরে। মনে হচ্ছে সবিতা ম্যাডাম ক্লাসে পা রাখলেই তারা কোরাস গেয়ে উঠবে। আজও নব্বই মিনিটের অসহ্য ধারাবাহিক গান সহ্য করতে হবে ভেবে মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছে আমার। ব্যাগ থেকে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘একটুখানি বিজ্ঞান’ বইটি বের করে পাতা উল্টাতে শুরু করেছি, এমন সময় ক্লাসের সবাই চিৎকার করে উঠলো, “গুড মর্নিং ম্যাডাম, গুড মর্নিং স্যার।”

দরজার দিকে চোখ গেলো। পিঁপের মতো মোটা বেঁটে সবিতা ম্যাডামের পেছন পেছন ক্লাসে ঢুকছেন তালগাছের মতো লম্বা কালো চিকন লিকলিকে আফতাব স্যার।

আফতাব স্যার স্কুলে জয়েন করেছেন মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে। এর মধ্যেই পাগলা স্যার হিসেবে নাম করে ফেলেছেন। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পদার্থবিজ্ঞান পড়ান আফতাব স্যার। আপুর কাছে শুনেছি পদার্থবিজ্ঞান নাকি বেশ ভালোই বোঝান আফতাব স্যার। আমাদের ক্লাস সেভেনে আফতাব স্যার কী করবেন তা এখনো পরিষ্কার নয় আমার কাছে।

সবিতা ম্যাডাম পরিচয় করিয়ে দিলেন, “শোন শিক্ষার্থীরা, ইনি হলেন আফতাব স্যার। তোমাদের নতুন ক্লাসটিচার।”

ক্লাসের মধ্যে হঠাৎ হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। সবিতা ম্যাডাম আর ক্লাসটিচার থাকছেন না সেই খুশিতে আমি সব ভুলে গিয়ে বেঞ্চের ওপর একটা ঘুষিই মেরে দিলাম। কিন্তু আমার দলে খুব বেশি নেই। সবিতা ম্যাডামের ভক্তরা, বিশেষ করে উঠতি গায়ক-গায়িকারা ‘না ম্যাডাম, হবে না ম্যাডাম, আপনাকে ছাড়বো না ম্যাডাম’ ইত্যাদি বলে ম্যাডামকে আরো ফুলিয়ে দিতে শুরু করলো।

এসব শুনে সবিতা ম্যাডামের গোল মুখে কিছুটা হাসির আভাস দেখা গেলো। তিনি বললেন, “শোন, শোন। তোমরা মন খারাপ করো না। হয়েছে কী, আমাকে কলেজ সেকশানের ক্লাসটিচার হতে হচ্ছে। আমি একা ক’দিক সামলাবো বলো। দেখো, আফতাব স্যার আমার মতো ততটা ভালো না হলেও তোমাদের ঠিকই সামলে নেবেন। তোমরা স্যারের সাথে দুষ্টুমি করবে না, কেমন?”

সবিতা ম্যাডাম চলে গেলেন আফতাব স্যারকে রেখে। আফতাব স্যার কয়েক মিনিট কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। ক্লাসের সবাই যেন কৌতুকে ফেটে পড়ছে। আফতাব স্যারকে কেমন যেন ফ্যাকাসে মনে হচ্ছে। তাঁর পরনে মলিন কুঁচকানো শার্ট-প্যান্ট। মাথায় এলোমেলো পাতলা চুল। দেখলাম স্যারের দৃষ্টি ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রীর মুখের উপর ঘুরছে।

ক্লাসক্যাপ্টেন সুব্রত দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আমরা এখন কী করবো স্যার?”
“ও হ্যাঁ, কী করবে। আমি না এসে সবিতা ম্যাডাম এলে কী করতে?”

