সাধারন কিছু আলোচনা

বর্তমান লেখাটি আমার ২০০৭ সালের ডারুইন দিবস উপলক্ষ্যে মুক্তমনায় আমার লেখা “বিবর্তনের দৃষ্টিতে জীবন” ও ২০০৯ সালের ডারুইন দিবস উপলক্ষ্যে লেখা “বিবর্তনের শিক্ষা” এর ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখলে ভাল হয়। কারণ বিবর্তন সম্পর্কিত কিছু প্রাসঙ্গিক সাধারণ কথা উক্ত দুই প্রবন্ধে আলোচিত হওয়ায় এখানে তার পুনরুক্তি করলাম না কলেবর সংক্ষিপ্ত রাখতে। আগেই অবশ্য বলে রাখি এই লেখা খুব জ্ঞানগর্ভ, গবেষণাভিত্তিক বা বিশদ নয়। তবে আশা করছি এই লেখা অন্যদের বিশেষ করে অভিজতকে এ ব্যাপারে আরো গভীর ও বিশদ কোন সিরিজ লিখতে উদ্বুদ্ধ করবে। যেমন আমার ২০১০ সালের ডারুইন/ভালবাসা দিবস উপলক্ষ্যে লেখা “ভালবাসা ও বিবর্তন” ব্লগের পর অভিজিত পরবর্তীতে তার সাড়া জাগান “সখী ভালবাসা কারে কয়” নামে চমৎকার এক সিরিজ আমাদের উপহার দেয়। সেরকম কিছু আশা করা যায়। তবে জাতীয়তাবাদ ভালবাসার মত গরম টপিক নয় বলে সেরকম আশা করাটা কতটা বাস্তবসম্মত সেটাও প্রশ্ন।

গত মাসে মুক্তমনা ব্লগে ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক এক বাংলাদেশীর হত্যাকান্ডকে নিয়ে একটা ব্লগ লেখা হয়েছিল যা নিয়ে বেশ বিতর্কের সূত্রপাতও হয়েছিল যেখানে জাতীয়তাবাদ উঠে আসে পার্শ্বিক আলোচ্য বিষয় হিসেবে। কেউ কেউ জাতীয়তাবাদ এর (বা দেশ প্রেম) প্রতি তাদের আবেগ নিয়ে লজ্জিত নন বা গর্বিত বলে মত দিয়েছেন আবার কেউ নিরাসক্তভাবে জাতীয়তাবাদের সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর ঊর্ধে উঠে মানবিকতার দৃষ্টিতে সব কিছু দেখার উপর জোর দেন, কোন বিশেষ দেশ বা গোষ্ঠির মধ্যে সীমিত না থেকে, যাকে আন্তর্জাতিকতাবাদ বলা হয়। একটা প্রশ্ন তখন কেউ কেউ করেছিলেন যে বাংলাদেশের পুলিশ তো তার নিজেদের জনগনের উপরই এর চেয়ে ঢের বেশী অত্যাচার নিপীড়ন চালায়, তাহলে এটা নিয়ে আলাদা করে ঘটা করে এত হৈ চৈ করার কি আছে, এটাকে তো সীমান্ত পাহারাদার কর্তৃক সীমান্তে অবৈধ প্রবেশকারী এক চোরাকারবারীকে শায়েস্তা করার একটা ঘটনা হিসেবে দেখলেই তো হয়, যদিও শাস্তিটা বর্বরোচিত ছিল যেমনটা পুলিশেরাও করে নিজেদের জনগনের ওপর। এখানেই জাতীয়তাবাদের ইস্যু চলে আসে। এখানে একজন বা গোটা কয়েক ভারতীয় রক্ষীবাহিনীর সদস্যের দ্বারা একজন বাংলাদেশী নিগৃহীত হলেও এটাকে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে পরোক্ষভাবে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশ নিগৃহীত হওয়া হিসেবে । এখান থেকেই জাতীয়তাবাদের কিছুটা ধারণা করা যায়। এবার আসা যাক জাতীয়তাবাদের স্বরূপ ও তার বিবর্তনীয় শিকড়ের আলোচনায়।

জাতীয়তাবাদ হল জাতিভিত্তিক স্বজনপ্রীতি (Ethnic Nepotism)। মানুষ যেমন তার চারপাশের জনগনের মধ্যে তার নিকট আত্মীয়দের প্রতি অধিকতর আনুকুল্য দেখায়, তেমনি তার চার পাশের জাতিসমূহের মধ্যে নিজের জাতির প্রতিও অধিকতর আনুকুল্য দেখায়। সাধারণ অর্থে জাতি(Nation) বলতে কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে গঠিত এক জনগোষ্ঠীকে বোঝান হয়।

