নিরাপত্তার স্বার্থে মানুষটির আসল নাম বলছি না। ধরুন ছেলেটির নাম মির্জা মোশরফ আহমদ। বয়স ১১। হঠাৎ একদিন একদল লোক তাদের বাড়িতে এসে হাজির। পরিবারের অন্যদের মারধর করছে আরেকজন তার কান চেপে ধরে সুন্নি মুসলিম হওয়ার জন্য দীক্ষা দিচ্ছে। নাহ এটা কোন গল্প নয়। ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রামে হয়েছিল এমন বর্বর ঘটনা। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের এমন আচরণের বিচার রাষ্ট্র করে নি। রাষ্ট্রের নীরবতার কারণে তাদের উপর অনেক সময় এমন নির্যাতন, বর্বরতা নেমে আসে। হ্যাঁ, আমি আহমদিয়া, বাহাই সম্প্রদায়ের কথা বলছি।
মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি ১৮৮৯ সালে আহমদিয়া মতবাদের এর প্রবর্তন করেন। তিনি ছিলেন পূর্ব পাঞ্জাবের অমৃতসর এলাকার কাদিয়ান গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর অনুসারীরা আহমদিয়া এবং কাদিয়ানি উভয় নামেই পরিচিত। এ আন্দোলন সর্বপ্রথম বাংলায় আসে ১৯১২ সালে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মীর সৈয়দ আবদুল ওয়াহেদের মাধ্যমে। তাঁর দীক্ষার পর কয়েকশত লোক এ আন্দোলনে যোগ দেয়। ১৮৮৯ সালে মির্জা গোলাম আহমদ ঘোষণা করেন যে, তিনি একটি দৈববাণী পেয়েছেন, যাতে তাঁকে এ মতবাদে বিশ্বাসীদের আনুগত্য গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। পরবর্তীকালে তিনি নিজেকে মেহেদি এবং মাসীহ বলেও ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা মৌলানা নুরউদ্দিনকে তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচিত করেন। নুরউদ্দিনের মৃত্যুর পর ১৯১৪ সালে সম্প্রদায়টি ভাগ হয়ে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুসারীরা কাদিয়ানে থেকে যায় এবং তারা গোলাম আহমদকে নবী বলে স্বীকার করে। ১৯৪৭ সাল থেকে এ শাখা ‘জামাত-ই-আহমদিয়া’ নামে পাকিস্তানের রাবওয়াহ থেকে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে। অন্য শাখাটি গোলাম আহমদকে একজন সংস্কারক বলে স্বীকার করে এবং তারা লাহোরে ‘আহমদিয়া আঞ্জুমান ইশাত-ই-ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করে।
আহমদিয়া মতবাদের সাথে ইসলামের শরিয়তিপন্থীদের কিছু মতপার্থক্য আছে। তারা মনে করে যে, ১৫০০ বছরের আগের তৈরি করা আইন যুগের কারণে সংস্কার কিংবা পরিবর্তন হওয়া উচিত। তারা মনে করেন এটা দোষের কিছু নেই। বাজারে সংখ্যাগুরুরা আহমদিয়াদের নিয়ে অনেক গুজব কিংবা বানানো গল্প চালু রেখেছে। যেমন- তারা প্রচার করে আহমদিয়ারা নবী মুহাম্মদকে মানে না। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আহমদিয়ারা বিশ্বাস করে হযরত মুহাম্মদ (স.) খাতিমুন নবীইন বা শেষ রসুল ছিলেন না, তিনি ছিলেন খতমুন নবীইন বা নিখুঁত ও পূর্ণ রসুল। তাদের মতে, তিনি এত মহান ছিলেন যে তাঁকে অনুসরণ করে কোনও ব্যক্তি কেবল নিম্ন স্তরের রসুল হতে পারে, পূর্ণ রসুল নয়। আহমদিয়ারা দাবি করে যে, তাদের সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি ছিলেন এ স্তরের লোক। এছাড়া আহমদিয়া সম্প্রদায় মনে করেন আল্লাহ সব জায়গায় বিরাজমান। শরিয়পন্থী মুসলিমরা এটা মানেন না। তারা কোরানের বিভিন্ন আয়াত উল্লেখ করে বলতে চায়; আল্লাহ পবিত্র জায়গাতেই থাকতে পারেন অন্য কোথাও না। যাই হোক শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগুরুর চাপে পাকিস্তান আহমদিয়া অর্থাৎ কাদিয়ানীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