আফতাব স্যারের উচ্চারণে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক টান ভয়াবহ মাত্রার। সারা ক্লাসে একটা খুশির জোয়ার বয়ে গেল। মনে হচ্ছে এই স্যারকে নিয়ে ব্যাপক মজা করা যাবে। স্যারের প্রশ্নের জবাবে অনেকেই এক সাথে বলে উঠলো, “গান গাইতাম স্যার।”
“গান!” স্যার যেন চমকে উঠলেন। “গান গাইতে তোমরা? এটা কি গানের ক্লাস?”
“না স্যার। এটা হচ্ছে বিবিধ ক্লাস। যেমন খুশি করো ক্লাস। তাই আমরা খুশি মনে গান করি।” কথা বলার সুযোগ পেয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো চতুরঙ্গ গ্রুপের লিডার নয়ন। এত ক্ষীণ শরীরে এত কথা বলার শক্তি নয়ন কোত্থেকে পায় ভেবে পাই না আমি। একবার সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম নয়নকে, “তোকে দেখে তো মনে হয় বাতাসে উড়ে যাবি। এত জোরে কথা বলার শক্তি পাস কোত্থেকে?”
“আমি যে হাতির স্যুপ খাই তা জানিস না?” নয়নের সাবলিল উত্তর। তারপর আর কিছু বলার সাহস পাইনি আমি, যা ফাজিল মেয়ে।

ক্লাসে একটা শোরগোল চলছে। সবাই একসাথে কথা বলতে শুরু করলো। আফতাব স্যার বিমর্ষভাবে বললেন, “ঠিক আছে। তোমরা গান শুরু করো। শুনে দেখি তোমাদের সঙ্গীতের মান কী রকম।”

প্রায় সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেলো, “আকাশভরা সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার প্রাণ।” খুব সুন্দর করেই গাইতে শুরু করেছে নয়ন, চিত্রা, স্বাতী আর ফারজানার গ্রুপ।

কিন্তু ক্লাসের সবাই কথা বলছে যে যার মতো। গানটা শুনতে ভালো লাগছে আমার, আবার লাগছেও না। আমি লুকিয়ে ‘একটুখানি বিজ্ঞান’ পড়তে পড়তে দেখলাম আফতাব স্যার চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন। কৌতুহলী হয়ে উঠলাম আমি। একটা বইতে পড়েছিলাম মনযোগ দিয়ে কিছু শোনার সময় চোখ বন্ধ রাখলে মনযোগ বিঘ্নিত হয় না। স্যার কি তবে মনযোগ দিয়ে গান শুনছেন?

গান শেষ হবার পর চোখ খুললেন আফতাব স্যার। বললেন, “খুবই ভালো গেয়েছো তোমরা। তবে আমার ধারণা গানের কথার মানে কিছুই বুঝতে পারোনি তোমরা। তাছাড়া অনেকেই গান শুনতে শুনতে কথা বলেছো। চলো, সবাই মিলে একটা ছোট্ট পরীক্ষা করি। আমরা গানটি আবার শুনবো। তবে আমাদের সবার চোখ থাকবে বন্ধ। যারা গাইবে এবং যারা শুনবে সবার। সবাই চোখ বন্ধ করো দেখি। গুড। এবার গান শুরু করো।”

চোখ বন্ধ করে গান শোনার সময় আমার মনে হচ্ছিলো সুরের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে সারা ক্লাস। কেউ কোন শব্দ করছে না। কেবল কানে বেজে যাচ্ছে, “কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি, জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান, বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান।”

গান শেষ হবার পরেও গানের রেশ রয়ে গেলো। আমার বৃস্পতিবারের বিষাদ দূর হয়ে গেছে। আমার সহপাঠীরা যে এত ভালো গান গাইতে পারে জানা ছিল না। আফতাব স্যারের মুখে আনন্দের হাসি। স্যার মনে হয় খুব পান খান। দাঁতগুলো লাল লাল।

