“আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী”

অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয়টা তেমন একটা সুখকর বলা যাবে না … বলতে গেলে হেলায়, নির্বোধ অবজ্ঞায় দারুণ একটা সুযোগ হারিয়েছি … কত সালের দিকে? ২০০৫ সাল হবে হয়তো (** কিংবা আরো আগে কি? কেন জানি মনে হচ্ছে আরো আগে- কিন্তু বইটার প্রকাশকাল তো দেখি ২০০৫ –এ …) … সে সময়ে বাম একটা ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত, তাদেরই উদ্যোগে গঠিত শিক্ষা সম্পর্কিত আন্দোলনের একটি প্লাটফর্মের সভাপতি অজয় রায় স্যার দারুণ শ্রদ্ধেয় আমাদের, বিভিন্ন সভা- সেমিনারে স্যারের কথা খুব উদ্বুদ্ধ করতো, স্যারকে একই সাথে মনে হতো মাটির মানুষ ও লড়াকু একজন … সেই পাকিস্তান আমলের শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্বের যাবতীয় আন্দোলন- সংগ্রামে স্যার ছিলেন বরাবর সামনে সারিতে! এমন একজন লড়াকু, প্রকৃত বিপ্লবী মানুষের উপস্থিতিই ছিল আমাদের মত নবীন কর্মীদের জন্যে টনিকের মত! মুশকিল হচ্ছে, স্যার প্রচণ্ড শ্রদ্ধার- তাই বলে স্যারের ছেলেপুলেদেরো একইরকম শ্রদ্ধা করবো- সেটা তো হতে পারে না- অনেকটা এইরকম ত্যাদোড় টাইপের চিন্তার কারণে অভিজিৎ রায়কে হাতের কাছে পেয়েও দূরে ঠেলে দিয়েছি …

আমার রাজনৈতিক সংগঠনের বা দলের একটা অনুষ্ঠান ছিল- টিএসসি মিলনায়তনে। তার এক ফাঁকে দেখলাম, অজয় রায় স্যার এক বান্ডিল বই আনালেন। সেই বই টিএসসি অডিটরিয়ামের সামনে টেবিলে সাজানো হলো, সংগঠনের কর্মীরা দায়িত্ব নিয়ে বসে বিক্রি করা শুরু করলো! হাতে নিয়ে দেখি বইয়ের নাম- আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, লেখক- অভিজিৎ রায়! শুনলাম- তিনি অজয় রায় স্যারের জ্যেষ্ঠ সন্তান, আমেরিকায় থাকেন। বই লিখেছেন। আমার মনে হলো- কত গুরুত্বপূর্ণ বই থাকতে এটা কেন আমাদের সংগঠন বিক্রি করবে! ধারণা করলাম, অজয় রায় স্যারের অনুরোধে আমাদের সংগঠন এ কাজ করছে। ফলে, আমার কাছে- গুরুত্ব দিয়ে বইটি উলটে পাল্টে দেখারো প্রয়োজন মনে হয়নি … নিতান্ত অবহেলায় সামান্য উলটে পাল্টে যতটুকু দেখেছি- তাতে আগ্রহ তো তৈরি হয়ইনি, আরো বিরক্তি তৈরি হয়েছে- ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’- কাব্যিক নামের কারণে ভেবেছিলাম- এটা গল্প/ উপন্যাস টাইপের কোন সাহিত্য-টাহিত্য হবে হয়তো, ভেতরে আবার দেখি- বিজ্ঞান-বিজ্ঞানীদের টুকটাক আলোচনা, কি না কি গজাখিচুরি জিনিস লিখেছে ভেবে রেখে দিয়েছি … অভিজিৎ রায়, আমাদের অভিজিৎ দা’র সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ এখানেই শেষ … অজয় রায় স্যারের জ্যেষ্ঠ পুত্র, আমেরিকায় থাকেন- একটি বই লিখেছেন … ব্যস এতটুকুই চেনা তাঁকে! ফলে, তাকে বেশি মনে রাখার দরকারো নেই … সুতরাং একরকম ভুলেই ছিলাম- বলা চলে মুক্তমনা ওয়েবসাইটের সাথে পরিচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত … (পরে, আমার মনে হয়েছে-এই বইটার নাম এমন কাব্যিক না হয়ে খটোমটো কিছু হলেও হয়তো ভালো হতো … এভাবে হেলায় রেখে দিতাম না হয়তো …)

২০০৫ সালে পড়াশুনার পাট চুকেবুকে চাকুরিতে যুক্ত হওয়ার পরে ইন্টারনেট দুনিয়ার সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আমার, তার আগে ভার্সিটির হলকেন্দ্রিক জীবনে কোন কোন হলে নেট কানেকশন আসে, আবার প্রশাসন ডিসকানেক্ট করে দেয়-অনেকটা ইঁদুর বিড়াল দৌড়ের মত করে। যদিও আমরা দাবী তুলেছিলাম হলে হলে ইন্টারনেট কানেকশন দিতে হবে, ব্যক্তিগতভাবে সেভাবে কানেক্টেড হইনি … বন্ধুদের যারা যুক্ত হয়েছিল- দেখতাম তারা মহা আগ্রহে বিভিন্ন ম্যাসেঞ্জারে, চ্যাটরুমে চ্যাট করতো- অপরিচিত নানাজনকে ‘এ-এস-এল’ প্রশ্নটি দিয়ে শুরু করতো এবং জবাব মনোপুত না হলেই ‘বাই’ বলে দিত … এই কাজে আগ্রহ পাইনি, ফলে সেভাবে ইন্টারনেট দুনিয়ায় ঢুকাও হয়নি। চাকুরি জীবনে ল্যাপটপ আর নেট কানেকশন পাওয়ার পরে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইন্টারনেট এর জগতে বিচরণ শুরু হয়, গুগলডটকম এ সার্চ দিয়ে কত দারুণ দারুণ সাইটে ঢুকছি, অপার বিস্ময়ে সেগুলো গোগ্রাসে গিলছি, আর্ট-কালচার- ইতিহাস আর দেশ বিদেশের পলিটিকাল মুভমেন্ট- এসবই ছিল মূল আকর্ষণের জায়গা … এই ঘুরতে ঘুরতেই হঠাত একদিন পেয়ে গেলাম মুক্তমনাডটকম নামে একটা সাইট! বাংলা ভাষায় এমন একটা সাইট থাকতে পারে- সেটা ছিল কল্পনারও অতীত … সময় সুযোগ পেলেই অফিসে চুপে চাপে কোনার দিকে সিটে বসে অন্যান্য সাইট ওপেন রেখে সেসবের ফাঁকে মুক্তমনা ওয়েব সাইটে ঢু মারতাম … কামরান মির্জা, ফতেমোল্লা, আবুল কাশেম, আকাশ মালিক, …… এমন কতজনকে যে আবিস্কার করলাম- আমি একদম জানতামই না যে, আরজ আলী মাতুব্বর- তসলিমা নাসরিন- হুমায়ুন আজাদ – আহমদ শরীফ এরকম কয়েকজন ছাড়া আর কেউ নাস্তিকতা বিষয়ে- ধর্মের সমালোচনামূলক লেখা লেখছেন- তাও আবার বাংলায়! এবং পেলাম অভিজিৎ রায়কে … মুক্তমনার স্রষ্টা, মুক্তমনার প্রাণ … মুক্তমনায় র্যাবশনালিটি নামে একটা সেকশন ছিল- সেটায় ঢুকলে অসংখ্য প্রবন্ধ পাওয়া যেত … ধর্মকে এমন সরাসরি আক্রমণ, কিন্তু সম্পূর্ণ যুক্তির উপরে ভিত্তি করে সিরিয়াস টাইপ লেখা- ঐ সময়ে বাংলায় খুব বেশি ছিল না! তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আজাদ- কিছু লিখেছেন, ওপার বাংলা থেকে পেতাম প্রবীর ঘোষ, ভবানী প্রসাদ সাহু, দেবী প্রসাদের বই পত্র- সেগুলোর ধরণ ছিল নির্দিষ্ট রকম! কিন্তু কোরআন, হাদীস ধরে ধরে, মুহম্মদ এর জীবনী ধরে ধরে এমন সব লেখা আমি মুক্তমনাতেই প্রথম পেয়েছি! সবচেয়ে দারুণ যে ব্যাপারটা মনে হয়েছে- আরজ আলী মাতুব্বর, হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন, আহমদ শরীফ, প্রবীর ঘোষ, ভবানীপ্রসাদ সাহু- কেবল হাতে গোনা এই কজনই না- সাহস নিয়ে ধর্মান্ধদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে লিখে যাচ্ছেন আরো অনেকেই … মুক্তমনার লেখক প্যানেলের সংখ্যাটাও তাই আমার কাছে ছিল বিশাল গুরুত্বপূর্ণ। আজকের সময়ে অসংখ্য ব্লগ প্লাটফর্ম, অনেক তালিকাভূক্ত ও তালিকাহীন নাস্তিক লেখকদের ভীড়ে- সে সময়ে মুক্তমনার আবেদন যে কি ছিল বুঝা কঠিন হতে পারে … কিন্তু ঐ সময়ে আমাদের মত নিঃসঙ্গ নাস্তিকদের জন্যে মুক্তমনা ছিল আশার প্রদীপবাতির মত। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’- মুক্তমনা ছিল সেই আলো হাতে চলা আঁধারের যাত্রী, অভিজিৎ রায় ছিলেন আলো হাতে চলা আঁধারের যাত্রীদের কাপ্তান, নাবিক …!

