এপার বাংলা আর ওপার বাংলা দুই বাংলার স্বনামধন্য লেখন, সাহিত্যিকরা সমকামিতা নিয়ে তাদের লেখায় নিজ নিজ মতামত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এদের মধ্যে বেশিরভাগ সবাই সমকামিতা নিয়ে ভাল কিছু মন্তব্য করেননি।ওনারা দেশের বরেণ্য লেখক, অনেক পড়াশোনা করেন, অনেক বই পড়েন। কিন্তু সমকামীতা নিয়ে ওনাদের এমন ভাবা অথবা মনোভাব প্রকাশ করা সত্যি দুঃখজনক। সমকামিতা নিয়ে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থাকার পরও ওনারা কেন ওনাদের লেখায় বিষয়টা নিয়ে লেখেন না সেঁতা বোধকরি সমাজে নিজেদের সম্মান বাঁচিয়ে রাখার জন্যই।
সমকামিতা নিয়ে বাংলা ভাষায় খুব বেশি লেখালেখি হয় নি। ওপার বাংলায় কিছু সাহিত্য রচনা হয়েছে যার মধ্যে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর হলদে গোলাপ অন্যতম। এটি আনন্দ পুরষ্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস। তা বাদে আরো কিছু কাজ হয়েছে , কিন্তু সে ব্যাপারে আমার জানাশুনা অল্প, তাই এড়িয়ে যাচ্ছি।
পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত ইন্টারনেট ব্লগসাইট গুরুচন্ডালীতে অন্য যৌনতা সিরিজে সমকাম যৌনতা বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত সেগুলোর সংকলন গ্রন্থাকারেও বের হয়েছে। ইন্টারনেটে একটু খোঁজ করলেই এ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে, আশা করি।
বাংলা ভাষায় সমকামিতা নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হয়েছে বাংলাদেশে।প্রয়াত লেখক অভিজিৎ রায় তার সমকামিতাঃ একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ- মনস্তাত্বিক অনুসন্ধান বইতে সমকামিতা নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন।
এছাড়া প্রয়াত সমকামী অধিকার আন্দোলনকর্মী জুলহাজ মান্নান এর পৃষ্ঠপোষকতায় রুপবান নামে একটি LGBTQ ম্যাগাজিন এর দুইটি প্রিন্ট সংস্করণ বের হয়েছিল। পরবর্তীতে ধর্মীয় মৌলবাদীদের দ্বারা নিহত হওয়ার পর এই ম্যাগাজিনের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
সম্প্রতি অবশ্য একই নামে রুপবানের অনলাইন সংস্করণে সীমিত পরিসরে কিছু লেখা পাবলিশ হচ্ছে।
কিন্তু এইসব সচেতন তৎপরতার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় এবং প্রতিষ্ঠিত লেখকেরা সমকামিতা নিয়ে কিরকম ধারণা পোষণ করেন?
আমি বিভিন্ন সময়ে বই পড়তে নিয়ে কিছু লেখকের সমকামিতা বিষয়ে তাদের বিক্ষিপ্ত ভাবনার নাগাল পেয়েছি। সেগুলো নিচে উল্লেখ করছি।
এই লেখাটা ভবিষ্যতে কিছু সংস্করণের ভেতর দিয়ে যেতে পারে। আমার চলমান পাঠে যদি নতুন কোন লেখকের সমকামিতা নিয়ে মন্তব্যের খোঁজ পাই তাহলে সেসব এই লেখায় যুক্ত করে দিবো।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ; ছবির দেশে,কবিতার দেশে
একদিন রাত্তিরে অ্যালেন (গিন্সবার্গ) ও আমি লম্বা হলঘরটার একপ্রান্তে শুয়ে আছি।নানারকম গল্প করতে করতে অ্যালেন একসময় আমার গালে দুটো হালকা চাপড় মেরে বলল, সুনীল,হবে নাকি?
