লিখেছেন সমকোণী বৃত্ত
আস্তিকদের যদি বলা হয় “আপনার ঈশ্বরকে তো কাউকে সাহায্য করতে দেখি না”, তখন আস্তিকরা স্ব স্ব ঈশ্বরের ঈশ্বরত্ব টিকিয়ে রাখানোর জন্য এই বাক্যটিই ব্যবহার করেন: “ঈশ্বর সরাসরি কাউকে সাহায্য করেন না, তিনি উসিলার মাধ্যমে সাহায্য করেন, যেমন ধরেন – ডাক্তার হল উসিলাভ। আসলে রোগ ভাল হয় ঈশ্বরের কৃপায়।”
তো আসুন, দেখি, এতে ঈশ্বরের ঈশ্বরত্ব টেকে কি না?
আমরা জানলাম, ঈশ্বর উসিলার মাধ্যমে সাহায্য করেন। কিন্তু কেন উসিলার প্রয়োজন তাঁর হয়? তবে কি তিনি সর্বশক্তিমান নন? মানুষ যখন কাউকে সাহায্য করতে চায়, কিন্তু অক্ষম, তখন সে অন্য জনের মাধ্যমে সাহায্য করে। তাহলে তো মানুষই এগিয়ে আছে ঈশ্বরের চেয়ে, কেননা ঈশ্বরের উসিলার প্রয়োজন হয়, আর মানুষ সরাসরি ও অন্যের মাধ্যমে দু’ভাবেই করতে পারে।
ধরুন, এক বনে এক শিশু হারিয়ে গিয়ে কাঁদছে। তখন ঈশ্বরের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শিশুটিকে উদ্ধার করতে পারবেন না। কারণ তখন তিনি উসিলার অপেক্ষায় থাকবেন – কখন কোন মানুষ ঐ পথে যাবে, তো উদ্ধার করবে। কোনো আস্তিক ভাই ঈশ্বরকে কলুষিত হওয়া থেকে বাঁচাতে বলতে পারেন: “ঈশ্বর উদ্ধার করার ইচ্ছা করলে অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই, তিনিই মানুষকে ওই পথে নিয়ে গিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করতে পারেন।”
যদি আপনার কথা মেনেও নিই, এখানে দুটো সমস্যা থেকেই যায়:
১. ঈশ্বর উসিলা হিসেবে মানুষকে ব্যবহার করছেন, আবার ঈশ্বর বলছেন, তিনি মানুষকে দিয়েছেন স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি – যা পরস্পরবিরোধী। ঈশ্বরের ইচ্ছাপূরণের জন্য কোনো মানুষকে ব্যবহার করলে সেই মানুষের আর স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু থাকে না।
২. ঈশ্বর কি কোনো কাজে ব্যর্থ হন? কখনই না, তাই তো? তো যদি শিশুটি উদ্ধার না হয়, তাহলে কি বলতে পারি, ঈশ্বর শিশুটিকে উদ্ধার করতে বা উসিলা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন?
বলবেন, “না, ঈশ্বর হয়তো চাননি শিশুটি উদ্ধার হোক। এর মাধ্যমে তিনি হয়তো পরীক্ষা নিচ্ছেন যে, সে বিপদে পড়লে ঈশ্বর ব্যতিত অন্য কাউকে ডাকে কি না।” – পরীক্ষা? যে শিশু ‘ঈশ্বর কী’ এটাই বোঝে না, সে কীভাবে পরীক্ষা দেবে?
বলবেন, “হয়ত তার বাবা-মার পরীক্ষা নিচ্ছেন।” – বাবা-মার অপরাধের জন্য শিশুকে শাস্তি দিলে ঈশ্বর ন্যায়বিচারক হন কীভাবে?
বলবেন, “বাবা-মার কাছ থেকে সন্তান দূরে সরিয়ে বাবা-মাকে শান্তি দিচ্ছেন।” – ভাল কথা, বাবা-মাকে শাস্তি দেবেন কিন্তু ছোট্ট শিশুকে কেন কষ্ট সইতে হচ্ছে?