২০০৭ সালে সামু ব্লগের খোঁজ পেয়ে যাই এক বন্ধু মারফত … সে সময়ে আমি রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে- আমার রাজনৈতিক জীবনের সব বন্ধুদের থেকে বিযুক্ত থেকে- নিজের পরিবার নিয়ে জীবন যাপন করছিলাম … কি যেন ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম- ব্লগে রেজিস্ট্রেশন করার … হাতের কাছেই ছিল- আরজ আলী মাতুব্বর সমগ্র, সেই বই থেকে দেখে দেখে দুটো প্রশ্ন কপি করলাম- নাস্তিকতা বিষয়ক, নিক নিলাম নাস্তিকের ধর্মকথা- পোস্ট দিয়ে দিলাম … প্রোফাইল পিক হিসাবে আরজ আলী মাতুব্বরের ছবি লাগিয়ে দিলাম … নাস্তিকতা বিষয়ক লেখালেখি- বিশেষ করে বিভিন্ন ধার্মিক পোস্টে তর্ক বিতর্ক শুরু করে দিলাম এই নিক থেকে … আজ এতদিন পরে যখন ভাবি- ঠিক ঐ মুহুর্তে কেন নাস্তিকতা বিষয়ে লেখালেখি শুরু করতে গেলাম- সেটা তো হতে পারতো- রাজনীতি, দেশ, সমাজ, বিজ্ঞান- এমন নানা বিষয়েই … তখন মুক্তমনার ভূমিকা স্বীকার না করে পারি না … মুক্তমনাডটকম ঐ সাহসটি জুগিয়েছিল যে, নাস্তিকতা নিয়েও লেখা যায় … আমাদের জেনারেশন তসলিমা নাসরিনের নির্বাসন প্রত্যক্ষ করা জেনারেশন- তখন আমি মাধ্যমিক শেষ পর্যায়ের ছাত্র, আমাদের জেনারেশন হুমায়ুন আজাদের উপর নৃশংস হামলা প্রত্যক্ষ করা জেনারেশন- তখন আমি ভার্সিটি স্টুডেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই লম্বা মিছিল করা, পুলিশের বাড়ি খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার অভিজ্ঞতাপুষ্ট, তসলিমা নাসরিন – হুমায়ুন আজাদের প্রভাব আমার উপর অনেক, জানি আমাদের ও আমাদের সমসাময়িক জেনারেশনের নাস্তিকদের উপর তাদের প্রভাব অনেক! একইভাবে, এই মুক্তমনা ওয়েব সাইটের প্রভাবও আমার উপরে ভীষণ রকম বেশি … মুক্তমনার লেখকদের প্রভাব অনেক বেশি … আমার কেন জানি মনে হয়- এই ওয়েবসাইট না থাকলে, তসলিমা নাসরিন না নির্বাসিত হলে, হুমায়ুন আজাদের উপরে নৃশংস হামলা না হলে, এবং আরজ আলী মাতুব্বর না থাকলে- “নাস্তিকের ধর্মকথা” নিকের পয়দা হতো না … অন্য নিকের পয়দা হয়তো হতো- রাজনীতি, ইতিহাস, সমাজ, দেশ বা অন্য যেকোন বিষয়ে যেকোন একটা নিক নিয়ে সামু ব্লগে লেখতাম … নাস্তিকতা নিয়ে হয়তো সেভাবে মাথা ঘামাতাম না …

২০০৭ থেকে সামু ব্লগে লেখালেখি- তর্ক বিতর্ক চলতে চলতেই- হঠাত আগ্রহ হলো- মুক্তমনাতে লেখা পাঠাতে … সামু ব্লগের আমার একটা লেখা আরেকটু ঘষামাজা করে- ভয়ে ভয়ে মেইল করলাম! মেইল এড্রেস চার্বাক_বিডি! চার্বাক দর্শন নিয়ে আমার এমন আকর্ষণ যে, মনে হয়েছিল- ইশ, এমন মেইল এড্রেস আমিই তো রাখতে পারতাম … অভিজিৎ দা- সাদরে ওয়েলকাম করে আমার সেই লেখাটা ছাপিয়ে দিলেন! সেই থেকে অভিজিৎ দা আর ফরিদ আহমেদকে মাঝে মধ্যে মেইল করে লেখা পাঠাতাম- তারা ছাপিয়ে দিতেন … । এতটুকুই ছিল সম্পর্ক! সামু ব্লগে পুরো সময় কাটাই- ধার্মিকদের সাথে তুমুল উৎসাহে তর্ক বিতর্ক করি- সেই তর্ক বিতর্কগুলোকেই আরেকটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিজের পোস্ট তৈরি করে ফেলি- আর এই পোস্টগুলোর মধ্যে যেগুলো একটু মানসম্পন্ন বলে মনে হয়- সেগুলো মুক্তমনায় পাঠিয়ে দেই … এভাবেই চলছিল- এর মধ্যে একদিন জানতে পারি, মুক্তমনাতেও ব্লগিং অপশন শুরু হবে! খুশী হলাম খুব! একদিন অভিজিৎ দা মেইল দিয়ে মুক্তমনায় আমার ইউজারনেম পাসওয়ার্ড জানালেন! মানে, এখন থেকে আমি চাইলে মুক্তমনায় সরাসরি লেখা পোস্ট করতে পারবো- মেইল করে পাঠাতে হবে না … ! মুক্তমনা ব্লগার হয়ে গেলাম …।

তবে, সত্যি বলতে কি মুক্তমনায় সময় কমই কাটাতাম, কেননা আমার লেখালেখির বড় রসদ আমি পেতাম ধার্মিকদের ধর্মীয় পোস্টে- তর্ক বিতর্ক করতে করতে, যেটা সামু ব্লগে পাওয়া যেত। মুক্তমনায় আমার পোস্টে মাঝে মধ্যে দু একজন ধার্মিকের কমেন্ট পেতাম, কিন্তু সেগুলোতে মুক্তমনা বন্ধুরা এমনভাবে জবাব দিতো যে, আমার করার কিছু থাকতো না! ফলে, ব্লগার হিসাবে মুক্তমনায় খুব বেশি একটিভ ছিলাম- এটা বলা যাবে না। বন্ধুদের পোস্ট পড়তাম- মাঝে মধ্যে কমেন্ট করতাম- আর বেশ কিছুদিন পর পর আমার ব্লগ পোস্ট- এই হচ্ছে মুক্তমনায় পদচারণা। মাঝখানে কিছুদিন আমু ব্লগেও গিয়েছিলাম- কিন্তু যাদের আহবানে সেখানে গিয়েছিলাম- সেই মডারেটর প্যানেলের নীতিহীনতা- আমু ব্লগের প্রতি আগ্রহ দূর করে দেয়, সচলায়তনেও গিয়েছিলাম- তাদের কঠিন নিয়ম নীতি, অতিথি থেকে সচল হওয়ার জন্যে নিজ পরিচয় তাদের এডমিনকে জানানোর বাধ্যবাধকতা- সেখানেও থিতু হওয়ার আগ্রহ উবে দেয়। সামু ব্লগেই বিচরণ চলতে থাকে- সাথে ছিল মুক্তমনা। মুক্তমনায় বিচরণ কম হলেও- সবসময় মুক্তমনাকে নিজের ঘর-বাড়ির মতই মনে করতাম … মুক্তমনা ছিল (এখনো আছে) একেবারে নিজের জায়গা! মুক্তমনার ব্লগার, লেখকরা ছিলেন আপনজন …

এর পরে আসে ফেসবুকের জামানা … শুরুতে ফেসবুকের ব্যাপারে আমার একধরণের বিতৃষ্ণা ছিল … ব্যক্তিগত ডায়েরি- হাঁটে ময়দানে প্রকাশ করা, ঘন্টায় ঘন্টায় প্রোফাইল পিক চেঞ্জ করা, ছবি আপলোড করা (এখন তো সেলফি এসে একেবারে মহামারি)- ইত্যকার নার্সিজমের চর্চাকেন্দ্র হিসাবে ফেসবুককে দেখতাম, বিরক্ত হতাম এবং দূরে থাকার চেষ্টা করতাম …। কিন্তু একটা সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে এর গুরুত্ব বুঝতে পারি এবং ফেসবুকের ছোট ছোট স্ট্যাটাসের মাধ্যমে, নোটের মাধ্যমে, অনেকের সাথে চিন্তা শেয়ার করা যায়, আদান প্রদান করা যায়, এমনকি তর্ক-বিতর্কও করা যায় – এটাও অনুধাবন করতে পারি, বিশেষ করে সামু ব্লগের গুরুত্ব কমার পরে পরে যখন দেখলাম ফেসবুক নিজেই অনেকটা ব্লগের ভূমিকাও পালন করছে। সেই সাথে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার পেলাম-সেটা হচ্ছে, যোগাযোগ- সমমনাদের সাথে খুব সহজেই যোগাযোগ করতে পারছি, প্রাণ খুলে কথা বলতে পারছি, দ্বিমত থাকলে তর্কও করতে পারছি …। এই ফেসবুক এর মাধ্যমেই অভিজিৎ দা’র সাথে কিছুটা যোগাযোগ পরিচয় বাড়ে, নানা আদান প্রদান হতে থাকে। এমনিতে আমার এই নিক থেকে আমি সবসময় ব্যক্তিগত আলাপ চারিতা এভোয়েড করতাম, খুব অল্প কজনের সাথেই সেটা হতো! ফলে, অভিদার সাথেও কথা হতো অনেকদিন পর পর। আমার হয়তো- বিজ্ঞানের একটা বিষয়ে খটকা, সহজ উপায় হিসাবে অভিদা’র কাছে হাজির হলাম- বিগ ব্যাং, শক্তির নিত্যতা- ইত্যকার প্রশ্ন করে বিরক্ত করলাম- তিনি বিরক্ত না হয়ে মহা উৎসাহে সহজ করে জবাব দিতেন। আবার দেখা গেল- ফেসবুকে অমি পিয়াল-জেবতিক এদের কোন ভূমিকা নিয়ে বিচলিত আছি- এর কড়া জবাব দেয়া দরকার অনুভব করছি- নিজের সময়ও কুলিয়ে উঠতে পারছি না- ভাবছি অভিদাকে নক করে দেখি তিনি যদি কিছু লেখেন- হুট করে দেখি আমি নক করার আগেই তিনি আমাকে একটা লিংক দিয়ে ইনবক্স করছেনঃ “লিখেই ফেললাম!” এই মানুষটার সাথে আমার নানা বিষয়ে দ্বিমত, ভীষণ দ্বিমত, রাজনৈতিক বিচার পদ্ধতি, মার্কসবাদ ইত্যাদি নানা বিষয়ে তার সাথে আমার দুস্তর ভিন্নমত- কিন্তু অবাক হয়ে দেখতাম- বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম প্রসারে – প্রচারে, বিশেষ করে বাংলা অনলাইন দুনিয়ায় মুক্তচিন্তা প্রসারের ব্যাপারে ভয়ানক রকমভাবে তার সাথে আমার চিন্তার নৈকট্য! এই নৈকট্যের ব্যাপার খুব ভালো করে টের পাওয়া শুরু করলাম- আমাদের মুক্তমনাদের উপর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে। আসিফ মহিউদ্দিনকে গ্রেফতার দিয়ে যার শুরু। আমি মুক্তমনায় লেখলাম, অভিদা ঐ সময় সম্ভবত অনলাইন দুনিয়া থেকে কয়েকদিনের জন্যে বাইরে ছিলেন- ফিরে এসে সাধুবাদ দিলেন, তার কাজটি আমি করে দিয়েছি বলে। এভাবে চলেছে। মাঝখানে অন্যান্য কাজের চাপে ‘নাস্তিকের ধর্মকথা’ আইডি অনলাইনে প্রায় ইনএক্টিভ হয়ে থাকে। ২০১৩ সালে জানুয়ারি মাসে এসে আবার আক্রমণ! এবার সরাসরি শারীরিক আক্রমণ! এবারো আসিফের উপর। মুক্তমনায় আমি লেখি- অনেকেই লেখে। অভিদা মুক্তমনার বাইরেও লেখেন। মুক্তমনা পরিবার এই হত্যা প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়। এই সময়কালে অভিদা’র সাথে অফলাইনে কথা হতো। দুজনই অনুভব করতে থাকি- ভয়ানক এক আক্রমণ নামতে যাচ্ছে- মুক্তমনা ব্লগারদের উপরে। আমি বিচলিত ছিলাম আমাদের অনেক বন্ধুরা ভয়ে লেখা বন্ধ করে দিচ্ছে দেখে। অভিজিৎ দা তখন থেকে যেন অভিভাবক। তাকেই নক করে জানালাম- এভাবে তো হবে না, ভয় পেয়ে গেলে তো চলবে না- এভাবে ময়দান ছেড়ে দেয়া চলবে না। অভিজিৎ দাও জানালেনঃ

“হ্যা, দেশটা খুব বাজে দিকে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ভয় পেলে তো প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতই শক্তিশালী করা হবে। আসলে সবাই মিলে চিন্তা করার সময় এসেছে কি করা যায়। এভাবে সব কিছু তো মেনে নেয়া যায় না”।

কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই টের পেলাম- যতখানি ভেবেছিলাম, তারো চাইতে ভয়ানক আক্রমণ ধেয়ে এসেছে- মুক্তমনাদের উপরে। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন যখন নতুন প্রজন্মের হাতে একটা ইতিহাস সৃষ্টির পথে- ঠিক সেই সময়ে থাবা বাবা খুন হয়। আজ আনসার বাংলা টিমের কর্ম পদ্ধতি যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি- তাতে বুঝতে পারি, থাবা বাবাকে খুনের পরিকল্পনা শাহবাগ গণজাগরণের আরো আগেই নেয়া। যেকোন অপারেশনের অন্তত একমাস আগে খুনীদেরকে তাদের টার্গেট চিনিয়ে দেয়া হয়, তার সাথে টার্গেট এনালাইসিস, প্রশিক্ষণ, রেকি করা/ফলো করা, পরিকল্পনা ফাইনাল করা- সব কিছু মিলিয়ে শাহবাগ আন্দোলন শুরুর পরে পরিকল্পনা করে ১০ দিনের মাথায় যে এই হত্যাকাণ্ড সম্ভবপর ছিল না- সেটা নিশ্চিত বলা যেতে পারে। কিন্তু ঐ সময়ে আমরাও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। মেইন স্ট্রিম মিডিয়া থাবা বাবাকে শাহবাগ আন্দোলনের নেতা বানিয়ে দেয়, একই সাথে হেফাজত আর আমার দেশ গ্রুপও তাকে শাহবাগ আন্দোলনের নেতা বানিয়ে দেয়- কেবল পার্থক্য হলো- হেফাজতিরা তাকে বানালো চরম উগ্র নাস্তিক, আর বিডিনিউজ২৪ থেকে শুরু করে শাহবাগ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল মিডিয়াগ্রুপ জানাতে লাগলো- থাবা বাবার ব্লগ- ফেসবুকে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে তেমন কিছু পায়নি, বরং সেখানে আছে জামাত-শিবিরকে নিষিদ্ধের দাবি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি … ইত্যাদি! অর্থাৎ থাবা বাবা যেন বা নাস্তিকই নয়, নাস্তিক হলেও ব্যক্তিগত জীবনে নাস্তিক- ব্লগে অনলাইনে নাস্তিকতা নিয়ে তেমন কিছু লেখেননি, তাকে হত্যা করা হয়েছে কারণ, তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে- কারণ তিনি জামাতের নিষিদ্ধের দাবী তুলেছেন! অথচ, এদিকে আমার দেশ, সংগ্রাম টাইপের পত্রিকাগুলো থাবা বাবার লেখা পর্যন্ত ছাপিয়ে দেয় … এরই মধ্যে গণ জাগরণ মঞ্চ একের পর এক ভুল পদক্ষেপ নেয়া শুরু করে- থাবা বাবাকে গণ জাগরণের প্রথম শহীদ বানানো দিয়ে যার শুরু, তারপরে ঘটা করে শাহবাগে থাবা বাবার জানাজা পড়া, তাদের কর্মসূচিতে মসজিদ- উপসানলয়ে দোয়া দরুদ পূজার আহবান জানানো- এসবের মধ্য দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চ নিজেকে আস্তিক প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে! হেফাজতিরাও পেয়ে বসে, বিশেষ করে- ঘাপটি মেরে থাকা জামাতিরা, এমনকি প্রধান বিরোধীদল বিএনপিও সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে- অর্থাৎ শাহবাগ আন্দোলনকে নষ্ট করার লক্ষে হেফাজতিদের সাথে মিশে কাজ করতে থাকে, এবং একসময় -থাবা বাবা থেকে শাহবাগীরাই হয়ে যায় নাস্তিক। আর- গণ জাগরণ মরিয়া হয়ে ঘোষণা দিতে থাকে তারা নাস্তিক না, অতিশয় আস্তিক … এই আস্তিক্য প্রমাণের ছাপ পড়ে তাদের কর্মসূচিতে … সবকিছুর ফলাফল, নাস্তিকদের ফাসীর দাবিতে গোটা দেশের মোল্লারা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে- নাস্তিক- ব্লোগার-শাহবাগী সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় তাদের কাছে, হেফাজতিরা বড় বড় শো ডাউন করতে থাকে। আর শাহবাগ শুকাতে থাকে। তার চাইতে বড় ক্ষতি হয়ে দাঁড়ায়- দেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চার! নাস্তিকতা একটা ভয়াবহ অপরাধ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়!