আমাদের আলাপের বিষয় আহমদিয়াদের ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা শরিয়তি ইসলামের সাথে তাদের কতোটুকু মতভেদ সে বিষয় নয়। আমাদের আলোচনার বিষয় বাংলাদেশে এর উপর যে নীরব নির্যাতন চলে সেই বিষটি। এরা নিজেদের কখনো অমুসলিম না বললেও সংখ্যাগুরু বিশেষ করে সুন্নিরা তাদের মুসলিম বলে স্বীকার করে না। ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশদের থেকে আহমদিয়া সম্প্রদায় বিদ্যালয় বানানো এবং সম্প্রদায়ের পক্ষে অনেক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। এখানে স্মরণে রাখা উচিত আহমদিয়াদের অনেকে কাদিয়ানী বললেও আহমদিয়া এই “কাদিয়ানী” ডাকটা অপমানজনক হিসেবে দেখে।
ধর্মের ভিত্তেতে দেশ ভাগের পর জামাত-ই-ইসলামের স্রষ্টা মওদুদী আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই মওদুদী পাকিস্তানকে খোদাদাদ বা আল্লাহ দান বলে ঘোষণা করেন। অথচ এই মওদুদী জিন্নাহ, পাকিস্তান, মুসলিম লীগ সম্পর্কে অসংখ্য সমালোচনা করেছেন। কিন্তু পাকিস্তান থেকে যখন তারা অতীতের লেখাগুলো পুনরায় ছাপা হয় তখন সেসব অংশ ছেঁটে ফেলা হয়। ‘আহমদিয়া সমস্যা’ নামে মওদুদী একটি বই লেখেন। পাকিস্তান সরকার বইটি নিষিদ্ধ করার আগেই ১৮ দিনে বইটির ৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। ১৯৫৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবে মওদুদী আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে লাহোরে হামলা শুরু করলেন। এর ফলে কয়েক হাজার আহমদিয়া হত্যার শিকার হয়। এর জন্য মওদুদীকে গ্রেফতার করে বিচার হোল এবং ফাঁসির আদেশ দেয়া হোল। পরে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপে তার ফাঁসি রদ করা হয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল; ১৯৫৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি একজন আহমদিয়ার করব দেওয়াকে কেন্দ্র করে আহমদিয়াদের উপর অত্যাচারের সূত্রপাত হয় এবং আহমদিয়াদের হত্যা, তাদের বাড়িঘরে আগুন জ্বালানো থেকে শুরু করে লুটপাটের মতো ভয়াবহ রূপ লাভ করলে ৪ মার্চ পাকিস্তানে প্রথম আঞ্চলিক মার্শাল ল জারি হয়। মূলত এই দাঙ্গার কারণেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রথম দেশ শাসনের স্বাদ গ্রহণ করে। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে যে হত্যা শুরু হয় যা চলে ১১ মে পর্যন্ত। এবং তাতে নিহত হয় কম করে পাঁচ হাজার।
বাংলা উইকিপিডিয়াতে নোবেল বিজয়ী পাকিস্তানী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালামের বিবরণীতে তিনি কোন ধর্মে তার কোন উল্লেখ নেই। যারা লিখেছে তারা কি আহমদিয়া পরিচয়টুকুর কারণে এই বিষয়টি উল্লেখ করে নি? এই বিষয়ে সংশয় তেকেই যায়। যাই হোক আবদুস সালাম শেষ জীবনে হয়তো সংশয়বাদী ছিলেন তবে তিনি যেহেতু আহমদিয়া পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছে সেহেতু নোবেল পাওয়ার পর অনেক সংবাদপত্রে লেখা হোল আবদুস সালামের মত একজন আহমদিয়াকে নোবেল পুরষ্কার দেয়াটা পশ্চিমাদের ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র। পাকিস্তান সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘নিশান-ই-পাকিস্তান’ দেয়। তবে অনেকেই মনে করেন পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়েই এই খেতাবটি দেয়। ১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর অক্সফোর্ডের বাড়ীতে মারা যান আবদুস সালাম। মৃত্যুর পর তাঁকে দাফন করা হয় রাবওয়াতে। আহমদিয়াদের নিজেদের শহর- রাবওয়া। কিন্তু রাব-ওয়া নামটাও গ্রহণযোগ্য নয় সেখানে। রাবওয়া নাম বদলে রাষ্ট্রীয় হুকুমে নাম রাখা হয়েছে- চেনাব নগর। চেনাব নগরে আবদুস সালামের সমাধি-ফলকে লেখা ছিল: “Abdus Salam the First Muslim Nobel Laureate”। সমাধি-ফলক স্থাপনের পর পুলিস সাথে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট এসে মুসলিম শব্দটা মুছে দেন। তাতে লাইনটি দাঁড়ালো “Abdus Salam the First Nobel Laureate”। এর যে কোন অর্থ হয় না তাতে কিছু আসে যায় না আইনের ও ধর্মের অনুসারীদের।
২০১৩ সালে শাহবাগের বিপরীতে হেফাজত ইসলামের জন্ম হয়। শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা দাবী পেশ করে। সেই দাবীর একটি দাবী ছিল-সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের (আহমদিয়া) অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। হেফাজতে ইসলাম যেহেতু সুন্নি সংগঠন সেহেতু তারা এমন একটা দাবী তুলবে তা স্বাভাবিক বিষয় ছিল। বাংলাদেশে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বদলে শিয়া সম্প্রদায় থাকলে হয়তো তাদের বিরুদ্ধে এমনটি উচ্চারণ করার সাহস পেত না। এর মানে এই না যে শিয়াদের তারা মেনে নিয়েছে। বর্তমানে শিয়াদের যেহেতু ক্ষমতা, অর্থ হয়েছে সেহেতু শরিয়তপন্থীরা শিয়াদের মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। তবে এখনও শিয়া সুন্নিদের বিরোধ আছেই। শিয়াদেরও তারা কাফের বলে। তবে কাদিয়ানিদের অবস্থা শিয়াদের থেকে নাজুক। এখানে বলে রাখা শিয়ারাও অত্যাচার কম করে না। যাই হোক, বাংলাদেশে এক সময় কয়েক লক্ষ কাদিয়ানি ছিল। বর্তমানে তা হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশে আহমদিয়া মসজিদে হামলা, ধরে ধরে কনভার্ট করার মতন ঘটনা ঘটছে নীরবে। কিন্তু প্রশাসন ও রাষ্ট্র সবসময় এই বিষয়টিতে উদাসীনতা দেখিয়ে আসছে। বাংলাদেশে আহমদিয়াদের উপর হামলার সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে ১৯৯৯-২০০৬ পর্যন্ত। তবে বিএনপি-জামাত সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ২০০৩ সালে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উপর সবচেয়ে বড় হামলা আসে। সে সময় আমাদের পত্রিকাগুলো বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। পাকিস্তানের মতন বিভিন্ন দেশে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উপর হামলা অব্যাহত আছে। নিচের ছবিটি ইন্দোনেশিয়ার আহমদিয়া মসজিদে হামলার ছবি।
আহমদিয়াদের উপর শুধু সংখ্যাগুরু মুসলিমরাই ক্ষেপা না। পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের উপর হামলা অব্যাহত রাখছে। তেহরিক-ই-তালেবান থেকে শুরু করে অনেক জঙ্গি সংগঠন আহমদিয়াদের উপর হামলা করে। বাংলাদেশে বোমা হামলার মতন ঘটনা না ঘটলেও জোর করে সুন্নিতে কনভার্ট করা, পিটানোর মতন ঘটনা ঘটেছে। ২০১১ সালে গাজীপুরে আহমদিয়া জামাতের সম্মেলন আয়োজন করা হয়, কিন্তু প্রতিপক্ষের বাধার মুখে প্রশাসন শেষ মুহূর্তে অনুমতি বাতিল করে। এছাড়া ২০ নভেম্বর ২০১৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আহমদিয়াদের সাথে মাদ্রাসার ছাত্রদের ঝামেলা হয় । International Khatme Nabuyat Movement (IKNM) নামের একটি সংগঠন আছে যারা আহমদিয়াদের উপর অত্যাচার চালায় ও অত্যাচারের নেতৃত্ব দেয়। ‘খতমে নবুয়ত’ নামের এই সংগঠনটি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আহমদিয়াদের উপর হামলা ও তাদের সুন্নি মুসলিমে ধর্মান্তরিত করার ঘৃণিত কাজ করে আসছে। আহমদিয়াদের উপর হামলা বেশির ভাগ সময় চেপে যাওয়া হয়। তারপরও কিছু কিছু পত্রিকায় বিভিন্ন খরব প্রকাশিত হয়। যেমন ২০১০ সালের ১৯শে জুন দৈনিক ডেইলি স্টার Ahmadiyyas in Tangail attacked নামে একটি সংবাদ প্রকাশ করেন। এছাড়া ঢাকার আশেপাশে, চট্টগ্রাম, রংপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে হামলা ও সুন্নি মুসলমানে দীক্ষা দেওয়ার মতন ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ থেকেও আহমদিয়ারা চলে যাচ্ছে এর মূল কারণ এরা কোণঠাসা এবং নিরাপত্তার অভাবে ভুগছে।কয়েক বছরের হামলার পরিসংখ্যান উল্লেখ করলে নিরাপত্তার বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। যেমন- thepersecution.org সাইটে Persecution in Bangladesh এ বিগত কয়েক বছরের হামলার নিউজ উল্লেখ করা আছে। আগ্রহীরা দেখতে পারেন। একজন আহমদিয়ার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সাধারণ মুসলিমদের চোখে ইহুদি ও আহমদিয়াদের মধ্যে তারা কোন তফাৎ দেখে না। এখানে ওনার এক ছোট ভাইয়ের ঘটনা বলি- ওনার ছোট ভাই বর্তমানে দেশের বাহিরের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। একদিন রুমের অন্য মুসলিম বন্ধুরা খেয়াল করল তাদের বন্ধুটির নামাজ পড়ার রীতি-নীতিটি আলাদা। সহজেই তারা বুঝে গেল বন্ধুটি আহমদিয়া সম্প্রদায়। ঐ রাতে শারীরিক প্রহার করে রুম থেকে বের করে দেয়। হাসপাতালের ভর্তি পর আহমদিয়া সংগঠনগুলো তার পাশে দাঁড়ায়। এখানে আরেকটা বিষয় উল্লেখ করতে চাচ্ছি। তাহল; খ্রিস্টান চার্চের মতন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের তালিকা থাকে। মানে এই সম্প্রদায়ের সবার নাম লিপিবন্ধ থাকে। এই ঘটনা যে শুধু দুই একজনের বেলায় ঘটে তা নয়। যারা আহমদিয়া তারা প্রকাশ্যে তা উচ্চারণ করার সাহস রাখে না। কারণ একটাই নিরাপত্তা-হীনতা। সুন্নি মুসলিমরা একজন কাফের ও আহমদিয়াকে আলাদা করে দেখে না। এখানে বলে রাখা ভাল ‘আহমাদিয়া সুন্নিয়া’ সুন্নিদের ব্রাঞ্চ। এরা মূলত মাজার-পন্থী। এর সাথে আহমদিয়াদের কোন সম্পর্ক নেই।
কিছুদিন আগে প্রাণের গ্রুপের মালিক আমজাদ চৌধুরী মারা যান। অভিযোগ ছিল ৭১ এ তিনি পাকিস্তানীদের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন। এখানে স্মরণে রাখা উচিত যে, শুধু আমজাদ চৌধুরী নয় বাংলাদেশের অনেক বাঙালি অফিসার পাকিস্তানীদের পক্ষে যুদ্ধ করে। আমজাদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করা গেল। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ওনাকে আহমদীয়া হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এখানে মাথায় রাখতে হবে এই আহমদিয়া বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যটা কী। এখানে উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার তা হল; আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে আরও বেশি নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা। আর এই কাজটি করেছে আমাদের টিভি মিডিয়া। যদি আমজাদকে আহমদিয়া হিসেবে পরিচয় করানো যায় তাহলে প্রশ্ন আসে; গোলাম আজম কিংবা কাদের মোল্লাকে কী মিডিয়া সুন্নি রাজাকার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল? আমজাদ চৌধুরীর মতন কেউ কেউ যেমন পাকিস্তানীদের পক্ষে কাজ করেছে তেমনি আহমদিয়াদের মধ্যে অনেকেই ৭১-এ যুদ্ধ করেছে, নিজের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছে। যেসব আহমদিয়ারা ৭১ এ বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করেছে সেই স্বাধীন রাষ্ট্রটিতে তাদের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের কোন অধিকার নেই! এর থেকে বড় কষ্ট আর কী হতে পারে? বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নামক একটি ঐক্য পরিষদ আছে যারা তাদের উপর সংখ্যাগুরুর নির্যাতন হলে ক্ষুদ্র আকারে হলেও দেশবাসীকে জানানোর সুযোগ পায়। কিন্তু এই আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের সেই সুযোগও নেই।
ইনি বাহাউল্লা। বাহাউল্লা অর্থ আল্লার গৌরব। বাহাউল্লা বিশ্বাস করতেন যে-তিনিই বিশ্বধর্মের প্রতিশ্রুত উদ্ধারকর্তা। এমন কী কলকি অবতারও তিনি। তিনিই মৈত্রীয় বুদ্ধ, বা শেষ জামানার প্রতিশ্রুত বুদ্ধ। বাহাউল্লা ছিলেন বাহাই ধর্মের প্রবক্তা। অনেকেরই ধারনা- ইরানের শিয়া ইসলাম থেকে এদের উদ্ভব। যদিও বাহাইরা নিজেদের ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন সম্পূর্ন পৃথক এক ধর্মের অনুসারী বলে মনে করে। বাহাই বিশ্বাস অনুসারে ধর্মীয় ইতিহাস স্বর্গীয় দূতদের ধারাবাহিক আগমণের মাধ্যমে ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। এইসব দূতদের প্রত্যেকে তাঁদের সময়কার মানুষদের সামর্থ্য ও সময় অনুসারে একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই সকল স্বর্গীয় দূতদের মাঝে আছেন ইব্রাহিম, গৌতম বুদ্ধ, যীশু, মুহাম্মাদ ও অন্যান্যরা। বাহাই ধর্ম বিশ্বের প্রায় সকল ধর্মের বৈধতায় বিশ্বাস করে, এবং সকল ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় ব্যক্তিবর্গ হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ধর্মীয় ইতিহাস হচ্ছে ধর্মগুলোর ধারাবাহিক বণ্টন। এখানে প্রত্যেকে ধর্মের প্রত্যেক প্রতিনিধি ঐ সময় ও স্থানের জন্য আরও ব্যাপক ও প্রাগ্রসর ধারণার প্রবর্তন করেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বাহাইরা বারবার হয়রানি ও নানাবিধ প্রতিকূলতার শিকার হয়ে আসছে।, কারণ মুসলিম ধর্মীয় নেতারা বাহাই ধর্মকে একটি স্বাধীন ধর্ম হিসেবে মানেন না। বাহাইদের বিরুদ্ধ সবচেয়ে বড় মাপের হয়রানিগুলো সংগঠিত হয়েছে ধর্মটির উৎসভূমি ইরানে। শিয়া কাঠমোল্লাদের চাপে ইরানের তৎকালীন সরকার প্রকাশ্যে বাহাইদের নেতাকে হত্যা করে। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৮ সালের মধে সেখানে ২০০ জনেরও বেশি বাহাইকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এছাড়া বাহাইদের ধর্মীয় অধিকার আরও অনেক দেশেই বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মাঝে চালিত হয়। এসকল দেশের মধ্যে আছে আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, মরক্কো, এবং সাহারা-নিম্ন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ। ভারতেও বাহাইরা আছে। ভারতের দিল্লিতে বাহাই হাউস অফ ওরশিপে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লক্ষ দর্শনার্থী এটি পরিদর্শন করেন। এটি পদ্ম মন্দির নামে জনপ্রিয়। বাংলাদেশে বাহাই সম্প্রদায়েরও একই অবস্থা। তবে বাহাই সম্প্রদায় অর্থনৈতিকভাবে ধনী হওয়ার তাদের উপর নির্যাতনের মাত্রাটা কম। এখানে স্মরণ রাখা উচিত ইরানে বাহাই মতবাদের উদ্ভব হলেও বর্তমান ইরান বাহাই শূন্য!