“তোমরা যারা গান গাইলে এবং শুনলে – অভিনন্দন সবাইকে। খুব ভালো। অতীব সুন্দর গেয়েছো তোমরা। কিন্তু সমস্যা হলো আমি যে গানের কিছুই জানি না। আচ্ছা, দেখি তো তোমাদের মধ্যে আর কে কে গান গাইতে পারো? হাত ওঠাও। শুধুমাত্র গান গাইতে পারলে হবে না, ভালো মতো গাইতে পারা, তাল সুর ইত্যাদি ঠিক রেখে গাইতে পারা। গান তো সহজ জিনিস নয়। শুধুমাত্র বই পড়ে গান শেখা যায় না। গানের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। দেখি – কে কে গানের শিল্পী – হাত ওঠাও।”

আমার ধারণা ছিল আমি ছাড়া বাকি সবাই হাত ওঠাবে। কিন্তু না, সব মিলিয়ে মাত্র নয় জন হাত ওঠালো। তাহলে সবিতা ম্যাডামের ক্লাসে এত শিল্পী কোত্থেকে আসে?

“নয় জন। ষাট জনের ক্লাসে নয় জন তোমরা ভালোভাবে গান গাইতে জানো। খুব ভালো। তাহলে যারা গান গাইতে জানে না তাদের জন্যও ক্লাসে কিছু কার্যক্রম থাকা দরকার। হুঁ, কী করা যায়? আচ্ছা বলতো আমাদের সবারই যে বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার সেই বিষয়টা কী?”

ক্লাসের সবাই চুপ করে রইলো আফতাব স্যারের প্রশ্ন শুনে। আমি ফিসফিস করে বললাম, “বিজ্ঞান”।
“ফিসফিস করে কথা বলবে না। যা বলবে পরিষ্কার করে বলবে। পেছনের বেঞ্চে চোখে চশমা, তোমার নাম কী?”
“অর্ক।”
“অর্ক, কী বলছিলে?”
“বলছিলাম স্যার, আমাদের সবারই যে বিষয়ে কিছুটা জ্ঞান থাকা দরকার সেই বিষয়টা হলো বিজ্ঞান।”
“গুড। অতীব সত্য কথা। কারো কোন দ্বিমত আছে?”

আমাদের ক্লাসের ফার্স্টবয় সুব্রত। পান্ডিত্যপূর্ণ দ্বিমত প্রকাশ না করতে পারলে তার খাবার হজম হয় না। সে বললো, “আছে স্যার।”
“তোমার নাম কী?”
“স্যার সুব্রত।”
“তোমার নাম স্যার সুব্রত? ব্রিটিশ সরকার তোমাকে স্যার উপাধি দিয়েছে? হা হা হা।” স্যারের বিকট হাসির শব্দে ক্লাসের সবাই খুব মজা পেলো। সবাই স্যারের সাথে হা হা করে হাসলো। আফতাব স্যারের জিভ টকটকে লাল। কী পরিমাণ পান যে তিনি খান!

সুব্রত একটু থতমত খেয়ে বললো, “না স্যার, আমার নাম সুব্রত।”
“সুব্রত, তোমার দ্বিমত অসংকোচে প্রকাশ করো।”
“স্যার, বিজ্ঞান না জেনেও কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ দিন যাপন করছে, তাতে কিছুই অসুবিধা হচ্ছে না।”
“তোমার কথার প্রথম অংশ সত্য। বেশির ভাগ মানুষ দিন যাপন করছে বিজ্ঞান না জেনেই। কিন্তু দ্বিতীয় অংশ সত্য নয়। তাতে যে কিছুই অসুবিধা হচ্ছে না তা তুমি বলতে পারো না। তুমি কি পৃথিবীতে একটা জাতিও দেখাতে পারবে যারা বিজ্ঞান না জেনেও যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছে? অথবা একটা জাতিও কি দেখাতে পারবে যারা যথেষ্ট বিজ্ঞান জানার পরেও মানব-উন্নয়নে পিছিয়ে পড়েছে? আসলে বিজ্ঞান আমরা যত বেশি চর্চা করবো, তত বেশি জানবো এবং আমরা ততোই অগ্রসর জাতিতে পরিণত হবো।”

আফতাব স্যারের কথাগুলো খুবই ভালো লাগছে আমার। আমি মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে বললাম, “স্যার, আমরা কি এই ক্লাসে বিজ্ঞানের কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারি?”

