এই সেপ্টেম্বর মাসেই অন্তত বিশটি স্থানে দুর্গা মন্ডপে ঢুকে মূর্তি ভাংচুরের খবর এসেছে। দুর্গা পুজা যে আসন্ন এ নিউজগুলোই সেকথা মনে করিয়ে দিয়েছে। এক সাংবাদিক বন্ধু বলল সম্পাদকের কাঁচিতে পড়ে অনেক নিউজই প্রকাশিত হয় না। তবু আমি গুগল করে বিস্মিত হয়ে গেছি। দুয়েকটা উল্লেখ করি- কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় দুর্গাপূজার একটি মণ্ডপের চারটি প্রতিমা ভাঙচুর (সূত্র: ইত্তেফাক, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭), বরগুনার পাথরঘাটায় দুর্গা মন্ডবে ঢুকে মূর্তি ভাংচুর (সূত্র: এবেলো, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭), হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে একাধিক দুর্গা মন্দিরে প্রতীমা ভাংচুর (সূত্র: এবেলো, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭), তামাকপট্টী র্সা্বজনীন দুর্গাপূজা উদযাপন মন্ডপে বেশ কয়েকটি প্রতিমা ভাংচুর (সূত্র: ইত্তেফাক, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭), দিনাজপুর শহরের দুটি মন্দিরে প্রতিমা ভাংচুরের অভিযোগে চাকরিচ্যুত এক সেনাসদস্যকে আটক (সূত্র: বিডিনিউজ২৪ডটকম, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭), দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার সাতনালা ইউনিয়নের জোত সাতনালা ডাঙ্গিরপাড় বটতলা দুর্গাম-পের দুর্গা প্রতিমাসহ অন্যান্য প্রতিমাসমূহকে ভাংচুর (দিনাজপুর২৪ডটকম, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭), সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার কচুয়া সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর(বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭)।
গুগলে খালি ‘দুর্গা মূর্তি’ লিখলেই বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ‘মূর্তি ভাংচুর উৎসবের’ খবর আসতে থাকে। এই পেক্ষাপটেই গণভবনে দেখা যাবে হিন্দুদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দাঁত কেলিয়ে দেখা করতে। পাঞ্জাবী পরা কোন হিন্দু সেলিব্রেটি মিডিয়াতে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ গান জুড়ে দিচ্ছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠির তকমা পেয়েছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা। এর কারণ নির্যাতনের চিহৃ তারা বহন করছে। তাদের হয়ে কথা বলার জন্য মুসলিমদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওআইসি আছে। অপরদিকে বাংলাদেশে হিন্দুসহ আদিবাসীদের নিপীড়নের ইতিহাস ধামাচাপা দিতে সবাই তৎপর। মুসলমান সাংবাদিকদের ভাষায় মূর্তি ভাংচুরকারীরা সবাই ‘দুর্বৃত্ত’! বাম মুসলমানরা তত্ত্ব খাড়া করেছে সংখ্যার বিচারে হিন্দুরা নয় বাংলাদেশে মুসলিম সম্প্রদায়ই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। হিন্দুদের দেশপ্রেম নেই। হিন্দু নির্যাতনের উপর কোন সাহিত্য এখানকার কোন লেখক লিখেন না। সাহিত্য দুই-তিনশো বছর আগের সময়টা তখনকার প্রজন্মকে বুঝতে সহায়তা করে। যেমন রামায়ন মহাভারত মনসামঙ্গল ইত্যাদি সাহিত্য কীর্তি পড়ে তখনকার সমাজ জীবনের কিছুটা জানা যায়। গণভবনে ২০১৭ সালের শারদীয় দুর্গা উৎসবে হিন্দু সম্প্রদায়কে দেয়া সংবর্ধনাটাই ইতিহাসে থেকে যাবে। দাঁত কেলিয়ে হাসা সুবিধাভোগী হিন্দু নেতারা ইতিহাসে সাক্ষা দিবে এদেশে আমরা কি আনন্দে আর উৎসবেই না পুজা করতাম! তবু বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছি দেশপ্রেমের অভাবে…।
