“যে মুহাম্মদ (সাঃ) কে জানে সে ইসলাম জানে, যে তাঁকে জানে না সে ইসলাম জানে না।”
ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদাইবিয়া সন্ধি’ (মার্চ, ৬২৮ সাল) ও সন্ধি পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা কী কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; দশ বছরের শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর দুই বছরের মধ্যে তা ভঙ্গ করে মক্কা বিজয় (মার্চ, ৬৩০ সাল) সম্পন্ন করার পর স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কী কারণে মক্কাবিজয়-পরবর্তী প্রথম হজব্রত পালনে (মার্চ-এপ্রিল, ৬৩১ সাল) অংশগ্রহণ করেননি; নিজে অংশগ্রহণ না করে তাঁর চাচাতো ভাই ও জামাতা আলী ইবনে আবু তালিব-কে তিনি কী নির্দেশ সহকারে ঐ হজে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন; মুহাম্মদের নির্দেশে আলী ইবনে আবু তালিব অমুসলিমদের বিরুদ্ধে ঐ হজের প্রাক্কালে কুরানের কোন নৃশংস চরমপত্র (Brutal Ultimatum) ঘোষণা করেছিলেন, তার আলোচনা আগের পর্বে করা হয়েছে। আল্লাহর রেফারেন্সে মুহাম্মদের এই সর্বশেষ অমানবিক বীভৎস আদেশের বৈধতা প্রদানের প্রয়োজনে জগতের প্রায় সকল তথাকথিত মডারেট পণ্ডিত ও অপণ্ডিতরা (অধিকাংশই না জেনে) যে প্রতারণা ও মিথ্যাচারের আশ্রয় নেন তা হলো, ‘এই নির্দেশগুলো ছিল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে’, যা একেবারেই মিথ্যা! মক্কায় তখন কোনো যুদ্ধ ছিল না, ছিল হজ (কুরান: ৯:৩); ইসলামে কোনো কোমল, মডারেট বা উগ্রবাদী শ্রেণী-বিভাগ নেই; ইসলাম একটিই আর তা হলো ‘মুহাম্মদের ইসলাম’।’ আলী ইবনে আবু তালিব মারফত সুরা তওবার ঐ ঘোষণাটি দেয়া হয়েছিল তাবুক যুদ্ধের (অক্টোবর, ৬৩০ সাল) পাঁচ মাস পর!
মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের (৭০৪-৭৬৮ সাল) বর্ণনা পুনরারম্ভ: [1] [2] [3]
পূর্ব প্রকাশিতের (পর্ব- ১১১) পর:
আল-যুহরির অব্যাহত বর্ণনা: ‘যখন আল্লাহর নবী উসফান (Usfan) নামক স্থানে ছিলেন, বিশর বিন সুফিয়ান আল-কাবি তাঁর সঙ্গে দেখা করে ও বলে, “কুরাইশরা আপনার আসার খবর জানতে পেরেছে ও তারা তাদের দুধেল উটগুলো [4] সঙ্গে নিয়ে চিতাবাঘের চামড়া পরিধান করে বাহির হয়ে এসে ধু তুওয়া (Dhu Tuwa) নামক স্থানে শিবির স্থাপন করছে ও প্রতিজ্ঞা করেছে যে, তারা আপনাকে কোনোভাবেই মক্কায় ঢুকতে দেবে না [5]। খালিদ বিন আল-ওয়ালিদ তাদের অশ্বারোহী সদস্যদের সাথে আছে, যাদেরকে তারা সম্মুখে ‘কুরাল-ঘামিম’ নামক স্থানে পাঠিয়েছে [পর্ব: ৯৬]। (অন্য এক উৎসের রেফারেন্সে আল তাবারী বর্ণনা করেছেন যে, খালিদ বিন আল-ওয়ালিদ মুসলমান হিসাবে ঐ দিন আল্লাহর নবীর সঙ্গে ছিলেন [পর্ব- ১১২])।
আল্লাহর নবী বলেন, “কুরাইশদের দুর্ভাগ্য, যুদ্ধ তাদেরকে সাবাড় করে ফেলেছে! তাদের কী এমন ক্ষতি হতো যদি তারা আমাকে ও বাকি আরবদেরকে আমাদের মত ছেড়ে দিতো যেন আমরা আমাদের নিজস্ব উপায়ে এর সুরাহা করতে পারি? যদি তারা আমাকে হত্যা করে তবে সেটাই তো তাদের ইচ্ছা; আর যদি তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ আমাকে বিজয়ী করে, তবে তারা দলে দলে এসে ইসলামে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যদি তারা তা না করে, তবে যতক্ষণ তাদের শক্তি আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা যুদ্ধ করবে, সুতরাং কুরাইশদের চিন্তার কী আছে? আল্লাহর কসম, আল্লাহ আমার ওপর যে-দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে, তাতে আমার বিজয় অর্জন অথবা ধ্বংস হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমি এই যুদ্ধ বন্ধ করবো না।” অতঃপর তিনি বলেন, “কে আছো এমন, যে আমাদেরকে ভিন্ন পথে বাইরে নিয়ে যাবে, যাতে আমাদেরকে তাদের সম্মুখীন হতে হবে না?”
‘আবদুল্লাহ বিন আবু বকর আমাকে বলেছেন যে আসলাম গোত্রের এক লোক এ কাজে স্বেচ্ছায় রাজি হয় ও তাদেরকে এবড়োখেবড়ো পাথুরে গিরিপথের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়, যা মুসলমানদের জন্য ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। যখন তারা তার মধ্য দিয়ে পাথুরে নদী খাতের শেষ প্রান্তে ভাল রাস্তায় বের হয়ে আসে, আল্লাহর নবী তাঁর লোকজনদের বলেন, “বলো, আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করি ও তার কাছেই অনুশোচনা প্রকাশ করি।” তারা তাই করে, অতঃপর তিনি বলেন, “এটিই হলো আমাদের “পাপ নির্বাণ” (অর্থাৎ, ‘যা আমাদের পাপ কাজ মোচন করে’-কুরান ২:৫৮ ও ৭:১৬১), যা ইসরাইলের সন্তানদের জন্য ছিল আদেশ; কিন্তু তারা এই কথাগুলো বলেনি।” [6]
আল্লাহর নবী তাঁর দলের লোকদের ডান দিকে ঘুরে লবণাক্ত পাতা যুক্ত ঝোপঝাড়ের (salt bush) ভেতর দিয়ে আল-মুরার (al-Murar) গিরিপথের পাশ দিয়ে মক্কার নিম্নভাগে হুদাইবিয়ার ঢালু পাড়ে যাওয়ার হুকুম করেন। তারা তাই করে। যখন কুরাইশ অশ্বারোহী সদস্যরা ধুলা-ভর্তি রাস্তা দেখে জানতে পারে যে, তারা তাদের পথ পরিবর্তন করে অন্য পথে চলে গিয়েছে, তারা তাদের অশ্ব দ্রুতবেগে চালনা করে কুরাইশদের কাছে ফিরে আসে।
আল্লাহর নবী আল-মুরার গিরিপথ পর্যন্ত গমন করেন ও যখন তার উটটি বসে পড়ে তখন লোকেরা বলে, “উটটি আর উঠে দাঁড়াবে না”, তিনি বলেন: “এটি তা করতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করেনি ও এটি এর স্বভাব নয়, কিন্তু যে-সত্তা মক্কায় হাতিকে সংযত করেছিল, সেইই এটিকে ফিরিয়ে রেখেছে [7]। আজ কুরাইশরা যে-শর্তই নির্ধারণ করে আমার কাছে আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দয়া প্রদর্শনের জন্য বলবে, আমি তাতে সম্মত হবো।”
অতঃপর তিনি লোকদের অবতরণ করতে বলেন। তারা তাতে আপত্তি করে এই বলে যে, সেখানে কোনো পানির ব্যবস্থা নেই যার পাশে তারা সাময়িক ভাবে থামতে পারে। তাই তিনি তাঁর তূণী থেকে একটি তীর (পর্ব-১১২) বের করে তা তাঁর এক অনুসারীকে দেন, তাঁর সেই অনুসারী সেটি নিয়ে নিচে নেমে আসে ও সেখানকার এক পানির গর্তে তা দিয়ে খোঁচা মারে; অতঃপর সেখান থেকে পানি উঠতে থাকে যতক্ষণে না লোকদের উটগুলো পানি পানে পরিতৃপ্ত হয় ও সেখানে শুয়ে পড়ে।
বানু আসলাম গোত্রের এক লোক আমাকে বলেছে যে, যে-ব্যক্তিটি আল্লাহর নবীর তীরটি নিয়ে গর্তের কাছে গিয়েছিল, তার নাম নাজিয়া বিন জুনদুব বিন উমায়ের বিন ইয়ামার বিন দারিম বিন আমর বিন ওয়ায়েলা বিন সাহম বিন মাযিন বিন সালামান বিন আসলাম বিন আসলাম বিন আফসা বিন আবু হারিথা, যে আল্লাহর নবীর কুরবানির উটগুলো চড়িয়ে নিয়ে আসছিলো। এক বিদ্বান ব্যক্তি আমাকে বলেছে, আল-বারাহ বিন আযিব যা বলতো তা হলো, এই যে সেইই ছিল ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহর নবীর তীরটি নিয়ে নিচে নেমে এসেছিল; আল্লাহ জানে কোনটি সত্যি। বানু আসলাম গোত্রের লোকেরা যে-কবিতার পঙক্তিগুলো উদ্ধৃত করেছিল, তা ছিল নাজিয়ার রচিত। আমরা মনে করি যে, ব্যক্তিটি ছিল সেইই [নাজিয়া], যে তীরটি নিয়ে নীচে নেমে এসেছিল। বানু আসলাম গোত্রের লোকেরা ঘোষণা করে যে, আনসারদের এক ক্রীতদাসী তার এক বালতি নিয়ে ওপরে উঠে এসেছিল, যখন নাজিয়া ঐ কুপটি থেকে পানি উঠিয়ে লোকদের সরবরাহ করছিল।’
– অনুবাদ, টাইটেল, ও [**] যোগ – লেখক।]
>>> ইসলাম বিশ্বাসী পণ্ডিত ও অপণ্ডিতরা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ও তাঁর অনুসারীদের এই হজ যাত্রায় কুরাইশদের এই বাধা প্রদানকে কুরাইশদের বর্বরতার এক উদাহরণ হিসাবে চিহ্নিত করে আসছেন। কী কারণে কুরাইশরা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের মক্কা শহরে প্রবেশে বাধা প্রদান করেছিলেন তার আলোচনা ইতিপূর্বেই করা হয়েছে (পর্ব: ১১১-১১২)।
প্রশ্ন হলো:
হুদাইবিয়া সন্ধি বর্ষে (মার্চ, ৬২৮ সাল) মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের হজব্রত পালনে সাময়িক বাধা প্রদান (শুধু ঐ বছরের জন্য) করাকে যদি কুরাইশদের বর্বরতার এক উদাহরণ হিসাবে ভূষিত করা হয়, তবে কুরাইশদের ওপর বিজয়ী হওয়ার পর এক বছরের মাথায় যে-ব্যক্তি জগতের সকল মুশরিকদের “অপবিত্র (৯:২৮)” ঘোষণা দেন; তাঁদেরকে এক নির্দিষ্ট সময়ের আল্টিমেটাম (চার মাস অথবা পূর্ব-চুক্তির মেয়াদ সম্পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত) প্রদান করেন এবং সেই নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর “তাঁদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যা করা হবে” আদেশ জারী করে (৯:৪-৫) তাঁদের শত শত বছরের পবিত্র তীর্থভূমি জোরপূর্বক করায়ত্ত করে সেই তীর্থস্থানটি তাঁদের জন্য চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ করেন, সেই ব্যক্তি ও তাঁর কর্মের বৈধতা প্রদানকারী মানুষদের কীরূপ বিশেষণে ভূষিত করা উচিত?