স্যার কিছু বলার আগেই অনেকে আপত্তি জানালো। “না স্যার, বিজ্ঞান স্যার বোরিং স্যার। বিজ্ঞান ভালো লাগে না স্যার”।
“বিজ্ঞান স্যার বোরিং স্যার মানে কী? বিজ্ঞান বিষয়টা বোরিং? নাকি বিজ্ঞান স্যার মানে যিনি বিজ্ঞান পড়ান তিনি বোরিং?”
নয়নের গ্রুপটা আবারো সমস্বরে বলে উঠলো, “বিজ্ঞান ও স্যার উভয়েই বোরিং।”
“তাই নাকি? চলো আমরা চেষ্টা করে দেখি বোরিং বিজ্ঞান থেকে কিছুটা মজা বের করতে পারি কিনা। বিজ্ঞান এতো বোরিং হলে বিজ্ঞানের অ্যাত্তো মজার মজার আবিষ্কার কি আমরা পেতাম? আজ আমরা কিছুক্ষণ বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলি। তোমাদের ভালো না লাগলে কথা দিচ্ছি – আমি আর বিজ্ঞানের নাম নেবো না।”

স্যার মহাউৎসাহে ‘বিজ্ঞান’ শুরু করলেন। আমি ‘একটুখানি বিজ্ঞান’ বন্ধ করে সোজা হয়ে বসলাম। আফতাব স্যার ওয়াইপার নিয়ে প্রচন্ড জোরে হোয়াইট বোর্ড মুছতে শুরু করেছেন। মুছতে গিয়ে কয়েকবার হাত থেকে ওয়াইপার ছিটকে পড়লো। তাতেও দমলেন না তিনি।

“আমার পরিচয় দিয়ে শুরু করি। আমার নাম আফতাব হোসেন। আফতাব শব্দের অর্থ জানো তো?”
“জ্বি স্যার, সূর্য”
“তোমাদের ক্লাসেও তো দেখি অনেক সূর্য আছে। দেখি কার কার নামের অর্থ সূর্য?”
“অর্ক”
“তপন”
“দিবাকর”
“মিহির”
“ভাস্কর”
“আদিত্য”
“মেয়েদের মধ্যে কেউ নেই?”
“সবিতা ম্যাডাম”
“ম্যাডাম সবিতা ছাড়া আর কেউ নেই? সূর্য একটি নক্ষত্র। সেরকম আর কোন নক্ষত্র নেই তোমাদের ক্লাসে?”
“চিত্রা”
“স্বাতী”
“বিশাখা”

এসময় নোটিশের খাতা হাতে দরজায় এসে দাঁড়ালেন পিয়ন সুরুজ মিয়া। তাকে দেখেই স্যার বলে উঠলেন, “এই তো আরো একজন সূর্য।”

নোটিশ বইতে সাইন করে সুরুজ মিয়াকে বিদায় দিয়ে আফতাব স্যার বলতে শুরু করলেন, “আজ তোমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শুনিয়েছো। রবি মানে সূর্য।” তারপর আফতাব স্যার হঠাৎ গেয়ে উঠলেন, “আকাশভরা সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণ।”

স্যারের গান শুনে ক্লাসের সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। কারণ এমন বেসুরো গান আমরা আর কখনো শুনিনি। আমার ধারণা ছিল আমার গলায় কোন সুর নেই। এখন আফতাব স্যারের গান শুনে মনে হচ্ছে আমার গলাতেও স্যারের চেয়ে বেশি সুর আছে।