এখানেই শেষ না, বরং বলা যায় শেষের শুরু! শাহবাগ আন্দোলন শুকানোর দায়ভার নাস্তিকদের দেয়া শুরু করে দেয় অনেক শাহবাগী! আওয়ামীলীগপন্থী তথা ওলামালীগ পন্থী অনলাইন এক্টিভিস্ট, শাহবাগ কর্মী, সিপি গ্যাং- এরা শুরু থেকেই নাস্তিকদের বিরুদ্ধে ছিলই, এবারে যুক্ত হয় আরো অনেক প্রগতিশীল কর্মীরাও। থাবা বাবার লেখা, ধর্মকারীর লেখাপত্র যখন সারা দেশে আমার দেশ পত্রিকার মাধ্যমে প্রচার হচ্ছে এবং শাহবাগীরা মানেই নাস্তিক – এমন প্রচার যখন প্রাধান্য পাচ্ছে, গণ জাগরণ মঞ্চের অনেক আন্দোলনকর্মীর রাগ এসে যেন থাবা বাবার উপরে পড়ে। অথচ, এরা এটা বুঝতে পারলেন না- এই লেখাগুলো থাবা বাবারা লিখেছেন আরো অনেক আগে থেকেই! তুমুল ভাবে তারা নাস্তিকদের জ্ঞান দেয়া শুরু করলেন – কেন উগ্র নাস্তিকতা ঠিক নয়, কেন উগ্র নাস্তিকতা জঙ্গীবাদের মতই সাম্প্রদায়িকতা … ইত্যাদি। অনেকের রাগ থাবা বাবার উপরে, থাবা বাবা কেবল নিজের খুনের জন্যে দায়ী নয়, সে দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর জন্যেও দায়ী … । অবাক হয়ে খেয়াল করলাম- ঠিক একই ভাষায় উগ্র নাস্তিকতার বিরুদ্ধে কথা বলছে আমাদের মুক্তমনাদেরও অনেকেই! বামমনাদের অনেকেই!! প্রগতিশীল আন্দোলনের অনেকেই!!! এর চাইতে বিচলিত, এর চাইতে বিপন্ন আর কোন সময়ে বোধ করিনি! ওদিকে সরকার বাহাদুরও নাস্তিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা নেয়ার অঙ্গীকার করলো, হেফাজতিদের আস্বস্ত করতে চাইলো …, নাস্তিক গ্রেফতারও শুরু হয়ে যায়! গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে আত্মগোপন করি, ফেসবুক প্রোফাইল ডিএক্টিভেট করি, সামু ব্লগ থেকে অনেক পোস্ট ডিলিট করে ফেলি … অন্যদিকে এরকম মুক্তমনা, বাম, প্রগতিশীল বন্ধুদের সাথে তর্ক করি, ঝগড়া করি, রেগে গিয়ে গালি গালাজ করি, আনফ্রেন্ড করি, ব্লক করি … কি এক পাগলাটে অবস্থা …! এই সময়ে সবচেয়ে শক্ত ও দারুণ ভূমিকা নিতে দেখেছি- অভিজিৎ রায়কে- আমাদের অভি দা- একা একটার পর একটা লেখা লিখে জানিয়েছেন- উগ্র নাস্তিকতা বলে কিছু নেই- কলমের উগ্রতার জবাব কলম দিয়েই দিতে হয় …! আমি ভয় পেয়ে আমার আইডি থেকে এই ডিবেট, এই আলোচনা ঐ সময়ে করতে পারিনি, করেছি- অন্য আইডি থেকে- ব্যক্তিগত মেসেজ চালাচালিতে বা কারো স্ট্যাটাসের কমেন্টে! কিন্তু যেটা খুব দরকার ছিল- একটা শক্ত অবস্থান নেয়া- সেটা একমাত্র অভিজিৎ দা-ই সেসময়ে নিতে পেরেছিলেন! আসিফ মহিউদ্দিন, আরিফুর রহমান সহ আরো অনেকেই শক্ত অবস্থান নিয়েছেন, কিন্তু তারা নিজেরাই তো তথাকথিত উগ্র নাস্তিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত- ফলে দরকার ছিল অভিজিৎ দার মত কারো এমন একটা শক্ত অবস্থান নেয়ার … সেটা তিনি নিয়েছিলেন! এই কথাটি, এই অবদানটি এভাবে বলছি- কারণ, এবারো যখন টানা নাস্তিক নিধনের উৎসব শুরু হলো, তখন আমাদের মুক্তমনায় ফরিদ আহমেদ- সেই একই ভাষায় উগ্র নাস্তিকতাকে দায়ী করলেন! আসিফ মহিউদ্দিনের কাবাকে রাঙানোর ছবি পোস্টকে কেন্দ্র করে- বিভিন্ন মুক্তমনা বন্ধুরা- আসিফের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জানালো- এইসব উগ্রতার কারণেই আজ নাস্তিকদের এমন করুন দশা, মুক্তমনার মতো ওয়েবসাইটে- “নাস্তিক হত্যায় আমাদের দায়” নামে পোস্ট পাবলিশ হয়! যাদের কাছে প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি, তাদের এমন সব অবস্থান দেখে মাঝে মধ্যে হতাশা তৈরি হয়, পুরাটা সময় – আমি শুধু অভিদাকে হাতড়ে বেড়াই, ভাবি- অভিদা থাকলে এবারো তিনি নিশ্চয়ই শক্তভাবে দাঁড়াতেন …

