ইছলাম: ধর্মীয় রাজনীতি নাকি রাজনৈতিক ধর্ম? – ১

লিখেছেন জর্জ মিয়া

ইছলামের সৈনিকেরা প্রতিনিয়তই ইছলাম কায়েমের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। সেটা কী রকম কাজ? এভাবে মানুষ মারাটাই কি ইছলাম সমর্থন করে নাকি? ইছলাম যদি এভাবেই মানুষ মারা আদেশ দিয়ে থাকে, তাহলে সেই বাপ-দাদার আমল থেকে যা জেনে আসছি, সবই কি মিথ্যে? ইছলাম তবে কি শান্তির ধর্ম নয়? ইছলাম কি অন্যান্য ধর্মের মানুষদের সাথে সহাবস্থানকে মেনে নেয় না? মূর্তি ভাঙ্গাই কি ইছলামী নীতি? ইছলাম অবিশ্বাসীদের কি তবে এভাবেই হত্যা করতে হবে? অন্য ধর্মের নারীদের ধর্ষণ, ও তাদের সম্পদ লুন্ঠন করতে হবে? একেই কি বলে মালে গনিমত? বাসা-বাড়িতে কাজের মেয়েদের সাথে সহবত করা কি ইছলামী নিয়মমতে সিদ্ধ? আমারই পাশে বিপরীত লিঙ্গের একজন মানুষের সাথে আমার শারীরিক গঠন ছাড়া তেমন কোনো বিশেষ পার্থক্যই নেই। অথচ ইছলামী মতে তাকে ভাবতে হবে ভোগের বস্তু? রাস্তায়, হাটে-বাজারে, কর্মস্থলে তাদের যাওয়া নিষেধ করে দিতে হবে? যদিও বা বের হয়, তবে তাদেরকে বস্তাসদৃশ বোরখা-হিজাবে আবৃত থাকতে হবে? নিজের স্ত্রীকে প্রহার করা হালাল?… এমন গুটিকয়েক সাধারণ প্রশ্ন প্রায় সব বিবেকবান মানুষের মনেই জেগে ওঠে সাধারণত।

ইছলামের শুরু মূলত আবুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদের হাত ধরে, তাও তার জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় পার হয়ে যাবার পরে। ইছলামের নবী মোহাম্মদ সম্পর্কে জানতে হলে কোরান, হাদিস, সিরাত গ্রন্থসমুহ ব্যতীত আর কোনো উপায়েই জানা যায় না। কাজেই ইছলাম ও মোহাম্মদ সম্পর্কিত সমস্ত কিছুই আছে ওপরোক্ত গ্রন্থগুলোয়। মোহাম্মদ ও ইছলাম-পূর্ববর্তী সময়ে আরবের মানুষরা মূলত ছিলেন পৌত্তলিক অর্থাৎ পুতুল- বা মূর্তিপূজারি। বর্তমান সময়ে এসবকে নির্বুদ্ধিতা হিসেবে দেখা হয়। সেই সময়ে প্রচলিত প্রথার বিরোধী হয়ে ওঠেন মোহাম্মদ। অবশ্য শুধু যে তিনিই একমাত্র প্রথাবিরোধী ছিলেন, তা নয়। ইছলামী তথ্য-উপাত্ত থেকেই জানা যায় যে, এমন প্রথাবিরোধী আরও অনেকেই ছিলেন। প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য মহিলা খাদিজা ও তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন নওফল, যিনি ছিলেন একেশ্বরবাদী হানিফা দর্শন থেকে প্রভাবিত, মূলত তাঁদের সাহায্যেই মোহাম্মদ আর্থিক ও ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করেন এবং খাদিজা ও মোহাম্মদের বিয়ের ঘটকও ছিলেন এই ওয়ারাকা বিন নওফল।