বেসুরো গলা নিয়ে স্যারের কোন মাথাব্যথা নেই। লাল লাল দাঁত বের করে তিনি হাসতে হাসতেই বলছেন, “আসলেই আমাদের আকাশ সূর্যতারায় ভর্তি। তবে মহাবিশ্বে এই পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও প্রাণের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।”

পরিষ্কার হোয়াইটবোর্ডের এক কোণায় মার্কার দিয়ে ছোট্ট একটা বিন্দু আঁকলেন আফতাব স্যার। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “বলতো আমাদের পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে দরকারি জিনিস কী? সবচেয়ে দরকারী জিনিস, যেটা না থাকলে পৃথিবীও থাকবে না।”
“বাতাস?”
“অক্সিজেন?”
“পানি?”
স্যার প্রতিবারই ‘না’ সূচক মাথা নাড়েন। আমি বললাম, “সূর্য।”
“ইয়েস, সূর্য। সূর্য পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে দরকারি জিনিস। সূর্য ছাড়া পৃথিবীতে জীবন বাঁচতে পারে না। সূর্য না থাকলে কোন তাপ থাকবে না। সমস্ত পানির উৎস জমে বরফ হয়ে যাবে। কোন আলো থাকবে না। সমস্ত গাছপালা মরে যাবে। সূর্যের চেয়ে দরকারি আর কোন জিনিস নেই পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। পৃথিবীর উৎপত্তিই হয়েছে সূর্য থেকে।”

বোর্ডের কোণায় আঁকা বিন্দুটাকে সূর্যের রূপ দিতে দিতে আফতাব স্যার বললেন, “চলো দেখি আমরা সূর্য সম্পর্কে কী কী জানি। কে আগে বলবে?”

কথা বলার সুযোগ পেলে একটুও দেরি করে না নয়ন। সে চটপট করে বললো, “স্যার সূর্য আমাদের পরম আত্মীয়। তাকে আমরা মামা বলে ডাকি।”

সারা ক্লাস হো হো করে হেসে উঠলো নয়নের কথায়। আফতাব স্যারও তাঁর লাল দাঁত বের করে হাসলেন। তারপর বললেন, “তোমার কথা অতীব সঠিক। সূর্য আমাদের পরম আত্মীয়। তাকে মামা বলে ডাকাই যায়। তবে মামা মাসি দাদা দিদি কাকা জেঠু খালা ফুফু যে নামেই ডাকো না কেন তাতে সূর্যের কিছু যায় আসে না, কারণ সূর্য প্রাণ ধারণে সহায়তা করে ঠিকই – কিন্তু নিজে প্রাণী নয়। তাছাড়া আরো একটা অসুবিধা আছে – আমরা আমাদের মামাদের খুব কাছে যেতে পারি, কিন্তু সূর্যমামার কাছে যাওয়া তো দূরের কথা, সরাসরি তার দিকে তাকানোও যায় না। এবার তোমরাই ঠিক করো ওরকম একটা জ্বলন্ত গরম জিনিসকে তোমরা মামা ডাকবে কিনা। সে যাই হোক, আমি তোমাদের একটা কাজ দিতে চাই। আগামী এক সপ্তাহ তোমরা তোমাদের ক্লাসের পড়াশোনা শেষ করার পর যেটুকু সময় পাবে সেখান থেকে কিছুটা সময় দেবে সূর্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে। এতদিন তোমরা তোমাদের বই থেকে সূর্য সম্পর্কে যা জেনেছো তা তো আছেই, তার সাথে আরো কিছু যদি জানতে পারো। স্কুলের লাইব্রেরি থেকেও বই ধার নিতে পারো।”

