মৌলবাদী (ইসলামি) বিষবৃক্ষের স্বরূপ সন্ধানঃ পাকিস্তানি পর্ব

লেখক- অজ্ঞাত
আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে যখন আমাদের একাত্তরের সেক্যুলার সংবিধান স্বৈরাচার আর মিলিটারিতন্ত্রের কাছে বার বার সম্ভ্রম হারাচ্ছিল, যখন আমাদের মিলিটারিজান্তারা রাষ্ট্রকে নিজেদের উপনিবেশ ভেবে হিরক রাজার ভাবাদর্শে সংবিধানের মূল স্তম্ভসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ধর্ম এবং মিলিটারিতন্ত্রের ছাপ একে দিচ্ছিল, আমাদের ইসলামী মৌলবাদের বীজটা তখনি স্মিত হেসে আড়মোড়া ভাঙ্গার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল ! এর আগে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শেষে আমরা মৌলবাদের বীজটাকে প্রায় নির্বিজ করে ফেলেছিলাম | সেটি হয়েছিল বাংলাদেশের সেক্যুলার সংবিধানের চাপে, আর ইসলাম রক্ষার নামে পাকিস্তানের “পোড়ামাটি নীতি”- প্রসূত বাঙালি নিধন যজ্ঞে জনমনে কালেকটিভ শক এবং শোক এর ফলে | আমাদের অনেকে পাকিস্তানের ইসলাম রক্ষার জজবা মেনে নেইনি, আমরা আমাদের ভাই, বোন, প্রতিবেশী, এবং সন্তান হত্যাকে ইসলাম ধর্মের নামে হালাল করার মত (যুক্তিসংগত ভাবেই) মৌলবাদী হয়ে উঠিনি |
ক্রুর ইসলামী মৌলবাদের বীজ এর আগে আমাদের অনেকটা গ্রাস করেছিল | সেটি ছিল ব্রিটিশ নীতির প্রত্যক্ষ মদদে “লড়কে-লেঙ্গে- পাকিস্তান” নামের রাজনৈতিক আন্দোলেনের রাহু গ্রাসে | আমরা আমাদের রাজনৈতিক ধর্মাবতার জিন্নাহকে ভারতবর্ষের “সালাদিন” ভেবে আপ্লুত হয়েছি, আর ইসলামী জোসে মহাত্মা গান্ধীর ছাগলের উপর ঝাপিয়ে পরেছি এই ভেবে যে বিধর্মী গুরুর ছাগল হত্যার মাধ্যমে আমরা ইসলামের ঝান্ডা সমুন্নত রাখব! আমরা বাঙালিরা কেন পাকিস্তানের জন্য হামলে পরেছিলাম? জিন্নাহ এবং গংরা আমাদের বুঝিয়েছিল, পাকিস্তান হলে আমাদের এখানে দুধের নহর বইবে, পাকিস্তান না হলে হিন্দুদের পদতলে সাষ্টাঙ্গে প্রনাম করে আমাদের “কর্তাভজা” থাকতে হবে | একথাও সত্য যে মৌলবাদী হিন্দুরা জাতপাতের দোহাই আর আমাদের “অচ্ছুত” গণ্য করে সেক্যুলার বাঙালি কৃষকের ধর্মচেতনার স্ফুলিঙ্গকে জাগিয়ে রেখেছিল | সেটি কতটুকু ধর্মের আরে কতটুকু শ্রেণী শোষণের সে তর্ক পন্ডিতরা করে যাচ্ছেন | আমার মত অকিঞ্চিতের ভাবনা হলো, ধর্ম এবং শ্রেণীস্বার্থ যখন একে অপরের পরিপূরক হয়, তখন সেটি সব চাইতে ধংসাত্মক এবং অমানবিক হয় | যাই হোক, সেক্যুলার বাঙালির ধর্মচেতনার স্ফুলিঙ্গে যখন জিন্নাহ ধর্মের স্পিরিট ঢেলে আর জাগতিক দুধ-প্রাপ্তির আশায় দোলা দিলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” কায়েম করার জন্য হামলে পড়ল |
আমরা বাঙালিরা পাকিস্তান পেয়েছি কোনো প্রকার ত্যাগ শিকার না করে | না ধর্মের, না পেশার, না ভূমির, না সংস্কৃতির | যখন ভারত-পাকিস্তান বিভাজনে, নিকট ইতিহাসের সব চাইতে বড় সহিংস মাইগ্রেশনএ ১৫ মিলিয়ন বাস্তচ্যুত এবং এক থেকে ২ মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়েছে, আমরা আমাদের ভূমিতেই ছিলাম, আমাদের কোথাও যেতে হয়নি | বরং, উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত হিন্দুরা যখন ভয়ে এবং ধর্মস্বার্থে, নিজ জন্মভূমি (বাংলা) ছেড়ে মুক্তকচ্ছ হয়ে কলকাতার দিকে দৌড় দিলেন, আমরা অনেকে তাদের ফেলে যাওয়া ভূমি, পেশা, স্থান দখল করে, জিন্নাহর “দুধ নহর” উপভোগ করে ইসলামের সালাদিন হয়ে ভারত বধে আমাদের পাকিস্তানি বেরাদেরাণ-এ-মিল্লাত এর সাথে একাট্টা হলাম | আমাদের তখনকার রাজনৈতিক শ্রেনীর বিবর্তন লক্ষ্য করলেই এই বিষয়টি স্পষ্ট হবে | আমরা যারা মৌলবাদের উত্স সন্ধান করি, তারা আমাদের নিকট-ইতিহাসের এই দিকটা প্রায়ই ভুলে যাই যে ভারত-পাকিস্তান বিভাজন আমাদের এই দেশের মৌলবাদের প্রথম বিষবৃক্ষ | যাই হোক, পাকিস্তান কিন্তু কখনো আমাদের “বেরাদেরাণ-এ-মিল্লাত” এ সমঅধিকার এ বিশ্বাস করেনি | তাদের কাছে আমরা হার্জির্জিরে, ভেতো, জলাভূমির মানুষ – ইসলামে জয় করা দাসদের মতোই | তার ফলাফলই হলো এই যে তারা আমাদের বাংলা ভাষাকে (যেটি সংস্কৃত ভাষার অপভ্রংস)হিন্দুতন্ত্রের প্রতিক বিবেচনায় উপরে ফেলে উরদু (Urdu)- যেটির শব্দাবলী আরবি এবং পার্সিয়ান প্রধান – তা দিয়ে আমাদের আমাদের নিম্নবর্ণের মুসলমানিত্বর গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়ে ছওয়াব হাসিল করার প্রতিজ্ঞা করল ।
বাঙালি মধ্যবিত্তের সন্তান, যারা প্রথম পুরুষ উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যান্য উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রে, তারা পাকিস্তানের সুবিধাভোগী সিভিল এবং সামরিকতন্ত্রের ইসলামিকরণের চেষ্টায় উর্দুর আধিপত্য মেনে নেয়নি | এর মাঝে তারুন্যের বিদ্রোহ ছিল, সেক্যুলার শিক্ষার প্রভাব ছিল, ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের চিন্তার প্রথম প্রকাশ ছিল | সব চেয়ে গুরত্বপূর্ণ দিকটা হলো, আমাদের তরুণ বাঙালি ছাত্ররা প্রভাবিত হয়েছিল দুটো ধারা থেকে | উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে কলকাতা-কেন্দ্রিক সেক্যুলার বাঙালি রেঁনেসার উপজাত হিসেবে শিক্ষিত তরুনরা (মূলত হিন্দুরা ) যারা পূর্ববাংলায় শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন, তারা বাঙালি মুসলমানের মানসে সেকুলারিজমের বীজ বপন করেছিলেন| তার প্রভাবে আমাদের বাংলায় ৫০ এবং ৬০ এর দশকে একধরনের মিনি রেনেসার জন্ম হয়েছিল | এটি আমাদের পাকিস্তানি ইসলামিকরণের বিরুদ্ধে “ফুট সৌল্জার” যোগান দিয়েছে | সেইসাথে মার্ক্সবাদি রাজনীতির প্রসারের ফলে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে তরুনদের যুদ্ধের একটা বড় বিকল্প তৈরী হয়েছিল | এর প্রভাবে আমাদের তরুণ ছাত্ররা মৌলবাদকে প্রত্যাখান করেছিল |
ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে বাঙালির লড়াইয়ে আমরা ভাষা আন্দোলনের কথা বলি, মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রতিবাদের কথা বলি | কিন্তু মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের নিম্নশ্রেনীর (মূলত কৃষক) কোনো ভূমিকা আমরা আলোচনায় শুনিনা | বাংলার কৃষক মৌলবাদের সাথে প্রতিকী লড়াই করেছে বহু শতাব্দী ধরে | অনেক সময় তারা বিভ্রান্ত হয়েছে, কিন্তু মৌলবাদের কাছে তারা সমর্পণ করেনি । অনেক সময় সেটি প্রকাশ পেয়েছে আশরাফ-আতরাফ লড়াই এ, অনেক সময় প্রতিকী, অনেক সময় ভাষায় | আমরা কতজন জানি যে নেত্রকোনার বাউল জালাল উদ্দিন খান মোল্লাদের প্রকাশ্যে বাহাসের আহ্বান জানিয়েছিল খোদার অস্তিত্বের অসারতা প্রমানে? “মানুষ থুয়ে খোদা ভজা” যে অসার, তা প্রমানে জালাল, লালন সহ হাজার বাউল এবং তার অনুসারী অশিক্ষিত (!)(আসলে স্বশিক্ষিত) কৃষকের চেষ্টা মৌলবাদের বিষবৃক্ষকে কখনো গ্রাম সংস্কৃতিতে খুটি গাড়তে দেয়নি |