বাংলাদেশের মতন সিরিয়া মতন মধ্যপ্রাশ্চ্যের অনেক দেশে এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায় রয়েছে যেমন ইয়াজিদি সম্প্রদায়। এরাও সংখ্যাগুরু ও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী গ্রুপগুলোর টার্গেটে সবার আগে। ইয়াজিদির ধর্ম পৃথিবীতে অ-আব্রাহামিক ধর্ম বলে পরিচিত। ইয়াজিদি সম্প্রদায় একই সঙ্গে আলো ও অন্ধকারের পূজা করে। তবে বিশেষভাবে সূর্যের উপাসনা করা তাদের ধর্মের অন্যতম অনুষঙ্গ। তাদের মধ্যে পশু কুরবানি ও লিঙ্গ খৎনা করার প্রথাও প্রচলিত। জন্মগ্রহণ ছাড়া এই ধর্মের মানুষ হওয়া যায় না। অন্য ধর্ম গ্রহণ করাও নিষেধ। ইয়াজিদিরা ইয়াজদানকে তাদের প্রভু বলে বিশ্বাস করে। তবে সরাসরি সেই প্রভুর প্রার্থনা করা যায় না। ইয়াজদানের সাতজন দেবতা। এদের মধ্যে সবচেয়ে মহান হচ্ছেন ময়ূর-দেবতা। ময়ূর-দেবতা ইয়াজিদিদের কাছে মালেক তাউস নামে পরিচিত। সারা পৃথিবীতে ইয়াজিদি ধর্মবিশ্বাসের প্রায় সাত লাখ মানুষ রয়েছে। তবে এদের সিংহভাগের বসবাস উত্তর ইরাকে। ঐতিহাসিকভাবে জরস্ত্রিয়ান, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের কাছে অগ্রহণযোগ্য ইয়াজিদিরা নৃতাত্ত্বিক-ভাবে ইরাকের কুর্দিশ সম্প্রদায়ভুক্ত। বহুবছর ধরে চাপ, নিপীড়ন ও হুমকির মধ্যে তারা সিনজার পর্বতের আশপাশে বাস করে আসছেন। ১৮ ও ১৯ শতকে অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীনে ইয়াজিদিরা অন্তত ৭২ বার হামলা ও গণহত্যার শিকার হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় ইরাকের আত্মঘাতী হামলার মূল টার্গেট ছিল ইয়াজিদিরা। ইয়াজিদিরা আইএসের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার কারণ তাদের ধর্মবিশ্বাস। আইএসের ধারণা, ইয়াজিদিরা ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার (৬৪৭-৬৮৩) বংশধর। ইয়াজিদ উমাইয়াদের কাছে ঘৃণিত ব্যক্তি। এছাড়া ইয়াজিদিরা দৈনিক পাঁচবার যে মালেক তাউসের প্রার্থনা করে সেই মালেক তাউসের অন্য নাম শয়তান। আরবিতে যার অর্থ অশুভ আত্মা। তাই আইএসের ধারণা ইয়াজিদিরা শয়তানের আনুগত্য করে। তবে আধুনিক গবেষকরা বলছেন, ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার সঙ্গে ইয়াজিদিদের সম্পর্ক নেই। এই শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ ইজিদিস থেকে। যার অর্থ ঈশ্বরের পূজারি।
সমগ্র বিশ্বের মতন বাংলাদেশেও চলছে বিশ্বাসের নির্যাতন। সংখ্যাগুরুরা সুযোগ পেলেই তাদের বিশ্বাস অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে পছন্দ করে। সেটি হোক ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক বিশ্বাস। ধর্মীয় বিশ্বাসের নির্যাতন শুধু ভিন্ন ধর্মের মানুষই হয় না, নিজ ধর্মের ভিন্ন বিশ্বাসীরাও হয়। আহমদিয়ারা সংখ্যায় কম ও নিপীড়িত সম্প্রদায় হওয়ায় খ্রিস্টান চার্চের মতন তাদেরও তালিকা থাকে। এই সম্প্রদায়ের কেউ জীবনের ঝুকিতে পড়লে তাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কয়েকটি সংগঠন কাজ করে। এছাড়া নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়লে অনেকে নিজ উদ্যোগে দেশ ত্যাগ করে। তবে আমরা এমন একটি বাংলাদেশ কল্পনা করি যেখানে রাষ্ট্রীয় আইন হবে সবার জন্য সমান, সকল সম্প্রদায়ের মানুষ পাবে নিজ ধর্ম পালনের নিরাপত্তা ও অধিকার।
তথ্যসহায়তায়:
১.বাংলাপিডিয়া
২.মওদুদী ও গোলাম আযমের ইসলাম এবং নবীজীর (স) ইসলাম- মুনতাসির মামুন (দৈনিক জনকণ্ঠ)
৩.আবদুস সালাম- প্রথম মুসলমান (?) নোবেল বিজ্ঞানী-প্রদীপ দেব
৪.জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর মৃত্যুদণ্ড আর তার ছেলের কিছু বক্তব্য প্রসঙ্গে জামায়াতের অবস্থান-আবু সাঈদ জিয়াউদ্দিন
৫.Persecution of Ahmadis
৭. thepersecution.org-
৮. ইয়াজিদি কারা, কেন লক্ষ্য?-দৈনিক যুগান্তর
৯. http://ahmadiyyatimes.blogspot.se/
১০. http://ahmadiyyatimes.blogspot
১১. বাহাই কারা?-ইমন জুবায়ের
১২. উইকিপিডিয়া