লাইব্রেরির কথায় মনে পড়লো আমাদের স্কুলে একটা লাইব্রেরি আছে। সেটা মাঝে মাঝে খোলা হয়। কিন্তু আমাদের ক্লাসের রুটিন এত বেশি টাইট যে লাইব্রেরিতে যাবার সময় আমরা পাই না। তবুও একদিন ঢুকেছিলাম সেখানে। বইগুলো সব আলমারির মধ্যে তালাবন্ধ করে রাখা আছে। আলমারির চাবি থাকে সবিতা ম্যাডামের কাছে। একদিন সাহস করে তাঁর কাছে গিয়ে লাইব্রেরি থেকে বই নিতে চেয়েছিলাম। সবিতা ম্যাডাম নাক-মুখ কুঁচকে এমন ভাব করেছিলেন যেন আমি লাইব্রেরি থেকে বই চুরি করতে চাচ্ছি। ম্যাডাম বলেছিলেন, “ক্লাসের বইগুলো ঠিকমতো পড়ো না, আবার এসেছো আউট বই নিয়ে যেতে? বদমাইশ কোথাকার।”

আমি স্যারকে বললাম, “লাইব্রেরি থেকে আমাদের বই নিতে দেয়া হয় না স্যার।”
“অ্যাঁ? বই নিতে দেয়া হয় না! লাইব্রেরিতে যে বইগুলো আছে তা তোমাদের পড়ার জন্যই কেনা হয়েছে। তোমরা চাইলে লাইব্রেরির সব বই পড়ে ফেলতে পারো। লাইব্রেরিতে বিজ্ঞানের অনেক বই আছে। আমি দেখবো তোমরা যেন বই ধার নিতে পারো। তাছাড়া এখন ইন্টারনেটের যুগ। তোমরা সেখান থেকেও তথ্য সংগ্রহ করতে পারো। আমেরিকান ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্‌স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশান বা নাসার ওয়েবসাইট থেকে অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করতে পারবে। তোমরা যদি যার যার তথ্য একটা বড় পোস্টার পেপারে সাজিয়ে লিখে নিয়ে আসো – তাহলে পুরো ক্লাস একসাথে অনেক তথ্য জেনে যাবে সূর্য সম্পর্কে। আর একটা অনুরোধ। কাজটা নিজে নিজে করবে এবং না বুঝে কিছু লিখবে না। ধরো এটা তোমাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকল্প। সায়েন্স প্রজেক্ট। অন্য কেউ করে দিলে সেটা কিন্তু অন্য কারো কাজ। অন্যের কাজ নিজের নামে চালানো কিন্তু চুরি করার সামিল।”

আমি আমার বিজ্ঞান খাতা বের করে বড় বড় করে লিখলাম আফতাব স্যারের প্রজেক্ট = সূর্যমামার প্রজেক্ট। পেছনের বেঞ্চে আমার পাশে বসে আবদুর রহিম। সে নিজের খাতার চেয়ে আমার খাতার দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করে। সে কিছুক্ষণ আমার লেখার দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বললো, “সমীকরণের উভয় দিক হইতে র প্রজেক্ট বাদ দিলে প্রমাণিত হয় যে আফতাব স্যার সমান সূর্য মামা।” আমি অবাক হয়ে দেখলাম আবদুর রহিমের কথায় যুক্তি আছে। ঠিক তখন থেকেই আফতাব স্যার আমার সূর্যমামা হয়ে উঠলেন। আবদুর রহিমেরও। অবশ্য আফতাব স্যার তা কখনো জানতে পারবেন না।

আফতাব স্যার সূর্য প্রকল্প সম্পর্কে বিভিন্ন জনের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন কীভাবে তথ্যগুলো সাজাতে হবে, কী কী তথ্য আমাদের জানা দরকার, সূর্যের উৎপত্তি কীভাবে? সূর্যের বয়স কত? সূর্যের তাপ ও আলোর উৎস কী? সূর্যের মৃত্যু হলে কী হবে? ক্লাসের সবাই হঠাৎ বিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহী হয়ে উঠলো। পন্ডিত সুব্রত খুবই গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলো, “স্যার, একটা দরকারি প্রশ্ন ছিল।”

“সব প্রশ্নই দরকারি। অদরকারি প্রশ্ন বলে কিছুই নেই এই দুনিয়ায়। আর প্রশ্ন ছিল মানে কী? আগে ছিল এখন নেই? অতীত কাল?”

আফতাব স্যার যে ছোটখাট সব বিষয় নিয়ে মজা করতে পারেন তা দেখে আমরা হো হো করে হাসতে লাগলাম। সুব্রতকে বিব্রত হতে দেখলে আমি খুবই মজা পাই। কারণ সুব্রত ভয়াবহ রকমের বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবীদের আবার আমার বিশেষ সহ্য হয় না।

সুব্রত বিব্রত হয়ে বললো, “না স্যার। আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই।”
“করো।”
“এই যে প্রজেক্ট আমাদের করতে বলছেন, তাতে কি কোন নম্বর পাওয়া যাবে?”
“নম্বর পাওয়া যাবে মানে?”
“মানে আমরা কি কোন মার্কস পাবো যা আমাদের পরীক্ষার মার্কসের সাথে যোগ হবে?”
“তোমরা কি যা কিছু করো সবই পরীক্ষায় মার্কস পাবার জন্যে করো? লেখাপড়া গবেষণা সবই কি পরীক্ষায় নম্বর পাবার জন্য? জানার জন্য কিছুই কি করো না? জানার মধ্যে যে আনন্দ আছে, সেই আনন্দকে কোন নম্বর দিয়ে বেঁধে ফেলো না। জানার আনন্দ অসীম। স্বাধীনভাবে জানার আনন্দ আরো বেশি।”

শুক্রবার ও শনিবার আমাদের ছুটি। এই দু’দিন সকাল সন্ধ্যা কাজ করে সূর্য সম্পর্কে অনেক তথ্য জোগাড় করে ফেললাম। সূর্যমামা স্কুলের লাইব্রেরির আলমারি থেকে অনেকগুলো বিজ্ঞানের বই আমাদের জন্য বের করে দিয়েছেন। নাসার ওয়েবসাইট থেকে অনেক ছবি ডাউনলোড করলাম। ইংরেজি ভালো জানি না বলে অনেক কিছু ঠিকমতো বুঝতে পারলাম না। আপু আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি কোন সাহায্য নিইনি। কারণ সূর্যমামা বলেছেন নিজের প্রজেক্টের কাজ নিজেরই করা উচিত।

সূর্যমামা স্যার আমাদের নতুন ক্লাস টিচার হওয়াতে রবিবার থেকে বুধবার প্রতিদিন ফার্স্টপিরিয়ডে বিজ্ঞান পড়াতে লাগলেন। স্যার পড়ানোর সময় বই থেকে লাইনের পর লাইন পড়ানোর বদলে বিভিন্ন রকম গল্প করতে করতে যে বিজ্ঞান বুঝিয়ে ফেলছেন তা টের পেয়ে আমরা খুব অবাক হয়ে গেলাম। আমরা চার দিন বিজ্ঞান পড়েই ‘বিজ্ঞান স্যার বোরিং স্যার’ বলতে একেবারেই ভুলে গেলাম। যে বৃহস্পতিবার এলে আমার মন খারাপ হয়ে যেতো, এক সপ্তাহের মধ্যেই সেই বৃহস্পতিবার আসার জন্য আমি অপেক্ষা করে আছি।

বৃহস্পতিবারে ক্লাসের সবাই বড় বড় পোস্টার পেপার গুটিয়ে নিয়ে এসেছি। কেউ কাউকে দেখাচ্ছি না কার পোস্টারে কী আছে। থার্ড পিরিয়ডে আফতাব স্যার এলেন। মুখে খোঁচাখোঁচা কাঁচাপাকা দাঁড়ি, কুচকানো শার্ট-প্যান্ট আর লাল দাঁতের হাসি। স্যারের হাতে বেশ বড় একটা কালো ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর কী আছে বুঝতে পারছি না। মনে হয় ল্যাপটপ কম্পিউটার আর প্রজেক্টর আছে। আপুদের ক্লাসে নাকি স্যার প্রজেক্টর দিয়ে বিভিন্ন কিছু দেখান। স্যার ব্যাগটা টেবিলে রেখেই শুরু করলেন, “বালক-বালিকাবৃন্দ, আজ আমরা কী করিব?”