উপরে যে ৬-৭টা মন্ডবে মূর্তি ভাংচুরের নিউজ শেয়ার দিয়েছি- তার অর্ধেকও যদি সারা পৃথিবীতে বিচ্ছিন্নভাবে ঈদের নামাজে মুসলমানদের সামান্য প্রতিরোধের সম্মুখিন হতে হতো তাহলে সারাবিশ্বে শোরগোল পড়ে যেতো। বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের কোন ইতিহাস নেই। পাকিস্তানের হিন্দু নির্যাতনের তবু রেকর্ড থাকছে। নির্যাতিত হিন্দুরা আদলতে গিয়েছে। ন্যায় বিচার পায়নি কিন্তু মামলার রেকর্ড আগামীদিনে সেখানকার সংখ্যালঘুদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ইঙ্গিত স্পষ্ট করবে। বাংলাদেশের পুজা উৎযাপন কমিটি একটি চেতনা ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলের ক্রীমখোর শ্রেণী গোষ্ঠি। মূর্তি ভাংচুরের জন্য কালো পতাকা উত্তোলন কর্মসূচী যদি সারাদেশর মন্ডবগুলো নিতো তাতেও একটা রেকর্ড থাকত। কিন্তু সবাই প্রভুভক্ত সংখ্যালঘু সাজতেই ব্যস্ত। প্রতিবছর বাংলাদেশে মন্দিরে যে ভাংচুর ঘটে তার কিছু নিউজ লিংক ছাড়া আর কোন ইতিহাসই এদেশের সেক্যুলার ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবসায়ীরা রাখবে না। ইসলামপন্থিদের কথা বললাম না কারণ মূর্তি ভাঙ্গলে সোয়াব মিলবে এটা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস। মূর্তি ভাঙ্গার নির্দেশ দিয়ে নবী তার প্রিয় সারগেদ আলীকে বলেছেন, ‘যখনই কোন মূর্তি দেখবে, তা ভেঙ্গে টুকরো না করে ছাড়বে না’ (মুসলিম, মিশকাত হা, ১৬৯৬)। অপর হাদিসে আয়েশা বলেন, রাসূল (ছা:) স্বীয় গৃহে প্রাণীর ছবিযুক্ত কোন জিনিসই রাখতেন না। দেখলেই ভেঙ্গে চূর্ণ করতেন (বুখারী, মিশকাত হা, ৪৪৯১; ঐ বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা, ৪২৯২)। মন্দিরে ঢুকে মূর্তি ভাংচুরকারী তাই টাকা-পয়সা পাওয়ার লোভে এ কাজ করে না। নগদ সোয়াবের আশাতেই তাদের মন্দিরে হামলা। এরকম ধার্মীকদের যদি ‘দুর্বৃত্ত’ নাম দেয়া হয় সেটাই তো সবচেয়ে বড় অধার্মীকতা!
বাংলাদেশে নাস্তিকরা ছাড়া হিন্দুদের হয়ে কথা বলার মত আর কোন গোষ্ঠি নেই। ধর্ম বিশ্বাস করে এমন ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল মুসলমান কারোর পক্ষে হিন্দু নির্যাতনকে স্বীকার করে নেয়ার মধ্যে অস্বস্তি আছে। এরাই নিজেদের অস্বস্তিকে আড়াল করতে নাস্তিকদের ‘ছুপা হিন্দু’ বলে রটায়। প্রতিবছর দুর্গা পুজার সময় এই পুজার ইতিহাস, ধর্মীয় অন্তঃসারশূন্যতা, বিপুল পরিমাণ অর্থে অপচয় নিয়ে লিখতে গিয়ে লেখাগুলো আটকে যায় লাগামহীন মূর্তি ভাংচুরের সংবাদে। একটা মার খাওয়া ধর্মীয় সম্প্রদায়ের এই সময়ে ওরকম লেখাগুলো সময়জ্ঞানবর্হিভূতই লাগবে। এদেশের নাস্তিকরা কেন ইসলাম নিয়েই বেশি লেখে- এটাও তার একটা বাস্তবতা…