কন্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে

লেখক: প্রীতম চৌধুরী

(১)
২০১১ সাল।
কলেজ ছাত্র তখন। ফেব্রুয়ারি মাসের একটি দিনও বাদ যায়নি যে আমি বইমেলায় যাইনি।
তাই ২০১১ সালের কথা আমি ভালো বলতে পারবো।

তখনও বইমেলা শুধু বাংলা একাডেমির মধ্যেই ছিলো।
২০১১ সালের বইমেলায় সবচেয়ে প্রচারিত বই কোনটি জানেন?
‘দাজ্জাল’
টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত মাঝের রাস্তাটাতে কমপক্ষে ২০ জন ব্যক্তি দাজ্জালের প্রচারণা করেছে।
দাজ্জাল বইটি কেউ পড়েছেন কিনা জানি না, বইটা নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরীরের প্রকাশনা। মূলত আধুনিক সভ্যতাটারেই এককথায় দাজ্জাল হিসেবে বর্ণণা করে এর বিরুদ্ধে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করাই ছিলো বইয়ের উদ্দেশ্য।

সে কথা বাদই দেই। বইমেলার মধ্যে বিভিন্ন বইয়ের প্রচারণামূলক লিফলেট বিলি করা হয়। ঢোকার সময় না দেখে সব লিফলেটই নিতে নিতে ঢুকি, পরে ওইগুলা দিয়ে কাগজের প্লেন বানাই।
একবার দেখি ওই লিফলেটগুলোর মধ্যে হিজবুত তাহরীরের লিফলেটও চলে আসছে একটা। অর্থাৎ কিনা একটা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন এইরকম একটা রাষ্ট্রীয় মেলার মধ্যে তাদের লিফলেট বিলি করে যায় নির্বিঘ্নে।

সেও বাদ দিলাম। বইমেলা হওয়া উচিত শুদ্ধ জ্ঞানের প্রতিক। সেই বইমেলাতে ঢোকার পথে যখন একের পর এক দেখতে থাকি কুসংস্কারের ডিব্বা ভরা বই, আমার হাত নিশপিশ করতে থাকে ওগুলো ছিঁড়ে কুটিকুটি করার জন্য। তবে এগুলোতে কোন উষ্কানীমূলক কিছু নয়।

(২)
গতবারের বইমেলার সময় শুধু অভিজিৎ রায়কেই হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে একটি অধিকারকে। সেই অধিকার হল মত প্রকাশের অধিকার। মত প্রকাশের অধিকার নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা যদি এই অধিকারকে নিশ্চিত না করে তাহলে বুঝতে হবে সেই স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়নি। বইলেখার জন্য আমাদের দেশে লেখকেরা আগেও বিপদগ্রস্ত হয়েছেন। বৃটিশ যুগে কাজী নজরুল ইসলাম যখন লিখতেন, তখন তার বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কারারুদ্ধ করা হতো। কিন্তু কিছুদিন বাদেই তিনি বীরের মত বেরিয়ে আসতেন। তাকে প্রাণে হত্যা করতে হবে এমন কথা ঔপনিবেশিক সরকার কল্পনা করেনি। পাকিস্তান আমলে নিশ্চয়ই অবস্থা আরো খারাপ ছিলো। কিন্তু লেখকের প্রাননাশের চেষ্টা সেকালেও হয়নি।

কিন্তু লেখালেখির অপরাধে ধর্মান্ধরা যখন তসলিমা নাসরিনকে তলোয়ার নিয়ে ধাওয়া করেছিল, রাষ্ট্র তাদের নিবৃত্ত করেনি, বরং রাষ্ট্র তাদের পরোক্ষ প্রশ্রয় দিয়েছে। ড. আহমদ শরীফকে মুরতাদ ঘোষণা করে তার বাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করেছিল। রাষ্ট্র তখনও মুখে কুলুপ এটে ছিলো। কবির চৌধুরীকে যখন মুরতাদ বলা হয়, কবি শামসুর রহমানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তার বাসায় হামলা চালানো হয় কুলুপ এটেছিল; কুলুপ এটেছিলো ড. হুমায়ুন আজাদকে যখন হত্যা চেষ্টা করা তখনও।
সর্বশেষ অভিজিৎ রায় হত্যা। রাষ্ট্রের মুখের কুলুপ খোলেনি।

তবে রাষ্ট্র পর্যাপ্ত দাপটে ছড়ি ঘোরায় ওই লেখকদের প্রতি। ছড়ি ঘুরিয়ে বলে, কোন অনুভূতিতে আঘাত দেয়া যাবেনা। কোন বই লেখা যাবেনা, কোন বই ছাপানো যাবেনা, কোন বই পড়া যাবেনা। বাংলা একাডেমি মুখের কুলুপ খুলে প্রচন্ড প্রতাপে খেঁকিয়ে ওঠে রোদেলার উপর, কেন তারা বই ছাপায়? তারা প্রকাশকদের সাবধান করে দেয় যেন কোথাও কোন ধর্মীয় উষ্কানিমূলক লেখা না থাকে।

যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের সবার ভাবখানা এমন থাকে যে লেখকেরাই সকল কিছুর মূল, তাদের দমন করতে পারলেই যে সামান্য সমস্যা হচ্ছে তাও আর থাকবে না, তখন আমার মত অভাজন রবিঠাকুরের কাছে আশ্রয় নিয়ে শুধায়,

” কন্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা,
অমবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপ্নের তলে।
তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে—
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো? “