যাক সে কথা। কিছুদিন আগে শাজাহানপুরে একটি শিশু পাইপ লাইনে পড়ে যায়, তখন ঈশ্বর তো সরাসরি সাহায্য করেন না, তাই উসিলা আনলেন একজন-দুইজন নয় শতশত মানুষ দিয়েও উদ্ধার করতে না পারলেন না। শেষে স্থানীয় মানুষকে দিয়ে অভিনব যন্ত্র বানিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করলেন। কিন্তু ঈশ্বর উসিলা তৈরিতে বেশি সময় নিয়ে ফেলেছিলেন বলে শিশুটি মারা যায়।
তাহলে কি বলতে পারি – জীবিত অবস্থায় শিশুটিকে উদ্ধার করতে ঈশ্বর ব্যর্থ হয়েছেন? ঈশ্বরকে বাঁচাতে হয়তো কেউ বলবেন, “ঈশ্বর নয়, মানুষই ব্যর্থ হয়েছে।” – বাহ, কী সুবিধাবাদী অবস্থান! শিশুটি বেঁচে গেলে আপনার ঈশ্বর বাঁচিয়েছেন, আর মরে গেলে – মানুষের ব্যর্থতায়!
বলবেন, “আসলে হয়েছে কী, ঈশ্বর শিশুটির মৃত্যু ওখানে ওভাবেই রেখেছিলেন, তাই মানুষ শত চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারলো না।” – তাহলে তো আরো সমস্যায় ফেলে দিলেন! ভবিষ্যতে কেউ বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধারের নামে বৃথা চেষ্টা আর করবো না। কারণ বিপদগ্রস্তের কপালে উদ্ধার থাকলে এমনিতেই উদ্ধার হবে, অন্যথায় শত চেষ্টা করেও লাভ নেই।,
বলবেন, “ভাই, ঈশ্বর ভাল কাজ করতে বলেছেন, আপনি আপনার চেষ্টা চালিয়ে যান।” – দিলেন তো আরো সমস্যা ফেলে! ধরুন ঈশ্বর মাস্টারপ্ল্যান করে রেখেছেন যে, একজনের পানিতে পড়ে মৃত্যু হবে। এখন আমি তাড়াতাড়ি করে যদি তাকে উদ্ধার করে ফেলি, আর সে যদি বেঁচে যায়, তাহলে তো ঈশ্বরের মাস্টারপ্ল্যানের বারো ঘটিকা বেজে যাবে! এত গুনাহের কাজ আমি কীভাবে করবো?
বলবেন, “আরে না,আপনাকে রেখেই তিনি প্ল্যান করেছেন। আপনি চাইলেও এর অন্যথা করতে পারবেন না।” – তার মানে আমিও মাস্টারপ্ল্যানের অংশ। তাহলে আমার স্বাধীন ইচ্ছা কোথায়?
তিনি যদি আমাকে গুনাহগারের ভূমিকায় রাখেন, তবে তো আমি শেষ! আমার মনে হয়, তিনি আমাকে নাস্তিকের ভূমিকায় অভিনয় করতে দিয়েছেন। আচ্ছা, আমি যদি আমার রোল অর্থাৎ নাস্তিকতার অভিনয় ঠিকমতো করতে পারি, আমাকেও কি তিনি জান্নাত, হুর, স্বর্গ ইত্যাদি দেবেন?
এখন শেষ করবো বিভিন্ন ধর্মের কথিত ইশ্বরের কিছু উসিলার উদাহরণ দিয়ে।
১. ইসলাম ধর্মের মতে, ঈশ্বর – আল্লাহ, যিনি সর্বশক্তিমান। অথচ তাঁর বান্দাদের (মানুষদের) কাছে তাঁর বাণী পাঠাতে হয় নবীদের উসিলা হিসেবে ব্যবহার করে। এখানেই শেষ নয়। সেই নবীর কাছে বাণী পৌঁছাতে হয় আবার জীবরাঈলকে মাধ্যম বা উসিলা করে। এই না হলে সর্বশক্তিমান!
২. হিন্দুধর্মে মহাশক্তিধর রামের উসিলা বা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে হয় হনুমানকে সীতাকে খোজার জন্য…
আরো অনেক আছে। এত বলে পোস্ট আর দীর্ঘ করবো না।