কোরানের কর্তা কোরান বিষয়ক

কোরানের কর্তা আল্লাহ এইটা মোটামুটি সৎ দাবি। কর্তা বললাম, স্রষ্টা বললাম না। কারন কোরান অসৃষ্ট এইরকম বিশ্বাস মুসলমানদের মধ্যে আছে, কারন কোরান হইল আল্লাহর বাণী তথা লোগোস। আল্লাহর বাণী আর কোরান নামক কিতাব কনসেপ্ট হিসাবে এক জিনিস না, যদিও দুইটার মধ্যে একটা জটিল প্যারাডক্সিকাল সম্পর্ক আছে। আল্লাহকে কোরানের লেখকও বলতে পারছি না, কারন কোরানের কাতিব (স্ক্রাইব) আছেন অনেকজন যারা এই বাণীগুলা লিখেছেন। যদি প্রচলিত এই বিশ্বাস মেনেও নেই যে এই বাণীগুলা মুহাম্মদের মুখ থেকে বের হয়েছে, তাতেও মুহাম্মদকেই কোরানের কর্তা বলাটা ঠিক বলে মনে হচ্ছে না। মুহাম্মদ নামে একজন মানুষ ছিলেন বটে, কিন্তু কোরানে কোথাও তার নাম লেখক হিসাবে নাই। লেখক নামক কর্তা অনেক আধুনিক জিনিস। যেমন আমার লেখা বইয়ের কপিরাইট আমার। আমিই আমার বইয়ের কর্তা, এইরকম দাবি একজন আধুনিক মানুষ হিসাবেই আমি করি। যদিও আমিত্ব জিনিসটা কোন একক কিছু না, খন্ডিত (ফ্রাগমেন্টেড) বিষয়। সাইকোএনালিসিসের ভাষায় বলতে গেলে এই আমি আনকনসাস/সাবকনসাস, ইগো এবং সুপার ইগোর সমষ্টি। বৌদ্ধ দর্শনের দিক থেকে বলতে গেলে এই আমিত্ব একটা ভ্রম। জুলিয়ান জেইন্সের বাইকেমারাল মাইন্ড বিষয়ক থিওরি এই বিষয়ে আরেকটা প্রাসঙ্গিক ইন্টারেস্টিং থিওরি।

প্রাচীনকালে মানুষ মূর্তি বানায়ে বলতো যে ঐ মূর্তি দেবতারা বানাইছে। প্রাচীনকালের বিভিন্ন বইকে বলা হতো অপৌরষেয়, মানে দেবতা বা আল্লাহর সৃষ্টি। ব্যক্তি লেখক একদিনে গড়ে ওঠে নাই। মার্ক্সিয় ভাষায় এটাকে বলে এলিয়েনেশন, মানে নিজের শ্রমের সৃষ্টিকর্ম নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। এবং নিজের শ্রমের জিনিসকে পুঁজা করাও (পুঁজিবাদী দুনিয়ায় কমোডিটি ফেটিসিজিম যার উদাহরণ) এর অন্তর্গত। র‍্যাশনাল, স্বাধীন ইচ্ছা ও স্বাধীন সৃষ্টিকর্ম করতে সক্ষম মানুষের ধারণাও খুব পুরাতন নয়। এনলাইটেনমেন্টের আগে এই ধরণের মানুষের ধারণা খুব প্রভাবশালীও ছিল না। বিভিন্ন মহাকাব্যে দেখা যায় নায়কের কর্মের পেছনে কোন না কোন দেবতা মূল কর্তা হিসাবে হাজির। একিলিস হয়তো ক্রোধে উম্মাদ, কিন্তু এই ক্রোধও কোন এক দেবতার কর্ম। ক্রোধে উম্মাদ না হয়ে শান্ত থাকাটা একিলিসের ইচ্ছার অধীন না। প্রাচীন খলিফাদের ইচ্ছাকে দেখা যায় আল্লাহর ইচ্ছা বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।

কচি নাস্তিকদের কাছে এই বিষয়গুলা ভন্ডামি বলে মনে হয়। আমার মনে হয় প্রাচীন মানুষেরা এইদিক থেকে অপেক্ষাকৃত সৎ ছিলেন। তাদের সাহিত্যকর্মগুলাতে (ধর্মীয় পুস্তকগুলাও যার অন্তর্ভুক্ত) ফ্রাগমেন্টেড সেলফের হাজিরা তাদের সময়ের যথেষ্ট সৎ উপস্থাপন। তাওরাত বা কোরানে দেখা যায় আল্লাহ অনেকসময় আমি না বলে ‘আমরা’ বলছেন। আমার মনে হয় এটা বক্তা বা কর্তার ফ্রাগমেন্টেড সেলফের স্বীকৃতি। দীর্ঘদিন যাবৎ কোরান পড়ে যেটা দেখেছি তা হলো যে ব্যক্তি মুহাম্মদ (যার একটা বায়োগ্রাফি আছে) এই কিতাবে কর্তা হিসাবে হাজির নাই। তার ইগো একেবারেই নাই সেই দাবি অবশ্য করছি না। তবে তার আনকনসাস/সাবকনসাস আরো অনেক প্রকটভাবে হাজির, ‘মুসার ন্যায় নবী’ হিসাবে। কোরানে তাই মুসার নাম যতোবার পাওয়া যায়, মুহাম্মদের নাম তার ধারেকাছেও পাওয়া যায় না। তবে সবচাইতে বেশি হাজির সুপার ইগো, যার নাম – আল্লাহ। সেই হিসাবে কোরানের কর্তা মূলত আল্লাহ, এই দাবি যথেষ্ট সৎ।