জাতীয়তবাদের অনুভূতির উৎস হল মানুষের সংঘবদ্ধ হবার প্রবণতা। উদ্বর্তনের এক বিবর্তনীয় কৌশল হল সংঘবদ্ধ হওয়া বা গোষ্ঠী সংহতি (Group Cohesion). এই সংহতি বা সংঘবদ্ধতার উদাহরণ নীচু স্তরে কোষ বা বংশাণুতে দেখা যায়। স্বার্থপর বংশাণুর মূল অন্তর্জ্ঞান হল বংশাণুসমষ্টি নিজেদের উদ্বর্তনের জন্যই সংঘবদ্ধ হয়ে মানুষ বা সাধারণভাবে প্রাণী (Organism) নামক বংশাণু যন্ত্র তৈরী করে। প্রাণিকুলের মধ্যে যারা বেশি সংঘবদ্ধ তারা তত বেশি উদ্বর্তনের যোগ্য। যারা সংঘবদ্ধ নয় তাদের বিপন্ন প্রজাতি হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশী। বাঘ তাই বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে পরিগণিত। মানুষ স্বভাবতই সংঘবদ্ধ জীব। তবে মানুষের এই সংঘবদ্ধ হবার প্রবণতাটা অনেক স্তরে দেখা যায় জাতীয়তাবাদ ছাড়াও। যেমন শ্রমিকের শ্রমিক ইউনিয়ন বা ফেডারেশন গঠন করে শ্রমিক হিসেবে নিজেদের উদ্বর্তন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। এরকম আরো উদাহরণ দেয়া যায়।

জাতি হল কতগুলি সাধারণ বৈশি্ষ্ট্যের ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ এক জনগোষ্ঠী। কি সেই বৈশিষ্ট্যসমূহ? বিশিষ্ট্য সমাজবিজ্ঞানী ও লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের জাতীয়তাবাদ বিষয়ক অধ্যাপক অ্যান্টনি দ্য স্মিথ (Anthony D. Smith) জাতিকে এক নামকরণ করা মানবগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যা এক সাধারণ ঐতিহাসিক ভূখন্ড, ঐতিহাসিক স্মৃতি, অতিকথা(Myth), গণ সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও অধিকার ও দায়িত্বের ধারণার ভিত্তিতে গঠিত । তাঁর এ ধারণাকে এক কথায় জাত-প্রতীকবাদ (Ethnosymbolism) বলা হয়। এখানে জাতি ও দেশ সব সময় সমার্থক নাও হতে পারে। যেমন ইহুদীরা এই সংজ্ঞা অনুযায়ী এক জাতি (তাদের সাধারণ এক ঐতিহাসিক ভূখন্ড, ও সাধারণ অতীতের স্মৃতি আছে) হলেও তারা বিভিন্ন দেশের নাগরিক হিসেবে বিস্তৃত আছে, যেমন ইরাক। লিবিয়া, পোল্যান্ড, জার্মানী ইত্যদি। আরেক উদাহরণ হিসেবে বাংগালী জাতির উল্লেখ করা যায়। বাংগালী জাতি বর্তমান বাংলাদেশ (প্রাক্তন পূর্ব বাংলা) ও পশ্চিম বাংলায় বিস্তৃত। ১৯৭১ এর স্বাধীনতার পর শুধু বাংলাদেশীয়দের বাঙ্গালীদের নিয়ে নতুন এক জাতীয়তাবাদ বা জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়েছে যাকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বলা হচ্ছে। এর দ্বারা বাংলাদেশের বর্তমান ভূপরিসীমার বাইরে বসবাসকারী বাঙ্গালীদের সাথে পার্থক্য টানা হয়েছে। স্মিথের ধারণাটা অনেকটা বাস্তবসম্মত হলেও এটার সাথে বিবর্তনের কোন যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা নেই। সেই চেষ্টা করেছেন কানাডার লন্ডন শহরের ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক J. PHILIPPE RUSHTON। অধ্যাপক রাশটন তাঁর ধারণা বা তত্বকে বংশাণুগত সাদৃশ্যতত্ব (Genetic Similarity Theory) বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি অধ্যাপক অ্যান্টনি স্মিথ এর জাত-প্রতীকবাদ এর ধারণাকে বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের পরার্থতার (altruism) ধারণার সাথে যোগসূত্র ঘটিয়ে বিস্তৃত করার চেষ্টা করেছেন। এই ধারণা অনুযায়ী মানুষ বংশাণুগতভাবে তার সদৃশ অন্য মানুষের প্রতি পক্ষপাত বা আনুকুল্য দেখায় বিবর্তনীয় প্রবৃত্তির তাড়নায়। বিবর্তনের মূল প্রতিপাদ্য হল নিজের বংশাণু সংরক্ষণ ও সঞ্চালন। নিজ সদৃশ মানুষের বংশাণুও নিজের বংশাণুর সাথে মিল থাকার সম্ভাবনা বেশী। তাই নিজ সদৃশ মানুষের প্রতি আনুকুল্য দেখান নিজের বংশাণুর সংরক্ষণেরই এক চেষ্টা বই কিছু নয়। এই ধারণার প্রবর্তক হলেন বিখ্যাত বিবর্তন বিজ্ঞানী উইলিয়াম হ্যামিল্টন। তিনি এই ধারণাকে গোষ্ঠীয় যোগ্যতা (Inclusive fitness) আখ্যায়িত করেছেন। পরার্থতার কারণ হিসেবে তিনি গোষ্ঠীয় যোগ্যতা বৃদ্ধির কৌশল বলে দেখিয়েছেন। বংশাণু উদ্বর্তনের এক কৌশল হল গোষ্ঠীয় যোগ্যতার বর্ধন। পরার্থতার দ্বারা গোষ্ঠীর অন্য সদস্যের উদ্বর্তনে সহায়তা করলে নিজের সদৃশ বংশাণুরই সংরক্ষণ হয়। চরম আত্মত্যাগের দ্বারাও এই লক্ষ্য অর্জন হয়। গোষ্ঠীয় যোগ্যতা বর্ধনের কৌশল এর পূর্বে প্রস্তাবিত আত্মীয় নির্বাচন (Kin Selection) তত্বের এক ব্যাপকতর রূপ। হ্যামিল্টন তাঁর তত্বের দ্বারা প্রস্তাব করেন যে পরার্থতা শুধু যে আত্মীয়দের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে তাই নয়, যে কোন মাত্রায় বংশাণুগত সাদৃশ্যই (genetic relatedness) এর নিয়ামক, সেটা আত্মীয়ের বাইরেও হতে পারে। তিনি গাণিতিক ভাবে এটা ব্যক্ত করেন সমীকরণ দ্বারা, যেখানে এই বংশাণুগত সাদৃশ্য একটি গাণিতিক সূচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিভাবে প্রাণীরা এই বংশাণুগত সাদৃশ্য প্রবৃত্তিগতভাবে নির্ধারণ করে তাঁর তত্বে এটাও তিনি আলোচনা করেছেন। অধ্যাপক রাশটন বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপর জরীপ চালিয়ে দেখিয়েছেন যে বংশাণুগত সাদৃশ্যই জাত-কেন্দ্রিকতার (Ethnocentricity) ভিত্তি। উদাহরন হিসেবে রাশটন ইহুদী জাতির উল্লেখ করেন যে ইহুদীরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও তাদের নিজেদের মধ্যে বংশাণুগত সাদৃশ্য তাদের সাথে অ-ইহুদীদের বংশাণুগত সাদৃশ্যের চেয়ে ঢের বেশী, যদি অ-ইহুদীরা তাদের নিকটে বসবাসকারীও হয়। তিনি আরো একটা উদাহরণ হিসেবে হিন্দু জাতিভেদ প্রথার উল্লেখ করে বলেছেন যে এটা নিশ্চিত করা গেছে যে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মধ্যকার বংশাণুগত সাদৃশ্য তাদের সাথে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের বংশাণুগত সাদৃশ্যের চেয়ে বেশী। আরো গবেষণার উল্লেখ করে বলেন যে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের বংশাণু ইউরোপীয়দের সদৃশ আর নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের বংশাণু দক্ষিন ভারতের প্রাচীন দ্রাবিঢ় বংশোদ্ভুত জাতির বংশাণুর সদৃশ। বলাই বাহুল্য গবেষণার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টিও হয়েছে। এরকম আরো অনেক জাত-কেন্দ্রিকতার উদাহরন দিয়েছেন রাশটন তাঁর গবেষণা পত্রে।

গবেষণাকর্মের জটিলতায় নিয়ে না লিখে এবার আসা যাক কিছু সাধারণ আলোচনায়। এটা পরিস্কার যে যেহেতু মানব স্বভাবের সকল দিকই বিবর্তনের দ্বারা উদ্ভূত ও নিয়ন্ত্রিত, তাই জাতীয়তাবাদী চেতনা বা দেশপ্রেমও বিবর্তন জনিত এক প্রবৃত্ত বা অনুভূতি। দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদকে অনেকে এক মহান আদর্শ হিসেবে স্থান দেয়। আসলেই কি তাই? অন্য সব আদর্শের মত দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদ কোন স্বতন্ত্র বস্তুনিষ্ঠ ভিত্তিতে বা যুক্তিবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আদর্শ নয়। তবে কোন কোন আদর্শ বা মূল্যবোধকে মানুষ সার্বজনীনভাবে স্বীকৃতি দেয়, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, যেমন সার্বজনীন মানবাধিকার, নারী পুরুষের সমানাধিকার, বিশ্বাসের স্বাধীনতা,বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ইত্যাদি। দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদ এরকম সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত কোন আদর্শ নয়। বাংলাদেশ ছাড়া খুব কম দেশের গঠনতন্ত্রে জাতীয়তাবাদকে এক স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভিয়েতনাম দীর্ঘ সময় ধরে মার্কিন আগ্রাসন ও আধিপত্যের অধীনে থেকে রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করলেও তাদের সংবিধানে জাতীয়তবাদের উল্লেখ নেই। সংবিধানে বিভিন্ন উপজাতির স্বকীয়তাকে সংরক্ষিত করার উপর জোর দেয়া হয়েছে, সবাইকে ভিয়েতনামী হয়ে যেতে হবে বলা হয় নি।

দেশপ্রেমের দুটো অর্থ করা যায়। এক হল ব্যক্তি বা সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থের উপরে উঠে দেশের সামগ্রিক স্বার্থকে স্থান দেয়া। সেই অর্থে দেশপ্রেম অবশ্যই এক সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত মহান গুণ বা আদর্শ। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে যা বেদনাদায়কভাবে অনুপস্থিত। প্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডী তাই বলেছিলেন দেশ তোমার জন্য কি করতে পারে জিজ্ঞেস না করে তুমি দেশের জন্য কি করতে পার সেই প্রশ্নই কর। আর এক অর্থে (যেটা অধিকাংশ সময় বোঝান হয় এবং লেখার প্রারম্ভে উল্লেখিত বিতর্কের ইস্যু ছিল) দেশপ্রেম হল নিজ দেশকে অন্য দেশ থেকে আলাদা করে এক বিশেষ স্থান দেয়া বা আনুকুল্য দেয়া, গুণাগুণ বিচার না করে। এটা কোন সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত মহান আদর্শ নয়। আন্তর্জাতিকতায় বা বিশ্বনাগরিকতায় বিশ্বাসীরা জাতীয়তাবাদের ধারণার সম্পূর্ণ বিরোধী। এই অর্থে জাতীয়তাবাদ আর রেসিজম (জাতিবাদ?) এর মধ্যে খুব স্পষ্ট পার্থক্যরেখা টানা যায় না। কারণ মানুষের সংঘবদ্ধ হওয়ার বৈবর্তনিক কারণের মূলে আছে প্রতিপক্ষতা বা প্রতিযোগিতার মোকাবিলা। প্রতিপক্ষতা বা প্রতিযোগিতা না থাকলে সংঘবদ্ধ হওয়ার বৈবর্তনিক প্রয়োজনীয়তাটাও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। আর সংঘবদ্ধ হওয়ার মূল চেতনাই হল নিজ গোষ্ঠীকে অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে উপরে স্থান দেয়া, যা এক পর্যায়ে রেসিজমের রূপ নেয়। এই দ্বিতীয় অর্থের দেশপ্রেমই লেখার বাকী অংশের আলোচ্য বিষয় থাকবে।

জাতীয়তাবাদী চেতনার বা দেশপ্রেম নিয়ে লজ্জিত হবার যেমন কিছু নেই তেমনি এতে গর্বিত বোধ করা বা এটাকে মহান আদর্শ বলে প্রচার করারও কোন যৌক্তিক কারণ নেই। এটা কোন কোন সময়ে ঐতিহাসিক কারণে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায় যখন এর উদ্বর্তনী মূল্য থাকে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এমন এক ঐতিহাসিক কারণ। তখন পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণকে পাকিস্তানী জাতি কর্তৃক বাঙ্গালী জাতিকে আক্রমণ হিসেবে দেখে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়াটা আক্রমন প্রতিহত করার ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এক শক্তিশালী প্রেরণার উৎস বা উদ্বর্তনী কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু যদি কল্পনা করা যায় যে নির্বাচনের রায় মেনে নেয়া হয়েছিল, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তানী সরকার গঠিত হল। ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙ্গালীরা সমগ্র পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক আধিপত্য বিস্তার করতে থাকল। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনা ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। এক সময় হয়ত বাঙ্গালী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের জনগণকে নিয়ে এক নতুন নাম নিয়ে নতুন এক জাতীয়তাবাদ মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠ্ত। সবই কাল্পনিক এবং বাস্তবে ঘটার সম্ভাবনা কম ছিল তখনকার বাস্তবতায়। কিন্তু চিন্তা করা যায়, তাত্বিক বা যৌক্তিক ভাবে অসম্ভব কোন ব্যাপার নয়। এই কল্প পরীক্ষার (Thought Experiment) উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়তাবাদের প্রাসঙ্গিকতাকে বোঝান।

আরেকটা উদাহরণ দেয়া যাক। বাংলাদেশের চাকমা উপজাতির জনগণ তাদের জাতিসত্ত্বা কে বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বা থেকে পৃথক বিবেচনা করে। এখানে তারা নির্যাতিতের ভূমিকায়, বাঙ্গালীরা নির্যাতনকারীর ভূমিকায়। তাই চাকমাদের জন্য চাকমা জাতীয়তাবাদ তাদের আত্মরক্ষার্থে এক প্রাসঙ্গিক চেতনা। এখানে বাঙ্গালীদের জন্য বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই। অবশ্য উগ্র জাতীয়তাবাদে অনেক সময় অপেক্ষাকৃত দুর্বল জাতির জাতিসত্ত্বাকে বিলুপ্ত করে তাদেরকে আত্মীকরণ করার জন্য অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী জাতি জাতীয়তাবাদী শ্লোগানের আশ্রয় নেয়।