সমকামী অ্যালেন আমাকে তার পার্টনার হতে বলছে।কয়েক মুহুর্ত মাত্র দ্বিধা করে আমি ভাবলাম,মন্দ কী?দেখাই যাক না,একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে।ক্ষতি তো কিছু নেই।আমি বললাম ঠিক আছে,হোক।তুমি একবার,তারপর আমি একবার।
অ্যালেন আঁতকে উঠে বলল,না,না,তা হবে না।আমি এক্টিভ।আমি প্যাসিভ হতে পারি না।
আমি বললাম,ওসব এক্টিভ প্যাসিভ বুঝি না।আমি অভিজ্ঞতাটা পুরোপুরি চাই।তুমি যা করবে আমিও তাই করবো।
অ্যালেন বললো,থাক,দরকার নাই।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ; ভালবাসার সাম্পান
একবার (আখতারুজ্জামান)ইলিয়াসের একটা গল্পও আমি ফেরত দিয়েছিলাম। এতে ইলিয়াস ক্ষুণ্ন হয়েছিল। গল্পটিতে সমকামিতা আর হস্তমৈথুনের রগরগে বর্ণনা ছিল। লেখাটা আমি ফেরত দিয়েছিলাম নীতিগত কারণে। পৃথিবীর কিছু মানুষের মধ্যে সমকামী প্রবণতা থাকলেও এবং কিছু কিছু দেশে সেই প্রবণতার আইনি অনুমোদন থাকলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে একে একধরনের মানসিক অসুস্থতা মনে করি। সমকামিতাকে আমার কাছে খুবই একটা নোংরা ব্যাপার মনে হয়, বিশেষ করে পুরুষদের সমকামিতাকে। আমার মনে হয় জীবজগতের আর সব প্রাণীর মতো মানুষেরও এটা কোনো জৈবিক বা যৌনতাগত আকুতি নয়। বংশবৃদ্ধির যে-তাগিদ থেকে যৌনতার উদ্ভব তার সঙ্গেও সমকামিতার কোনো যোগ নেই। এটা মানুষের মধ্যে উত্তরকালে জন্ম নেয়া একটা বিকার মাত্র। পশুকামিতার মতো এ-ও একধরনের অসুস্থতা। আমাদের দরকার এর চিকিৎসা। বর্নাঢ্য উদযাপন নয়।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়; বাঙালের আমেরিকা দর্শন
খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখাও আমার প্রিয় কালক্ষেপ। এসব( আমেরিকার লোকাল) কাগজে বিজ্ঞাপনের বৈচিত্র দেখার মত। জিনিসপত্রের বিজ্ঞাপন তো আছেই,এছাড়া সমকামীদের সঙ্গে যোগাযোগের বিজ্ঞপ্তি বা টেলিফোনে কেউ যদি নিছক গালাগাল শুনতে চান তারও প্রচার রয়েছে।সব মিলিয়ে এক খ্যাপাটে কাণ্ড।দেশটা বাইরে থেকে দেখতে এত সুন্দর, এর তলায় তলায় যে এত জটিলতা বা বিকৃতি আছে তা যেন বিশ্বাস হতে চায় না।
স্যার যদুনাথ সরকার; A Short History of Aurangzib
বইটা আমার হাতের নাগালে নাই, শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরি থেকে ধার নিয়ে পড়েছিলাম।
স্মৃতি থেকে মনে পড়ছে যদুনাথ সরকার আওরঙ্গজেবের মুঘল সাম্রাজ্যের Decline এর কারণ হিসেবে তৎকালীন মুঘল প্রশাসনের সমকামিতা ইত্যাদি ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এ থেকে অবশ্য স্পষ্ট বোঝা যায় না যদুনাথ সরকার সমকামিতার বিরোধিতা করতেন কিনা। তাই এটা বিচারের দায় আমি পাঠকের উপরে ছেড়ে দিচ্ছি।
আমি সমকামী হই বা উভয়কামি সবার আগে আমই মানুষতো। নিজেদের ভাবনাগুলো নিজেরাই লিখি। কারণ আমাদেরকে নিয়ে লেখার কেউ নেই। আমারদের বোঝার মতো এই সমাজে কেউ নেই।তাই যখন মানুষ আমাদেরকে ভুল বুঝে নিজেদের ভ্রান্ত ধারনাগুলো আমাদের মাঝে জোর করে চাপিয়ে দেয়, তখন বড় কষ্ট হয়। নিজ উদ্ধগে তখন কলম তুলে নেই লেখার জন্য। সত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করি। যদি একটু সহযোগিতা, একটু স্বীকৃতি পাই তাহলে বুকের ভেতরে যে চাপা কষ্ট রয়েছে সে কষ্টের পরিমাণটা কমে জেত বহু গুণ। লেখকদের কাছে একটু অনুরোধ, আপনারা সবই বোঝেন, জানেন শুধু স্বীকার করে নিতে জানেন না। সত্যকে আপনাদের লেখায় সামনে তুলে নিয়ে আসুন।