নাস্তিকদের- মুক্তমনাদের কোন কর্মপদ্ধতি বেশি কার্যকর- এই প্রশ্নে আমি ফরিদ আহমেদ, সুব্রত শুভ সহ যারা কথা বলছেন- তাদের সাথে খুবই একমত! আমি অবশ্যই মনে করি, আমার যদি উদ্দেশ্য হয়- একটা সেক্যুলার সমাজ নির্মাণ, আমার যদি উদ্দেশ্য হয়- আস্তিক, ধার্মিক, বিশ্বাসী মানুষদের মাঝে কাজ করে তাদের পাল্টানো- তবে কখনোই তাদের প্রতি চুড়ান্ত অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা, ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে এতটুকু অগ্রসর হওয়া সম্ভব না! তাদের বিশ্বাসকে, অনুভূতিকে আঘাত দিয়ে, আহত করে তাদের পাল্টানো বা পথে টানা কঠিন, বরং উল্টোটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি- আহত হয়ে তারা আরো বেশি করে বিশ্বাসকে আকড়ে ধরতে পারে! শুরুতেই যদি কানে তুলা দিয়ে রাখে, তবে আমাদের কথা তাদের কানে পৌঁছাবে কি করে, আর আমাদের চিন্তা, যুক্তি তাদের চিন্তা-মননে-বোধে কিভাবে ক্রিয়া করবে? কিভাবে প্রশ্ন তৈরি করবে? কিভাবে নিজেদের মধ্যে লালিত বিশ্বাসকে প্রশ্নের মধ্যে ফেলবে? এই জায়গা থেকে আমি অবশ্যই মনে করি, ধর্ম- ধর্মীয় বিশ্বাস- ধর্মীয় প্রাণপুরুষদের নিয়ে স্যাটায়ার, টিটকারী, অপমানসূচক কথাবার্তা- এসবের চাইতে যুক্তিবুদ্ধির পথ অনেক কার্যকর, বিজ্ঞান চেতনা বা বিজ্ঞান মনস্কতা তৈরি করা, তাদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করে দিতে পারা অনেক অনেক কাজের! আরজ আলী মাতুব্বরের সহজ সরল প্রশ্নগুলো যে কত ধর্মপ্রাণ মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, কতজনকে আলোর পথ দেখিয়েছে- দেবীপ্রসাদের ‘যে গল্পের শেষ নেই’, বন্যা আহমেদের ‘বিবর্তনের পথ ধরে’, প্রবীর ঘোষের ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’, অভিজিৎ রায়ের ‘বিজ্ঞানময় কিতাব’- এই বই/ প্রবন্ধগুলো নীরব ঘাতকের মত কত যে ধার্মিকের বিশ্বাসের মর্মবস্তুকে আঘাত করে চলেছে! কোন সন্দেহ নেই যে, এরকম যুক্তিপূর্ণ আলোচনা, লেখাপত্রই অনেক অনেক বেশি কাজের। কিন্তু, তার মানে এই না যে, আরেকজন স্যটায়ার করতে পারবে না, টিটকারী করতে পারবে না, কাবাকে রংধনু রঙে রাঙাতে পারবে না! কেন আমি বা আমরা ভাবছি- আমাদের সকলের একই রকমের উদ্দেশ্য থাকবে? কেন আমি ভাবছি যে, আমরা সকলেই আস্তিকদের ধরে ধরে মায়া মমতা দিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে নাস্তিক বানানোর মিশনে নেমেছি? কোন একজন তো – কেবল মনের আনন্দে একটা মজা বা স্যাটায়ার করতে পারে বা তার মনের রাগ ক্ষোভ ঝাড়তেও একটা লেখা লেখতে পারে! একজন নাস্তিক তার পরিবার, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব- চারপাশের যাবতীয় ধার্মিক ব্যক্তিদের হাতে নানা ভাবে নিগৃহীত, লাঞ্ছিত, অপমানিত হয়ে যদি সে ধার্মিকদের নিয়ে, ধার্মিকদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে- মনের ঝাল মেটায় তার লেখনিতে- সেটার জন্যে কেন আমি তার প্রতি রুষ্ট হবো? বুঝতে হবে, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামনব বলে যাদের দাবী করা হয়- তাদের জীবদ্দশাতে এমন সব আচার, জীবনাচরণ পাওয়া সম্ভব যা হাস্যরস তৈরি করতেই পারে! মহান চরিত্রের অধিকারী হিসাবে আখ্যা দেয়া মুহম্মদকে বা কৃষ্ণকে কেউ যদি লম্পট বা লুচ্চা বলে- তাতে কোন ভুল নেই যেহেতু, সেহেতু তাকে এর জন্যে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় না! অসংখ্য ভুলে ভরা কোরআন, বেদ, বাইবেলকে যখন ধার্মিকরা যাবতীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আধার বলে দাবী করে- তখন এর চাইতে হাস্যকর বিষয় আর কি হতে পারে? ফলে- কেউ যদি সেই হাসি তামাশা টিটকারী করে- তাতে আমি কোন ভুল পাই না, অপরাধ তো নয়ই …! বড়জোর তাদের এতটুকু বলতে পারি, ভাই এভাবে ধার্মিকদের পাল্টাতে পারবা না, ভাই- এভাবে মুহম্মদ- কৃষ্ণকে হাজারবার লুচ্চা বলেও ধার্মিকদের মনের শ্রদ্ধা এতটুকু কমাতে পারবা না, কোরআন-বাইবেল এর উপর চায়ের কাপ রেখে, পা দিয়ে মাড়িয়ে, পুড়িয়ে এই গ্রন্থগুলোর অলৌকিকতা সম্পর্কে এতটুকু সন্দেহ দূর করাইতে পারবা না! ব্যস- এতটুকুই বলতে পারি! কিন্তু কেউ যখন বলে- এভাবে ধার্মিকদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়া ঠিক না, এমন করা ঠিক না, এতে ধার্মিকরা আরো জঙ্গী হয়ে উঠবে, এর কারণেই নাস্তিকদের ধরে ধরে খুন করা হচ্ছে … ইত্যাদি, তখন আমি তীব্রভাবে দ্বিমত করি, আপত্তি জানাই এবং আরো জোরেশোরে দাবী তুলতে চাই যে, সমস্ত ধর্মগ্রন্থ, ধর্মপুরুষ, ধর্মালয় নিয়ে স্যাটায়ার, সমালোচনা, হাসি তামাশার অধিকারও আমাদের আছে, থাকা উচিৎ!

২০১৩ সালে যখন হেফাজতিরা, আমার দেশ গ্রুপ থেকে শুরু করে তথাকথিত প্রগতিশীল, মডারেট-ভদ্র মুক্তমনারা পর্যন্ত প্রমাণ করে ছাড়লো যে, থাবা বাবা একজন উগ্র নাস্তিক, একজন বাজে লেখক, ইসলামকে নিয়ে চটি টাইপের অশ্লীল লেখার লেখক, তখন অভিজিৎ রায় শক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে বলেছেন,

“রাজীব কেমন লিখতো, তার লেখা মানোত্তীর্ণ কিনা, তার লেখা যুক্তিবাদী আন্দোলনকে পেছনে হটিয়ে দিচ্ছে কিনা – এ নিয়ে হাজারো তর্ক করা যায়, কিন্তু একটি বিষয়ে আমরা বোধ হয় একমত হতে পারি – মত প্রকাশের জন্য মৃত্যু তার অভীষ্ট হতে পারে না”।

‘থাবা বাবা যুক্তিবিহীন অশ্লীল বক্তব্য দিয়ে ধর্মীয় বিষয়ে কটাক্ষ করেছেন’ এমন অভিযোগের জবাবে অভিজিৎ রায় বলেছেনঃ

“রাজিবের চেয়ে ঢের অশ্লীল, কুৎসিৎ এবং বিদ্বেষী বক্তব্য ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মপ্রচারকদের জীবনেই পাওয়া যায়। নারীকে শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করা, বিধর্মীদের কতল করা, শুদ্রদের পশ্চাৎ দেশে গরম লৌহ শলাকার ছ্যাকা দেয়া, যুদ্ধবন্দিনী কিংবা পালকপুত্রের স্ত্রীকে দেখে লালায়িত হয়ে সহবাস করার আয়াত বা শ্লোকগুলো রাজীবের লেখার চেয়েও ঢের বেশি অশ্লীল। ততোধিক অশ্লীল হচ্ছে মনু সংহিতা কিংবা মকসদুল মোমেনীনের মত কুগ্রন্থগুলো। নয়?”

ব্যাপার হচ্ছে- অশ্লীল, যুক্তিহীন লেখাই শেষ কথা নয়, বা মূল বিষয় নয়, আসল কথা হচ্ছে- ধর্মানুভূতিতে আঘাত পাওয়া। থাবা বাবাকে মারা হয়েছে বা আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে- কারণ তারা ধর্মানুভূতিকে আঘাত দিয়ে লিখেছেন। আমাদের অনেকেই ভাবছি- তাদের লেখা একটু বেশী খোলামেলা টাইপের আক্রমনাত্মক, মানের দিক থেকেও ভালো না- গালিগালাজ, খিস্তিখেউড়ে ভরা, সুতরাং এসবে তো ধর্মানুভূতি আহত হতেই পারে। কিন্তু আমরা এমনটা ভাবতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছি- এই ধর্মানুভূতি ব্যাপারটাই কতখানি হাস্যকর একটা বিষয়, এটা কতখানি আপেক্ষিক ও বায়বীয় ব্যাপার! কবে যে কার কাছে কোনটা ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিবে, বলা মুশকিল! মিলাদের সময়ে ইয়া নবী সালায় মালায় কা- দাঁড়িয়ে বলা হবে না বসে বলা হবে এটাকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপ পরষ্পরের বিরুদ্ধে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ টেনে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে- এমন নজিরও আছে। ২০১৩ সালে হেফাজতিরা তালিকা তৈরি করে সরকারের জমা দেয়ার সময় অনেক ব্লগারের ব্যাপারে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের তথ্য প্রমাণও জমা দিয়েছিল। তাতে অভিজিৎ রায়ের নামে যে ফাইলটি ছিল- সেখানে বড় অংশ জুড়ে ছিল- সমকামিতার পক্ষে অভিজিৎ রায়ের বক্তব্য, লেখালেখি, বই পত্র! থাবা বাবার মত ঘৃণিত নাস্তিকের হত্যার প্রতিবাদ জানানোও কারো কারো কাছে যে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের সমান- সেটা ঐ সময়ে অভিজিৎ দা’র অনলাইন নিউজ পোর্টাল সমূহে প্রকাশিত প্রবন্ধের নিচে থাকা কমেন্টগুলো দেখলেই বুঝা যেত! ২০১৫ সালে এসে আমরা অনেক দাম দিয়ে বুঝলাম।

২০১৩ সালেই যেটা শুরু হয়েছিল, মাঝখানে বছর দুয়েকের বিরতি দিয়ে এ বছর আবার সেটা শুরু হয়েছে! ঘটনাগুলো মিলিয়ে দেখলে বুঝা যায়- এরকম পরিকল্পনা সম্ভবত ২০১৩ সালেই ছিল, প্রতিমাসে একজন করে নাস্তিক হত্যা, শুরুতে আসিফ মহিউদ্দিন জানুয়ারি মাসে, তারপরে ফেব্রুয়ারিতে থাবা বাবা … হয়তো পরিকল্পনায় মার্চ- এপ্রিল নাগাদ আরো কেউ একজন ছিল …। গণ জাগরণ মঞ্চ, হেফাজত ইত্যকার নানা পরিস্থিতি, নাস্তিকদের ফাসীর দাবীতে সারাদেশে জনমত গঠন, নাস্তিকদের গ্রেফতার- প্রভৃতির মধ্য দিয়ে সারাদেশে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে একটা পরিবেশ তৈরি করা- সব মিলিয়ে সম্ভবত খুনীরা ঐ সময়ে সাময়িক বিরতি টেনেছিল। তারপরে বছর দুই ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে, ক্যাডার রিক্রুট করছে, শক্তি সামর্থ্য অর্জন করেছে এবং এ বছর এসে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেমে পড়েছে, একের পর নাস্তিক হত্যার মহা-উৎসব শুরু করেছে! কোন কুক্ষণে যে, অভিজিৎ রায়, আমাদের অভিদা- দেশে এসেছিলেন! এসে জঙ্গীদের নাস্তিক হত্যার এই মহোৎসবের প্রথম বলি হলেন! তার পরে একে একে ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় এবং সর্বশেষ নিলয় নীল- মূল্যবান তরতাজা প্রাণ তারা কেড়ে নিল …! আমরা হারালাম, আলো হাতে আঁধারের যাত্রীদের!

ফেব্রুয়ারি বইমেলার শেষ দিকে হুমায়ুন আজাদকে চাপাতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল! ১১ বছর পর একই সময় কালে, প্রায় একই জায়গায় অভিজিৎ রায় আর বন্যা আহমেদের উপর চাপাতির আঘাত নেমে আসে। আমি অফিস থেকে ফিরে রাতে খেতে বসেছিলাম, এক বন্ধুর ফোনে শুনলাম ভয়ঙ্কর এই ঘটনাটা, শুনলাম আহতাবস্থায় দুজনই ঢাকা মেডিক্যালে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফোনে শুনলাম- খবর খুব খারাপ, অভিজিৎ দা সম্ভবত নাই … সেই রাতে হরতাল- অবরোধের বোবা রাতগুলোর একটা- যখন রিকশায় উঠছি, ফোনে শুনতে পেলাম- টেলিভিশনে স্ক্রলে দেখাচ্ছে- অভিজিৎ দা আর নাই …। ঢাকা মেডিকেল এর ইমার্জেন্সীর সামনে ছোট জটলার মধ্যে বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, বুঝে উঠতে পারি না- কি হলো, কিভাবে হলো, এখন কি করণীয়! অভিজিৎ দা কবে এলেন, কেন এলেন, কেন এলেন- মাথায় শুধু এটাই ঘুরতে থাকে! পরদিনের টিএসসি’র প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশেও একইরকম হতভম্ব দাঁড়িয়ে থাকি …! জীবনটা মনে হতে থাকে- যেন আটকে গেছে, আর বোধ হয় একে নড়ানো বা সরানো সম্ভব নয়! অভিজিৎ দা’র চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আবিস্কার করলাম- এই মানুষটা আমার ভীষণ আপন ছিল, এত প্রিয়, এত শ্রদ্ধার, এত ভালোবাসার আসনে যে তিনি ছিলেন- দুটোদিন আগে টের পেলেও হয়তো, আমার (নাস্তিকের ধর্মকথার) নিভৃত যাপন দূরে ঠেলে তার সাথে দেখা করতাম, হাত দুটো ধরে ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’কে আমার শ্রদ্ধাটুকু জানাতে পারতাম …

অভিদা আরো ৪০/৪৫ টি বই, হাজার খানেক ব্লগ-ফেসবুক পোস্ট, পত্রিকার আর্টিকেল লেখতে পারতেন! বিজ্ঞানের নানা কঠিন বিষয় সহজ ভাষায় আমাদের সামনে হাজির করতে পারতেন। অন্ধকার, কুসংস্কার, ধর্মীয় কুপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার খুরধার লেখনিতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। আজকের এই চরম আধারে তিনি আলো হাতে আমাদের পথ দেখাতে পারতেন। কি অপরিমেয় ক্ষতি! আমি হারালাম আমার একজন প্রকৃত বন্ধু, বড় ভাই, অভিভাবক এবং সুহৃদকে যিনি যেমনই লেখিনা কেন, পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দিতে ভুলতেন না! মানুষটাকে জানাতে পারলাম না পর্যন্ত যে- তুমি আমার পরম আপন জন, আমার বন্ধু, আমার ভাই, আমার অভিভাবক, আমার পরম শ্রদ্ধার একজন …!