জাতীয়তাবাদ নাকি আন্তর্জাতিকতাবাদ কোনটা সত্যিকার আদর্শ হওয়া উচিত? বিবর্তনের আলোকে উত্তর হবে এটা বস্তুনিষ্ঠভাবে উচিত অনুচিতের প্রশ্ন নয়, তবে বিবর্তন মানুষের মনে এই দুই বাদেরই ঔচিত্য বা অনৌচিত্যের বোধ সৃষ্টি করে। কারণ দুটোরই সহাবস্থান প্রয়োজন উদ্বর্তনের সহায়তার জন্য। একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝান যাক। সমাজে সবাই সত্যবাদী হয়ে যাওয়াটা বিবর্তন এর সহায়ক নয়। এটে এক চরম সামাজিক অস্থিতিশীলতা বা ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে। আবার সবাই মিথ্যাবাদী হলেও সমাজ অচল হয়ে পড়ে। এটা বোঝা সহজ। তাই বিবর্তন সমাজে কিছু মিথ্যাবাদী আর বেশী সত্যবাদী হবার পক্ষে। তাই বিবর্তন সত্যবাদী হবার বোধকে এক মহান আদর্শ হিসেবে মানুষের মনে প্রবৃত্তিগতভাবে প্রবিষ্ট করায়, যাতে সবাই মিথ্যাবাদী না হতে পারে। একইভাবে যে সমাজের সব সদস্যই পরার্থপর বা সসব সদস্যই স্বার্থপর সেই সমাজ উদ্বর্তনের জন্য আদর্শ নয়। কিছু স্বার্থপর আর বেশি সংখ্যক পরার্থপর সদস্যই উদ্বর্তনের সহায়ক। ক্রীড়াতত্ব দিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। যুক্তিবাদ ও ভাববাদো একই কাতারে পড়ে। ভাবাবেগের বিবর্তনী প্রয়োজন (বা উদ্বর্তনী মূল্য) আছে। কিন্তু লাগামছাড়া আবেগ বা ভাববাদ সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ঊন্নয়নের (প্রকারান্তরে উদ্বর্তনের) বিপক্ষে। তাই যুক্তিবাদের চেতনা বা বোধও মানুষের মনে তৈরী হয় বিবর্তনীয়ভাবে। কিন্তু বিবর্তন ১০০% যুক্তিবাদী বা দার্শনিকদের দ্বারা গঠিত মানবগোষ্ঠী সমর্থন করে না। এটা বেদনাদায়ক হলেও বিবর্তনের অমোঘ সত্য। একইভাবে আমরা বলতে পারি মানুষের সংঘবদ্ধ হওয়াটা উদ্বর্তনের সহায়ক ঠিকই, কিন্তু তাই বলে অত্যাধিক সংখ্যায় বিভক্ত মানব গোষ্ঠী মানব কল্যানের জন্য সহায়ক নয়। সোজা কথায়, বেশী জাতি বা দেশ যেমন বাঞ্ছণীয় নয়, তেমনি দেশ বা জাতিহীন মানব গোষ্ঠীও স্থিতিশীল নয়। মানুষ বা যে কোন প্রজাতিরই এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান হল প্রতিযোগিতা বা প্রতিপক্ষতা। তারই বাস্তব পরিণতি হল সংঘবদ্ধ হবার প্রবণতা, নিরাপত্তার ও আত্মরক্ষার জন্য। বিপরীত প্রবৃত্তির টানা পোড়েনে দ্বারা সাম্য বজায় রাখাটাই প্রকৃতির এক ক্রীড়ানকশা বলা যায়। সম্পূর্ণ সমসত্ত্বতা প্রকৃতি পরিহার করে। কাজেই দেশ বা রাষ্ট্রহীন এক পৃথিবী এক অলীক বস্তু, যদিও অতি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে একটা শক্তিশালী আদর্শ হিসেবে এর গুরুত্ব আছে। ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ বা জাতিকে প্রাধান্য দেয়াটা যদি মহান আদর্শ বলে সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত হয় তাহলে জাতিকেন্দ্রিকতার ঊর্ধ্বে উঠে সকল মানুষের কল্যান বা বিশ্বভ্রাতৃকে অগ্রাধিকার দেয়াটাও মহান আদর্শ বলে বিবেচিত না হওয়ার কোন কারণ নেই।