নাস্তিকনামা

[সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক পোস্টটি নাজিল করছি]

নাস্তিক অর্থাৎ সাধারণভাবে অবিশ্বাসীদের যেকোন কিছু করতে একটাই বাধা, তাদের বিবেক বা নীতিবোধ, এটা কিভাবে কাজ করে তা নির্ভর করছে পুরোটাই তার শিক্ষা, রিয়ালাইজেশন, রেশনালিটি, ওপেননেস ইত্যাদির উপরে। ধর্ম ঘেঁষা রক্ষণশীল রাডিক্যাল সমাজ আমাদের যৌক্তিক এবং সুস্থ সংস্কার নিয়ে বেড়ে ওঠায় তেমন কোন ভূমিকাই রাখে না। আমাদের এগুলো কষ্ট করে অর্জন করতে হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। প্রসেসটা যদি এমন হয় যে, আগে নিজেকে লিবারাল এবং র্যাশনাল হিসেবে তৈরী করার পরে কেউ ধর্মে অবিশ্বাস আনে তবে সেটাই স্থায়ী এবং কার্যকর হয় এবং মানবিক মূল্যবোধের চর্চা তাদের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু আগেই ইন্সট্যান্ট নাস্তিকতা, তারপরে “আমি নাস্তিক” পরিতৃপ্তি; এখানে আর নিজের মূল্যবোধ গঠনের সময় বা সুযোগ থাকে না।

বিজ্ঞানমনস্কতার কথা আমি ছেড়েই দিচ্ছি, নাস্তিকেরা ধর্মগ্রন্থ পড়তে ধার্মিকদের থেকেও বেশি আগ্রহী অধিকাংশ সময়। কেন? ধর্মকে খিস্তাতে হবে বলে। কিন্তু কজন নাস্তিক এটলিস্ট প্রাইমারি এন্টি ক্রিয়েশন থিয়োরি, ডারউইনিজম নিয়ে পড়েছেন? বিগ ব্যাং থিওরি, স্ট্রিং থিওরি বা ডকিন্স হিচেন্স ছেড়েই দিলাম, মেন্ডেলের সাকসেশন থিয়োরিই বা কজন জানেন? “নবীপোন্দন সপ্তাহ” যেই উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পার করা হয়, কার্টুনে কার্টুনে ভরিয়ে দেয়া হয় ভার্চুয়াল জগত, তার এক শতাংশ এনথুজিয়াজম কি থিওরি অফ এভোলুশন নিয়ে কার্টুন আঁকার পেছনে ব্যয় করা হয়? আমি নাস্তিক তাই আমি বিজ্ঞানমনস্ক বলে গরিলার মত বুকে কিল মারা মানুষগুলো কি আদৌ বিজ্ঞান পড়েন? আর শুধু নিজে পড়াই নয়, বিজ্ঞানের জ্ঞানকে সহজবোধ্য করে ছড়িয়ে দেয়ার কথা কি চিন্তা করেন? নিজের পরিবারে চলে আসা বোরখা বা সিঁদুরের ব্যবহার কি লজিকালি দূর করার চেষ্টা করেন? চেষ্টা করেন কি, পরিবারে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা আচার বিচারের সংস্কার এবং কুসংস্কার দূর করার? বিজ্ঞানমনস্ক(!) অবিশ্বাসী হয়েও যদি সুবিধাবাদী হিপোক্রেসি ধরে রাখা হয়, তবে বিশ্বাসী ধার্মিকের সুবিধাবাদী চরিত্র নিয়ে কেন এত উচ্চবাচ্য?

ধর্ম অস্বীকারকারী প্রচলিত ঈশ্বর অবিশ্বাসী মাত্রেই আমরা ঢালাওভাবে নাস্তিক বলে ফেলছি, অথচ ধর্ম অবিশ্বাসীদের আরো কিছু ফর্ম আছে যেটা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। বোধহয় সময় এসেছে এই ফর্মেশনগুলো নিয়ে পরিষ্কারভাবে কথাবার্তা হওয়ার। তাছাড়া নাস্তিকতা নিয়ে আমরা এতই উচ্ছ্বাসে থাকি যেন নাস্তিকতা ইটসেল্ফ একটা ভার্চু! ফলে অবিশ্বাসীদের মধ্যে সত্যিকারের ভার্চু আত্নস্থ করার ঝোঁকটাই কমে যাচ্ছে। নাস্তিকতা মানেই যেন এন্টি ধর্ম, এন্টি সোশাল এস্টাবলিশমেন্ট, সেক্সুয়াল লিবারালিজম, এবং ডিবেট। ব্যাস থেমে যাচ্ছে এখানেই। কিন্তু এটুকু দিয়ে সমাজের কি পরিবর্তন আনা যাবে? স্রেফ বিশেষ একটা ক্লাস্টার হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর আত্মগরিমা ছাড়া আর কিছু দেখি না। জানা, বোঝা, সমস্ত ক্ষেত্রে লিবারালিজম, র্যাশনালিজমের চর্চা একদম হচ্ছে না। জানি না আদৌ কবে হবে। আমাদের এই নাস্তিকতার তৃপ্তি কবে শেষ হবে, কে জানে। তবে নাস্তিকদের নিজেদের জন্যই এখন উচিৎ এই আত্মতৃপ্তি থেকে বেড়িয়ে আসা।