স্যার মাঝে মাঝেই সাধুভাষায় কথা বলে আমাদের আনন্দ দেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক টানের কারণে স্যারের কথাগুলো শুনতেও আমাদের এক ধরনের আনন্দ হয়।
“প্রজেক্ট সূর্যমামা স্যার” আমাদের সমস্বরে উত্তর।
“অবশ্যই অবশ্যই। কিন্তু তার আগে অবশ্যই আমরা একটা রবীন্দ্রসংগীত শুনিব। সময় নষ্ট না করিয়া শুরু করিয়া দাও।”

নয়ন জিজ্ঞেস করলো, “গানটা কি স্যার সূর্য বিষয়ক হতে হবে?”
“সূর্য নিয়ে অনেক রবীন্দ্রসংগীত আছে নাকি? আমি তো জানি না। যে কোন রবীন্দ্রসংগীতই আমার কাছে সূর্য-সংগীত। কারণ রবি মানেই তো সূর্য, হা হা হা। নাও শুরু করে দাও।”

নয়নের গ্রুপ ফিসফাস করে ঠিক করছে কী গাইবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “স্যার, আমরা কি সবাই চোখ বন্ধ করে শুনবো?”
“ও ইয়েস। বিশুদ্ধ সঙ্গীত হলো শোনার বিষয়। চোখ বন্ধ করে শোনাই ভালো। সবাই চোখ বন্ধ করো।”
আমরা সবাই চোখ বন্ধ করে প্রাণভরে শুনলাম, “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য করো”।

গান শেষে স্যারের “অতীব চমৎকার, অসীম সুন্দর” শুনে চোখ খুলে দেখি স্যার টেবিলে তাঁর ল্যাপটপ কম্পিউটার আর প্রজেক্টর ফিট করে ফেলেছেন। হোয়াইট বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে হলুদ সূর্যের ছবি।

VSS00030

স্যার বললেন, “আজ আমরা সূর্য সম্পর্কে তোমাদের সবার পোস্টারগুলো আগে দেখবো, তারপর সবাই মিলে প্রজেক্ট-সূর্য শেষ করবো।”

স্যারের নির্দেশমতো কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা আমাদের সবার পোস্টারগুলো ক্লাসরুমের দুই পাশের দেয়াল-জোড়া জানালায় স্কচ-ট্যাপ দিয়ে লাগিয়ে দিলাম। তারপর সবাই সবগুলো পোস্টার একসাথে দেখতে লাগলাম। আমাদের সবার পোস্টারই প্রায় একই রকম দেখতে হয়েছে। মাঝখানে হলুদ সূর্যের ছবি। তার চার পাশে গ্রহগুলো পর্যায়ক্রমে। স্যার সবাইকেই খুব বাহবা দিলেন।

তারপর স্যার কম্পিউটার আর প্রজেক্টরের মাধ্যমে আমাদের দেখালেন সূর্যের উৎপত্তি থেকে শুরু করে সূর্যের ভবিষ্যৎ পরিণতি পর্যন্ত। পরের দুই সপ্তাহে আমরা সবাই মিলে সূর্যের তথ্য ও বিজ্ঞান নিয়ে একটি বড় প্রবন্ধ লিখে ফেললাম। স্যার বলেছেন প্রবন্ধটি আমাদের স্কুলের ম্যাগাজিনে ছাপানো হবে। এবার চলো সূর্য সম্পর্কে আমরা কী কী জেনেছি তা বলি তোমাদের।

[এবার কিন্তু বইটা পড়তে হবে। কারণ এখানে সব বলে দিলে আমার প্রকাশক রেগে যাবেন। প্রকাশককে রাগানোর সাহস আমার নেই।]