লেখকঃ সৌমিত্র
কিংবদন্তীতুল্য সেতার বাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর লিখেছেনঃ
“মা আমার হাতটা বাবার হাতে দিয়ে বললেন, “বাবা, আপনাকে একটা কথা বলব?”
‘বলেন মা বলেন’, বাবা তো একেবারে অস্থির হয়ে গেলেন— আদেশ করেন
‘না, আপনি তো জানেন, এর বাবা মারা গেছেন— বড় দুরন্ত ছেলে, এখন তো কেউ নেই। আপনি একটু দেখবেন একে। ভুলটুল মাপ করে দেবেন।’
বাবা একেবারে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন— মা আপনে বলসেন কী, আপনে রত্নগর্ভা — আজ থিক্যে আলি আকবর আমার ছোট ছেলে— রবু (পণ্ডিত রবিশঙ্করের ডাক নাম) আমার বড়ো ছেলে। আপনায় কথা দেলাম।
মা আর বাবার সঙ্গে সঙ্গে আমিও কেন জানি না, ভেউ ভেউ করে কাঁদছি— বড় বিশ্রী পরিস্থিতি।”
শৈশবেই পিতাকে হারানো রবিশঙ্করের “বাবা” হলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। সারা বিশ্বে তাঁর পরিচয় “সেতার, সানাই এবং রাগ সঙ্গীতের গুরু।” শুধু রবিশঙ্কর কেন, প্রতিটা শিষ্যই তাদের প্রিয় এই গুরুকে ‘বাবা’ ডাকতেন।
প্রখ্যাত সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ জন্মেছিলেন আমাদের মাটিতে— ব্রাক্ষণবাড়িয়ার শিবপুর গ্রামে। সেই গ্রাম ছেড়ে এসে কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার নুলো গোপালের কাছে গান, লোবো মাস্টারের কাছে বেহালা, এক স্থানীয় আর্টিস্টের কাছে ক্ল্যারিনেট, ওস্তাদ হাজারি খানের কাছে সানাই, তারপর নানা জনের কাছে মৃদঙ্গ শিখেছেন। ওস্তাদ আহমেদ আলির সরোদ শুনে মুগ্ধ হয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন উনার কাছেই সরোদ শিখবেন। সেই পর্ব শেষ করে রামপুরের কিংবদন্তি ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর কাছে শিখেছেন সরোদ, সুরশৃঙ্গার আর রবাব। ওয়াজির খাঁ প্রথমে শিষ্য হিসাবে নিতে রাজি ছিলেন না, আলাউদ্দিন খাঁর চাপাচাপিতে অতিষ্ঠ হয়ে বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে তুমি আমার চাকর হও’। বাড়ির কাজকর্ম করার মাঝে তিনি মনোযোগ দিয়ে গুরুর সরোদ বাজানো শুনতেন। তবে তাঁর বাদ্যযন্ত্র স্পর্শ করার অনুমতি ছিল না। দুবছর পর ওয়াজির খাঁ তাঁকে শিষ্য করে নিয়েছিলেন।
১৯৫৬ সালে আলাউদ্দিন খাঁ বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নিজ জন্মস্থানে আসেন। স্থানীয় জমিদারের কাছ থেকে একটা বাড়ি উপহার পেয়েছিলেন। সে বাড়িটাতে স্থাপন করা হয়েছিল সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন। ভবনের ভিতর ছোট্ট একটা মিউজিয়ামে সাজানো ছিল সরোদ, বেহালা, সন্তুর, ব্যাঞ্জো, সারেঙ্গি আর উনার হাতে লেখা চিঠি এবং অনেক আলোকচিত্র। গত ১২ জানুয়ারি জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার ছেলেরা সংগীতাঙ্গন ভাংচুর করে উনার স্মৃতি বিজড়িত সব বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে দিয়েছে। নিচের এই ছোট ভিডিওটাতে আমাদের ঐতিহ্যের পুড়ে যাওয়া ছাই দেখতে পাবেনঃ
বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ছিল বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ২০০১ সালে তালিবান নেতা মোল্লা ওমরের নির্দেশে পাহাড়ের গায়ে ডিনামাইট বিস্ফোরণে বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করা হয়। পৃথিবী থেকে মানব সভ্যতা এবং ঐতিহ্যের এক নিদর্শন চিরতরে হারিয়ে গেল। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ আমাদের ঐতিহ্য। আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে জন্ম নেয়া সুর এই সম্রাটকে ভুলে গিয়েছিলাম। তবে হামলাকারীরা কিন্তু ভুলে যায় নাই। তাঁরা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’কে চেনে! তাই পরিকল্পিতভাবে বাদ্যযন্ত্রে আগুণ দিয়েছে— আমাদের ঐতিহ্যকে পুড়িয়ে দিয়েছে।
২০০৮ সালে আমরা দেখেছি মাদ্রাসা ছাত্রদের হুমকির মুখে বিমানবন্দরের প্রবেশ মুখে নির্মানাধীন “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি” ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়। বিমানবন্দরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং দেশের লোকায়ত শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি বিদেশীদের আকৃষ্ট করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। মৌলবাদীদের তাণ্ডবের কারণে সেটি সম্ভব হলো না। খতমে নবুওয়াত মাদ্রাসা ও মূর্তি প্রতিরোধ কমিটি নামের সংগঠনের হুমকির মুখে এ ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়। মাত্র একমাস আগেই চুয়াডাঙ্গার বাউল উৎসবে দুই শতাধিক বাউলের সমাবেশ ঘটেছিল। উৎসবস্থলের কাছে অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজক জাকারিয়া হোসেনকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়েছিল। রাতভর গান শেষে উৎসব শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাতের খুনের ঘটনার পর গানবাজনা বন্ধ হয়ে যায়। ভাস্কর্য ভাঙ্গা- বাউল মেলার আয়োজক হত্যা- বাদ্যযন্ত্র পোড়ানো… এ সমস্ত ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়, সব একই সূত্রে গাঁথা।
একাত্তরে শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সচেতনতা এবং তহবিল ত্রাণ প্রচেষ্টা বাড়াতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্য পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং সন্তান ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ সহ অন্যরা মিলে সৃষ্টি করেছিলেন “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” নামের ইতিহাস। ৪০,০০০ দর্শকের এই কনসার্ট আয়োজনের শক্তি ছিল বাংলা সংস্কৃতির প্রতি এদুজনের অগাধ এবং অকৃত্রিম ভালোবাসা। দুজনেই মৃত; তাই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রিয় গুরুর বাদ্যযন্ত্র পোড়ানোর সংবাদে উনাদের প্রতিক্রিয়া আমাদের পড়তে হবে না। টাইমস অব ইন্ডিয়াতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র নাতি সরোদ শিল্পী ওস্তাদ আশীষ খাঁ বলেছেন “ঘটনাটা খুব লজ্জাজনক। বাংলাদেশ আমার দাদুকে কখনো প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয় নাই। সব বাদ্যযন্ত্র পুড়ে গেছে। আমি কষ্ট পেয়েছি। এদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর আইনী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।”
ভাগ্যিস রবিশঙ্কর-আলি আকবর খানের কাছে খবরটা পৌঁছাবে না! আমরা বেঁচে গেছি, না হলে লজ্জায় মুখ লুকাতে হত! অবশ্য যদি লজ্জা নামক বস্তুটা আমাদের মধ্যে থাকে…