মুক্ত চিন্তা, জন্মধর্ম এবং মডারেট বোকামী

লেখকঃ স্বচ্ছ আহমেদ
আমি একজন মুক্তমনা। হাঁ আমি এখন সম্পূর্ণ মুক্ত মনা – যখন বয়স আমার চল্লিশ ছুই ছুই।
কেন? একটা প্রধান কারণ – অভিজিৎ দার মৃত্যু। অভিজিৎদার মৃত্যুতে ভাবলাম (তাকে আমি আগে থেকে চিন্তাম না) আচ্ছা দেখি একটা তার বই পড়ে। পড়লাম অবিশ্বাসের দর্শন, পরলাম বন্যা আহমেদ এর বিবর্তন নিয়ে বই টা। এর পরে কি হল?
তা পরে বলি। প্রথমে নিজের কিছু হিস্ট্রি বলার ইচ্ছাটা দমাতে পারছিনা।
আমার জন্ম মুসলিম পরিবার এ – মডারেট বলা যায়। বাবা মা ধর্মপ্রাণ হলেও কখনও আমার বা আমার ভাই বোনদের উপরে ধর্ম নিয়ে কোন জোর জবরদস্তি ছিলনা। ক্লাস ৭-১০ পর্যন্ত আমি খুব ধর্ম প্রান ছিলাম – উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় – আমি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম, তার মধ্যে ৪ বেলা মসজিদে গিয়ে। সোমবার থেকে রবিবার কিছু বিশেষ অতিরিক্ত নামাজও পড়তাম। এতটাই নেশা ছিল যে আমি এক সময় মসজিদে ইমামের পিছিনে দাঁড়াতাম, এতে সেই মসজিদের মুয়াজ্জিন একবার বেশ চেতে গিয়েছিল।
ধর্মীয় বই পড়া নেশা হয়ে গিয়েছিল – যেমন নেয়ামুল কোরান আর মক্সুদুল মুমিনিন। অস্বীকার করবনা যে কিছু এডালট অংশ বার বার পড়তাম তবে জান্নাতের আরাম শুনে মাথা বারবার খারাপ হয়ে যেত। যাই হোক তখন আমাকে সবাই আদর্শ ছেলে বলেই জানত – পারিবারিক ভাবে আর ইস্কুলে। শিক্ষকরা আমার উদাহরণ টেনে অন্য ছাত্রদের নিয়মিত নামাজ পড়ার উপদেশ দিতেন। 
আরজ আলি মাতুব্বর এর সত্যের সন্ধানে বই টা আমার পরার সুযোগ হয়েছিল ইন্টারমেডিট পরার সময় – যদিও ওই বয়েসে বইটা ঠিক মাথায় হিট করেনি। ঠিক কি কারনে নামাজ পরা ছেড়ে ছিলাম টা মনে নেই – সম্ভবত আলসেমি করেই, কিংবা পড়াশুনার চাপে। এরপর আমি কখনওই আর নিয়মিত নামাজ পড়িনি, শুধু বছরে ২ বার ঈদের নামাজ ছাড়া (তাও আবার মাঝে মাঝে আলসেমি করে ঈদের দিনেও মসজিদে যেতাম না)। রোযা কবে ছেড়েছি তাও মনে নেই। দেশে থাকতে তাব্লিগের অত্যাচারে বিরক্ত ছিলাম এবং আমি কখনই ওদের সাথে রাস্তায় নেমে পড়িনি – বলতাম আপন্সরা যান আমি পরে মসজিদে ছলে আসছি – যদিও যাইনি কখনও। (দেশ ছাড়ার আগে অবশ্য জানতাম না যে বিদেশেও এই তাব্লিগ প্রবলেম আছে হাহা!)।
আমি আমার সারা জীবন সেকুলার মাউণ্ডেড ছিলাম – আমার যেমন কাছের মুসলমান বন্ধু ছিল তেমনি কাছের হিন্দু বন্ধুও ছিল – কখনো কোন ধর্মীয় ইস্যু আমাদের মধ্যে কাজ করতনা। একটা বিড়ী সবাই যেমন শেয়ার করতাম, ওদের পূজায় যেতাম, তেমনি ঈদের দিনে কূলাকূলীও করতাম। এখন বুঝি আমি তখন মোডারেট মুসলিমও ছিলাম। কেন? নামাজ পড়ার কোন নাম গন্ধ না থাকলেও – মুসলিম হবার (নামেই মুসলিম ছিলাম যদিও) কারণে জন্ম ধর্মের বিরুদ্ধে কথা শুনলে বা কিছু দেখলে খারাপ লাগত। যেমন বাবরী মসজিদ ভাঙার পর খুব মন খারাপ হয়েছিল, ৯/১১ এ অবচেতন মনে খুশিই হয়েছিলাম। আর দশটা ধর্মপ্রাণ মানুষের মতোই হয়ত ভাবতাম বয়স হলে তওবা করে আবার ধর্মীয় জীবনে ফেরত যাবো।
আমি বাংলাদেশে থাকতে মাঈল্ড বীএনপি সাপোর্ট করতাম এবং অজানা কারণে আওয়ামী লীগ কে হেইট করতাম। কেন? কারণ ছোটোবেলা থেকেই আমাদের মাথার মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ মানেই অশুভ, আওয়ামী লীগ মানেই বাকশাল। সেটাই মেনে নিয়েছিলাম, কখনো মাথায় আসেনি যে বাকশাল মানে কি টা জানার চেষ্টা করব। সেই সময় অন্ধভাবে পাকিস্তান ক্রিকেট টীম কে সাপোর্ট করতাম আর পাকিস্তান কে কেউ ফালতু কথা বললে অপ্রাসঙ্গিক ভাবে ভারতকে আলোচনায় নিয়ে আসতাম।
যাই হোক, শাহবাগ আন্দোলন এর সময় আমি (যদিও আমি প্রবাসী) আমি বুঝতে পারলাম বাংলাদেশে ধর্মীয় গোঁড়ামি কতো গভীরে। হেফাজতে ইসলাম এর অগণিত মানুষকে টেলিভিশনে দেখে আমি হতভম্ব হয়ে ভাবছিলাম এই দেশের কি আর কোন ভালো ভবিষ্যৎ আছে? গত ১০-২০ বছরে ১৯৮০ সময়কার বোনা বিজটা বড় হয়ে এখন বটবৃক্ষ হয়ে শিকড়ের মতো ছড়িয়ে পরেছে।
একের পর এক মুক্তমনাদের চাপাতির আঘাতে মৃত্যু দেখে অভিজিৎদার বইটা (অবিশ্বাসের দর্শন) পড়লাম – অনেক ভূল ভাঙল। এরপর আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী। তারপর পড়লাম বন্যা আহমেদের বিবর্তনের পথ ধরে, তারপর আকাশ মালিকের – যে সত্য বলা হইনি।
এক বছরে আমার অনেক মানসিক পরিবর্তন হয়েছে, চিন্তা চেতনার ধারা বদলেছে। আমার কাছে এখন সব ধর্মের অসংগতি, মোডারেট ধর্মীয় মানুষদের চিন্তা ভাবনার অসাড়তা, সব কিছুতে ইস্রায়েল/আম্রিকাকে টেনে আনার বোকামি, ধর্মগ্রন্থ অবিকৃত আছে নিয়ে ভগিচগি ইত্যাদি দিব্যলোকের মত পরিষ্কার।
আমি এখন আর কোন ধর্মে বিশ্বাস করিনা, বুড়া বয়স হলে আবার জন্ম ধর্মে ফেরারও আর কোন ইচ্ছা নেই। বরং আমি এখন আবার ছোটবেলার মতো বই পরা শুরু করেছি, তবে এই বই গুলো কোন কল্প কাহিনি নয়, এগুলো বিগ ব্যাং, স্ট্রিং থিওরি, জেনেটিক্স আর ন্যাচারাল সিলেকশান এর উপর।
অভিজিতদা আর সকল মুক্তমনাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ আমার মনের চোখটাকে পুরোপুরি খুলে দেবার জন্য। জীবনটা অনেক ছোট, যতদিন বাঁচি – সৎ ভাবে যেভাবে থেকেছি, সেভাবে থাকব, অসাড় প্রার্থনায় সময় নষ্ট না করে যতপারি আর বেশী করে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করে যাব।
আজ হয়ত কলম বা কিবোর্ডের জবাবে চাপাতি আর রামদা চলছে, কিন্তু আমরা জানি হাতেগোনা কয়েকজন মানুষের যুক্তিবাদী লেখা আজ কত লাখ কোটি মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করেছে, হয়তোবা তাদের অনেকের মধ্যে বিশ্বাসের ভীত কিছুটা হলেও নড়ে যাচ্ছে, যেমন হয়েছে আমার ক্ষেত্রে।
মুক্তমনাদের তোমরা কখনই থামিয়ে রাখতে পারনি, কখনো পারবেওনা, পৃথিবীর ইতিহাস তাই বলে।
(এটা আমার জীবনের প্রথম লেখা, মনের অনেক জমা কথা ছিল সেজন্য হয়ত একসাথে লিখে ফেললাম – সৎ কমেন্ট করে মন্তব্য দিলে খুশি হব কেননা আরও লিখতে চাই। আরও বেশী মুক্তমনা আমাদের অনেক প্রয়োজন।)