যদি ছাত্র, কৃষক, আর শ্রমিকরা যদি তদকালীন পাকিস্তানে মৌলবাদী ইসলামী বিষবৃক্ষের বিরোধিতা করেছিল, তাহলে কারা এই বিষবৃক্ষকে সযত্নে লালন করেছে? কারা এই বিষবৃক্ষকে প্রথম সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রশ্রয় দিয়েছে? দুর্ভাগ্য হলেও সত্য হচ্ছে এরা তারাই যারা ছিল সদ্য “জাতে” উঠা হিন্দু সম্পত্তি দখলকারী নব্য ইসলামবাদী মুত্সুদ্দির একটা অংশ, যারা নব্য মধ্যবিত্তে অটোপ্রমোশন পেয়েছিল| এদের ধর্ম চেতনার চেয়ে বৈষয়িক চেতনা ছিল ক্ষুরধার, ধর্মকে চটকে ঘি-টা, মোরগ-টা খাওয়ার বাসনা ছিল লালসালুর মজিদ এর দ্বিতীয় দ্বার পরিগ্রহের মত সুতীব্র | হিন্দুরা চলে যাওয়ায় তারা গুরুত্বহীন মুত্সুদ্দী থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার আনন্দে তারা হঠাত ধর্মের (ইসলামী মৌলবাদের) গুরুত্ব আবিস্কার করে তা রক্ষায় মুখে ফেনা তুলে ফেলল, ধনুর্ভঙ্গ পন করল | এরা রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ক্ষমতা উপভোগে মত্ত হলো |মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, আমাদের মত স্বার্থপর মধ্যবিত্তই মৌলবাদের বিষবৃক্ষকে প্রথম বরণ করেছিল, এখনো লালন করছে |
আরেকটা বর্বর শক্তি এর আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত সাহায্য করেছে, সেটি হচ্ছে, পাকিস্তানের নষ্ট মিলিটারিতন্ত্র | এর মত নষ্ট প্রতিষ্ঠান আর একটি নেই, যেখানে অর্ধশিক্ষিত নষ্টরা বন্দুকের জোরে আমাদের কৃষক, শ্রমিক, জনতার অধিকারকে, সংবিধান এর প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে বলাত্কার করেছে, আবার বুক চিতিয়ে আমাদের পরম রক্ষাকর্তার ভেক ধরেছে | এই নষ্টরা পাকিস্তানের ক্ষমতায় থাকার জন্য ধর্মের জজবাকে কাজে লাগিয়েছে, আমাদের (বাংলার) নব্য মৌলবাদের সাথে আতাত করে, “ইসলাম গেল”, “ইসলাম গেল” বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে | মিলিটারিতন্ত্র হচ্ছে গ্রিক মিথলজির সাগর দেবতা প্রতিউস এর মত বহুরূপী – প্রয়োজনে বদলে যায় প্রতি মুহুর্তে | এরা পাকিস্তান রাজনীতিতে বদলে গিয়েছে প্রতিবারই | শুরুতে সিভিল রাজনীতিকে “বিপদজনক” বলে পাকিস্তানের “সংহতি” রক্ষার নাম জনগনের উপর সিন্দাবাদের ভুতের মত যেই একবার চেপে বসেছে, সেখান থেকে আর কোনদিন নামেনি পাকিস্তান ভেঙ্গে না যাওয়া পর্যন্ত |
কাজেই ইসলামী মৌলবাদের বাংলা ভার্সন এর আদি বীজ আমাদের মধ্যবিত্তের একটা নষ্ট অংশের শ্রেণীস্বার্থ ধরে রাখার হতচেষ্টার মাঝে ছিল | পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পর সেই বিষবৃক্কের নির্বিজিকরণ হয়েছিল | সেটি কিভাবে মাথাচাড়া দিল এবং কেন আবার গর্জে উঠলো দানবের সহিংসতায়, সে গল্প অন্যদিন |

লেখাটি অনন্ত বিজয় দাস এর জন্য উৎসর্গিত |
বিজয়, তুমি চলে গিয়ে আমাকে আবার কলম ধরিয়েছ |