পোষাক কারখানার হাজার পাঁচেক মালিক আছেন। বছরে মাথাপিছু এক শ’ করে জামাও যদি তারা কেনে, দেশে জামার চাহিদা বাড়বে মাত্র ৫ লাখ।
যদি ৫০ লাখ শ্রমিক মাত্র পাঁচটা করে বাড়তি জামা কেনে, আড়াই কোটি জামার চাহিদা তৈরি হবে দেশে।
মালিক তার জামাটা কিন্তু কিনবে কানাডা থেকে। শ্রমিক তার জামাটা দেশেই কিনবে। ফলে দেশে সুতা-কাপড়-সেলাই-রঙ এতগুলো ধাপে এত বেশি নতুন নতুন কর্মসংস্থান বাড়বে। এইবার ভাবো, আড়াই কোটি বাড়তি জামা, বাড়তি জুতো, বাড়তি খাবার, বাড়তি ভোগ্যপণ্য, বাড়তি ছাতা, বাড়তি চলচ্চিত্র দর্শক– এই সব বানাতে যে কর্মসংস্থান হবে, পুঁজির বিনিয়োগ হবে, সেটার সুফল কে ভোগ করবে?
শুধু একা শ্রমিক? না আমি-তুমি সবাই?
এভাবে গুন করো, পোষাক শ্রমিকের মাথা পিছু পাঁচ জন করে পরিবারের সদস্য,আড়াই কোটি মানুষ। এদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। বাড়বে বাহিদা। আর মুনাফাটাকে যদি মালিকদের কাছে আটকে রাখো, তাহলে হারিয়ে যাওয়া চাহিদা।
ব্যাস, তাহলেই তুমি অর্থনীতি যে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, তার আত্মাটাকে ছুঁয়ে ফেলতে পারলা। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা হচ্ছে এর উৎপাদকদের, শ্রমিক কিংবা কৃষক, আদৌ প্রায় কোন ক্রয় ক্ষমতা নেই। ফলে একদিকে তার নিজের পুষ্টি হয় না, অন্যদিকে দেশের মাঝে সে স্রেফ বাড়তি মানুষ, জনসংখ্যা। অথচ এর জন্য দায়ী সকল মুনাফা মালিকদের পকেটে চলে যাওয়া, ব্যবসায়ীর পকেটে চলে যাওয়া।
মুনাফার এই ভয়াবহ অসম বন্টনের কারণেই ক্রময়ক্ষমতা এত কম। তাই বাংলাদেশে মাথাপিছু এত কম কাগজের ব্যবহার, এত কম বিসকুট কেনে এদেশের মানুষ, মাথা পিছু প্রোটিনের বরাদ্দ এত কম।
মজুরি তিনগুন চারগুন বাড়লে এই যে বিপুল চাহিদা দেশে তৈরি হবে, তার জন্য নতুন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক লাগবে। দেশের তরুণদের তখন মালেশিয়া কি কাতারে যেয়ে ভুগতে হবে না অভিবাসী হয়ে। নতুন নতুন কারখানাগুলোতে লাগবে নতুন পদার্থবিদ, রসায়নবিদ। লাগবে নতুন প্রকৌশলী। লাগবে চিকিৎসক, কেননা সবার চিকিৎসার সামর্থ্য তৈরি হবে। লাগবে নতুন ব্যবস্থাপনক। লাগবে নতুন পুঁঁজি। লোকে টাকা তখন জমিতে খরচা না করে বিনিয়োগ করবে শ্রমিকের বাড়তি চাহিদা মেটাতে জেলি থেকে জুতো, নতুন নতুন খাতে। বইয়ের সংস্করণ একটার বদলে আটটা হবে এক বছরে। চলচ্চিত্র দর্শক বেড়ে যাবে বহুগুন, মামুন ভাইরা নাটক বানাতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়বেন যে, সুলেমানের ভীতি দূর হবে মাথা থেকে ।
এই জন্যই বলি, পোষাক শ্রমিকদের স্বার্থই জাতীয় স্বার্থ। কবিদের এইটা বোঝা খুব জরুরি, উপন্যাসিকদেরও্। অধিকাংশ মানুষকে ক্রয় ক্ষমতার বাইরে রাখলে সেই দেশে বাকি সব কিছু অর্ধমৃত দশায় বেঁচে থাকবে। যেমন আছে বাংলা গান,বাংলা সাহিত্য,বাংলা পুঁজিবাজার, বাংলায় জ্ঞানচর্চা। শ্রমিকের মজুরি যত বাড়বে, বাংলা সাহিত্য তত পুষ্ট হবে। কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে সাহিত্য, বিনিয়োগ থেকে শুরু করে সঙ্গীত, সব কিছুর মাঝে যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করবে, তাই তো জাতীয় স্বার্থ।
আর কত ঘুমাবে? আর কত উটপাখির মত বালুতে মুখ গুজে ভাড়াটে অর্থনীতিবিদদের মুখস্ত বুলি শুনবে?