অধুনা নাস্তিকদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে নাস্তিকতার যে সমস্ত কারণ পাওয়া গিয়েছে তা বিভীষিকাময়।
কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, কেউ আরজ আলী মাতুব্বর পড়ে, কেউ পাশের বন্ধুর প্ররোচনায়, কেউবা পরীক্ষায় ভুল করে সৃষ্টিকর্তাকে সেটা ঠিক করে দিতে বলে কাঁদতে কাঁদতেও ঠিক না হওয়ায় এ প্লাস মিস হওয়ায় নিজেকে নাস্তিক দাবী করছে। আবার পারিবারিক চাপে পড়ে “আমি সংশয়বাদী ছিলাম” বলে নাস্তিকতাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে দুবার ভাবছে না! আবার এদের আরেকশ্রেণির মধ্যে সেলিব্রেটিজম এমনভাবে গেঁথে গেছে যে তারা প্রসিদ্ধ চর্বিতচর্বণ দিয়েই কাজ চালাচ্ছেন। এ কারণেই বোধ করি নতুন কোনো ক্ষুরধার যুক্তিভিত্তিক পোস্ট তেমন একটা আসছে না।
এর যে কারণটা প্রথমে আসবে তা হলো আমাদের “কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা”র প্রবণতা। আমরা ভাবি যে ধর্মের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরলেই মানুষ দলে দলে নাস্তিক হয়ে যাবে। সে লক্ষ্যে আমাদের কেউ কেউ বহুদূর এগিয়ে এসাইলামও পেয়ে গেছেন! সমস্যা হলো আমাদের মাথায় এটা কাজ করেনা যে, সবসময় কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা যায় না। কাঁটা যখন অনেকদিন থাকার দরুণ পঁচে যায় তখন অপারেশন ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। কিন্তু এটাই আমাদের মনে থাকে না। আমরা সবার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসাকেই যথেষ্ট ভেবে বসে থাকি। একজন লোক জন্মানোর পর মুহূর্তেই আযান শুনে এবং বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ার আগপর্যন্ত ধর্মের নানাবিধ প্রয়োগ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে এবং সমাজের সর্বস্তর থেকে এটাকেই সঠিক জীবন বিধান বলে শোনে বলে তার মনে এটা ভিন্ন অন্য কোনো পথের চিন্তাও মাথায় আসে না। তাছাড়া স্কুল-কলেজে আমাদেরকে ধর্মের যাবতীয় ভালো ভালো দিকসমূহ বারংবার দেখানো হয়; ধর্মে যে হিংসাত্নক বাণী আছে সেসব ভুলেও জানানো হয় না। অন্যদিকে বলা হয় কুরানের প্রতিটা অক্ষর পড়লেই দশটা করে নেকি; পাঠক বুঝে পড়লো নাকি না বুঝে পড়লো তাতে নেকির কোনো উনিশ-বিশ হবে না! এমতাবস্থায় কে যাবে কষ্ট করে কোরানের বাংলা পড়তে; যেখানে বাংলায় পড়লে কোনো সওয়াবও নাই?
এভাবেই ধর্ম আমাদের সমাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। “ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দুটি হাত” এভাবে নামাজের মধ্যে ক্বিরাতরূপে উচ্চারণ করলে কয়জন মুমিন বান্দা ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবে তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে!

যাহোক, দিনশেষে দেখা যায় ধর্মগ্রন্থের অসামঞ্জস্যতা দেখিয়ে মুমিনদের উসকে দেয়া ব্যতিরেকে বিশেষ কিছু হয়না। তার চাইতে বিজ্ঞান চর্চা বেশি বেশি করে করলে আখেরে ভালো ফল লাভের সুবর্ণ সুযোগ থাকে। মাদ্রাসায় পড়ুয়ারা কিন্তু কমবেশি হাদিস-তাফসির পড়ে। কিন্তু কজন মাদ্রাসা পড়ুয়াকে নাস্তিক হতে দেখেন? তাদেরকে শেখানো হয় মেয়েরা আপাদমস্তক ঢেকে চলাচলের জন্যই সৃষ্ট! কাজেই যেভাবে বলা হচ্ছে, কাঁটা দিয়ে অত সহজে কাঁটা তোলা সম্ভব হয়না। বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই অপারেশন প্রয়োজন হয়।

ইদানিং “কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা নাকি অপারেশন” ইস্যুতেও নাস্তিক সমাজ দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। দিনশেষে এসব কমিউনিটির জন্য শুভ কোনো ফল বয়ে আনবে না। এটা ভেবে সবার উচিত কিছুদিনের জন্য হলেও নির্দিষ্ট একটা নৌকায় সহাবস্থান গ্রহণ করা।

পুনশ্চ: এ পোস্টের বিপরীতে অর্থাৎ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার পক্ষে যুক্তি কাম্য।

কৃতজ্ঞতা: অনুসন্ধানী আবাহন