এই মানুষটা কি ভয়ানক সুন্দর! তার সৃষ্টি, তার লেখা, সংগ্রাম- এসব বাদ দিয়ে একজন মানুষ হিসাবেই তিনি ভীষণ চমৎকার! তর্ক বিতর্ক ক্যাচাল ঝগড়া- সব কিছুকে তিনি চিন্তার জগতের দ্বিমত হিসাবেই রাখতে পারতেন, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার প্রভাব তিনি ফেলতে দিতেন না এতটুকু। তর্ক-বিতর্কের সময়ে এতটুকু ছাড় তিনি দিতেন না, কিন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধটুকু ঠিকই বজায় থাকতো! আজকে আমাদের মুক্তমনা নাস্তিকদের নানা মত, নানা পথ, নানা ক্যাচালের সময়ে একেকজনে দাত-মুখ খিচানো দেখে আমার কেবলই মনে হয়- এই মানুষটার কাছ থেকে কত কি শেখার আছে আমাদের … ! আর, তার বিনয়! আজ আমাদের সামান্য ফেবু সেলিব্রেটি থেকে রথী মহারথীদের “আমি”, “আমি”, “আমি” এবং “মুই কি হনুরে”র ভিড়ে অভিদা ছিলেন ভয়ানক ব্যতিক্রম! তাকে নিজের কথা বলতে হতো না, তার কাজের মধ্য দিয়েই তাকে পাওয়া যেত, বুঝা যেত তার বড়ত্ব! হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন প্রজন্ম হিসাবে গড়ে ওঠা আমাদের অনেক মুক্তমনা বন্ধুদের যখন খুব হামবড়া ভাব দেখিয়ে “আমি” “আমি” করতে দেখি- তখন ভাবি- অভিদাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রজন্ম নিশ্চয়ই আমরা পাবো- যাদের মাঝে বিনয় থাকবে, একই সাথে থাকবে ভয়ানক তেজ- যে তেজ যাবতীয় অন্যায়- অন্ধকার- কুসংস্কারকে পুড়ে ছাই করতে উদ্যত হবে …! আর, অভিদা’র সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা – যা ইতোমধ্যে অনেকের লেখাতেই এসেছে- সেটা হচ্ছে, অন্যকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা! এই কাজটা পরম নিষ্ঠার সাথে করে গেছেন! ছোট থেকে বড়, সকলকেই তিনি মুক্তমনা লেখক বানানোর মিশনে নেমেছিলেন যেন! যেখানে যে মুক্তচিন্তা নিয়ে লেখছে- তাকেই তিনি আপহোল্ড করতেন, এবং উৎসাহিত করতেন! মন দিয়ে তাদের লেখা পড়তেন, তার মতামত জানাতেন এবং ভীষণভাবে আরো লেখার জন্যে অনুপ্রাণিত করতেন। ছোট করে অজয় রায় স্যার আর বন্যা আপার কথা না বললেও হচ্ছে না … ! তাদের অব্যাহত সংগ্রাম দেখি আর অবাক হয়ে ভাবি- কিভাবে পারছেন তারা? কোথা থেকে পান তারা এত শক্তি? ব্যক্তিগত শোককে কিভাবে তারা তাদের সংগ্রামে পরিণত করেন? অবাক হয়ে যাই, যত দেখি আরও অবাক হই! তাদের কাছ থেকে শক্তি পাই, মনে হয়- হাল ছাড়ার সময় আসেনি এখনো- যেতে হবে বহু দূর …

অভিদার লেখা, তার সৃষ্টি নিয়ে অনেকে আলোচনা করবেন, করেছেন- আমি সেদিকে বিস্তারিত যাচ্ছি না! এই লেখাটা আমার ব্যক্তিগত মনোলগের মত করেই লেখার চেষ্টা করেছি! অভিজিৎ রায় আমার কাছে অভিজিৎ রায়- কারণ তার মুক্তমনা ওয়েবসাইট, আমদের মুক্তমনা ওয়েবসাইট! তিনি যদি, আর কিছু নাও করতেন- আর কোন বই নাও লেখতেন- শুধু এই মুক্তমনার কারণেই তাকে স্মরণ করতে হতো- আমাদের দেশে মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি, নাস্তিকতা, সেক্যুলারিজম প্রসারে মুক্তমনার অবদান অদ্বিতীয়। অভিদা’র বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারী হচ্ছে-“সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান”। কেননা বাংলা ভাষায় এই বিষয়ের উপরে এরকম বই এটাই প্রথম এবং এখনো পর্যন্ত সম্ভবত একমাত্র! বাংলাদেশে যদি কখনো সমকামিদের বা এলজিবিটিদের আন্দোলন তৈরি হয় ও সফলকাম হয়, তবে- তাদের এই বইটার কথা স্মরণ রাখতেই হবে! এবারো যখন সমকামিতা নিয়ে অনলাইনে যুক্তি তর্ক শুরু হলো, অবধারিতভাবে রেফারেন্স হিসাবে এই বইটা চলে এসেছে, তার চাইতেও বড় কথা- বিস্ময়করভাবে সমকামিদের অধিকারের পক্ষে যে আজ এত মানুষ দাঁড়ালো- তার পেছেওনেও সবচেয় বড় অবদান এই বইটির (আফসোস! অভিদা দেখে যেতে পারলেন না)! আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্ব ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, সমকামিতা, শুন্য থেকে মহাবিশ্ব- বিজ্ঞানকেন্দ্রিক এই বইগুলো পড়লে অনুযোগ তৈরি হতো, হয়- তার মাপের একজন বিজ্ঞান লেখক কেন বিজ্ঞান নিয়ে এত কম লিখছেন! স্বতন্ত্র ভাবনা (সংকলন), অবিশ্বাসের দর্শন, বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (সংকলন)- ধর্মানুভূতিকে প্রচণ্ড আঘাত দিয়ে এই ধরণের অনুভূতি-বিশ্বাস সব ভেঙ্গেচুড়ে ঝেটিয়ে বিদায় করার মত দারুণ তিনটি বই …। আর মুক্তমনা জুড়ে আছে- আরো অসংখ্য চমৎকার সব প্রবন্ধ! কিন্তু এসবের মাঝে- আমার মাথায় কেবল ঘুরছে- সেই বইটার কথা, যেটি আমি প্রথমে হেলায় রেখে দিয়েছিলাম! আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী! এই বইটিতে আলো হাতে চলা আঁধারের যাত্রীদের কথা যখন অভিজিৎ রায় লিখছেন, তখন নিজেও কি সেই পথের যাত্রী হওয়ার তাড়না বোধ করেননি, প্রেরণা টুকু পাননি? বইটি যখন পড়ি, তখন চোখের সামনে ভাসতে থাকে- এ সময়ের আলো হাতে চলা একজন আঁধারের যাত্রী- অভিজিৎ রায় …।

আমি অনুভব করতে থাকি, অভিদা চলে গিয়েও আমাদের মাঝে অনেক বেশি করে আছেন! তিনি এখনো আলো হাতে আঁধারে পথ দেখাতে দাঁড়িয়ে আছেন! আমিও নিজের ভেতরে তাড়নাবোধ করি! অভিদার হাতের আলো আমাদের সকলের হাতে উঠে আসুক। প্রতিটা মুক্তমনা হয়ে উঠুক আজকের আলো হাতে চলা আঁধারের যাত্রী।