কাবাকে বলা হয়ে থাকে আল্লার ঘর। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে মনে এই ‘আল্লা’ কোথা থেকে এলো? পৌত্তলিক হুবাল দেবতা আল্লাত থেকেই আসলে এই আল্লার আবির্ভাব। চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদির হাজারো দেবতা ছিলো তখন। তখনকার মানুষদের মনে এই ধারণা ছিলো যে, এরাই এসবের নিয়ন্ত্রণকারী। ফলে ভাগ্যে বিশ্বাসী মানুষের এরা ছিলো কাল্পনিক ভাগ্যনিয়ন্ত্রণকর্তা। আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন নতুন ধর্মের আবির্ভাব তখন একেবারে নতুন ছিলো না, বরং এ ছিলো নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার, বলা চলে। কাবা ছিলো কোরাইশ গোত্রের লোকদের জীবিকার প্রধান উৎস। ইছলামের প্রসারের ক্ষেত্রে কয়েকটা ব্যাপার লক্ষণীয়, যার মধ্যে এই কোরাইশদের সাথে বিবাদ উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ‘বঞ্চিতরাই বিদ্রোহী হয়’, সেদিক থেকেও ইছলামের প্রসার ও প্রচারেও ব্যতয় ঘটেনি। শুরুর দিকে মোহাম্মদকে কম তিরস্কার, ঠাট্টার সম্মুখীন হতে হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই এটা হবারই কথা ছিলো।

মোহাম্মদের ইছলাম নামক ধর্মের উদ্ভবের পেছনে সুস্পষ্ট যে কারণ, সে হচ্ছে রাজনীতি। মোদ্দা কথা, ইছলাম একটি রাজনৈতিক দর্শন। শুরুর দিকে যে কয়জন ইছলাম গ্রহণ করেন, তাঁদের নিয়ে এধরনের বিপ্লব ঘটানো অসম্ভবই ছিলো। হিজরত (বাংলায় পলায়ন)-এর পরবর্তী সময় থেকেই মূলত ইছলামের প্রসার ঘটে ক্রমশ।

কোরানের সুরাসমূহকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে: মক্কী ও মাদানী। মক্কী (মক্কায় নাজিলকৃত) সুরাগুলো সাধারণত ভালো ভালো কথায় পরিপূর্ণ। “তোমার ধর্ম তোমার বা ধর্মে কোনো জবরদস্তী নেই” – এই জাতীয় মিষ্টি মিষ্টি মনভোলানো কথাগুলো মক্কী সুরায় বিদ্যমান। অথচ মদিনায় হিজরতের পরে এই সুমিষ্ট সুবচন ও উপদেশগুলোর বিলুপ্তি ঘটে। মাদানী (মদিনায় নাজিলকৃত) সুরায় যুদ্ধ, বিগ্রহ, নারী, অন্য ধর্মাবলম্বীদের সম্পদ কুক্ষিগতকরণসহ ইত্যাদি বিষয়ে নানা ভয়ঙ্কর সব কথাবার্তা! সাথে আছে পদে পদে পরকালের ভীতি প্রদর্শন। এমনকি যিযিয়া কর নামে এক প্রহসনের কথাও উল্লেখ আছে। মুছলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে অন্য ধর্মের মানুষকে থাকতে হলে দিতে হবে এই যিযিয়া কর! ভাবা যায়? কিছু মাদানী আয়াত পড়ুন:

যেখানেই মুশরিক/ অবিশ্বাসীদের পাওয়া যাক তাদের হত্যা কর। (২:১৯১, ৯:৫)

তাদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হও,কঠোর ব্যবহার কর (৯:১২৩), আর যুদ্ধ করে যাও (৮:৬৫), তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে, তোমাদের কাছে অপছন্দনীয় হলেও। (২:২১৬)

যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে থাকে, হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি। (৫:৩৩)

কাফেরদের গর্দানে আঘাত কর। (৪৭: ৪)

বিধর্মীদের উপর জিজিয়া কর আরোপ কর। (৯:২৯)

মুশরিকেরা ‘অপবিত্র’ (৯:২৮), এদের স্থান স্থান দোজখে। (৫:১০)

তোমরা তাদের (অবিশ্বাসীদের) সাথে লড়াই কর, যে পর্যন্ত না ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লার দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়। (২:১৯৩)

তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না (৫:৫১), ইহুদীরা বানর এবং শুকরের সমতুল্য। (২:৬৫, ৫: ৬০, ৭:১৬৬)

তাদের (অবিশ্বাসীদের) মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহ’র পথে হিজরত করে চলে আসে। অতঃপর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে তাদেরকে পাকড়াও কর এবং যেখানে পাও হত্যা কর। (৪:৮৯)

আমি তাদেরকে (অবিশ্বাসীদের) আগুনে নিক্ষেপ করব। তাদের চামড়াগুলো যখন জ্বলে-পুড়ে যাবে, তখন আবার আমি তা পালটে দেব অন্য চামড়া দিয়ে, যাতে তারা আযাব আস্বাদন করতে থাকে। (৪: