স্মৃতিতে অভিজিৎ রায়

অভিজিৎ রায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

[এই লেখাটি মূলত অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার স্মৃতি কথা। এতে পূর্বে প্রকাশিত আমার একটি লেখার কিছু অংশও সরাসরি ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইত্যাদি প্রাধান্য পাওয়ায় লেখাটি সর্বমহলে হয়তো আগ্রহোদ্দীপক প্রতীয়মান না-ও হতে পারে।]

২০০৯ বা ২০১০ সালের কথা। আমি তখনো ধর্মরোহিত হইনি পুরোপুরি। তবে বেশকিছু প্রশ্ন মনের মধ্যে প্রগাঢ় হতে শুরু করেছে। তখন ফেসবুকে আমার একাউন্ট ছিলো তবে ব্লগিংএর সাথে পরিচিত ছিলাম না। এই সময় সমহোয়্যারইন ব্লগ বেশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে এবং ফেসবুকে বিভিন্ন মানুষের শেয়ার করা সামহোয়্যারইন ব্লগের বিভিন্ন আর্টিকেলের মাধ্যমে প্রথম বাংলা ব্লগ সম্বন্ধে আমার ধারনা শুরু হয়। একই সময়ে সম্ভবতঃ কোনো একটা কিছু গুগলে অনুসন্ধান করতে গিয়ে মুক্তমনার সাথেও পরিচয়।

যেমনটি বলেছিলাম, আমার মনে সেই সময় কেবল সংশয় তৈরি হতে শুরু করেছিলো। আমি ছাত্রাবস্থায় কিছুটা অন্তর্মূখী চরিত্রের ছিলাম তাই সমমনষ্ক মানুষের সংসর্গেও আসার সুযোগ বিশেষ তৈরি হয় নি। তবে অনলাইন জগতের সবচেয়ে বড় সুবিধাটি হলো নিতান্তই অন্তর্মূখী মানুষটিও তার অন্তর্মূখীতা বজায় রেখেই বহির্মূখী হওয়ার সুযোগ পায়! আমার নিজের মাঝে সংশয়গুলো তৈরি হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন হুমায়ুন আজাদ। সেই কারণে হুমায়ুন আজাদ আমার সবচেয়ে শ্রদ্ধাষ্পদ হাতেগোনা কয়েকজন মানুষের একজন। তাঁর নারী বইটি পড়ার মধ্যমেই আমি সংশয়বাদী হয়ে উঠি। এর আগেও যে সংশয় তৈরি হতো না তা নয় তবে যেহেতু সেসব নিয়ে কারো সাথে আলাপ-আলোচনার সুযোগ ছিলো না তাই বরং মনের মাঝে সংশয় তৈরি হলেও মনের ভেতরটা হাতড়ে্ই তার একটি কল্পিত উত্তর খুঁজে নিতাম এবং সন্তুষ্ট থাকতাম।
হুমায়ুন আজাদ যেমন আমাকে সংশয়বাদী হতে সাহায্য করেছেন, মুক্তমনা ব্লগের খোঁজ পেয়ে এবং এতে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখা পড়ে আমি ক্রমেই নিরীশ্বরবাদী হয়ে উঠলাম। কাজেই বলা যায় মুক্তমনা ব্লগ হুমায়ুন আজাদের পর তৃতীয়বারের মতো আমার স্বত্ত্বাস্রষ্টা। ক্রমেই আমি মুক্তমনার একজন নিয়মিত পাঠকে পরিণত হলাম এবং অনেক ব্লগারের লেখনীর সাথে পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলাম। মুক্তমনার ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি বা বিজ্ঞানবিষয়ক লেখাগুলো আমার নিয়মিত পাঠতালিকায় অন্তর্ভূক্ত হলো এবং আমারও ইচ্ছে হলো লেখালেখি করি। কিন্তু সাধারন্যের জন্য মুক্তমনার দরজা বন্ধ, বরং এর লেখক হতে হলে আগে নিজেকে মুক্তমনা প্রমান করতে হয় এবং তার জন্য এর বিভিন্ন লেখায় প্রচুর মন্তব্য করতে হয় (আমি এই পদ্ধতিতে উৎসাহ পেলাম না। অতিথি লেখক হিসেবে লেখা দেওয়া যায় একং মনোনীত হলে প্রকাশিত হয় কিন্তু আমি এতেও উৎসাহ পেলাম না।) আমি তাই লেখালেখির জন্য সামহোয়্যারইন ব্লগকে বেছে নিলাম এবং বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে লাগলাম। সেই সময় আমি সামহয়্যারইন ব্লগের প্রচুর সমমনষ্ক মানুষের সান্নিধ্যে চলে আসলাম।

তবে যখন আমি সংশয়বাদী ছিলাম না তখনো বিজ্ঞানের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলাম। বিজ্ঞানের কোনো প্রতিষ্ঠিত বিষয় নিয়েই আমার সংশয় ছিলো না বরং আমি বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে একটি কল্পিত সেতু কল্পনা করে নিতাম। হুমায়ুন আজাদ এবং মুক্তমনা আমার এই সেতুটিই উগড়ে ফেলতে সহয়তা করেন। আমি বিজ্ঞানের সব বিষয় নিয়েই লেখালেখি করার চেষ্টা করতাম। পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে যেমন লিখেছি, জীববিজ্ঞান নিয়েও লিখেছি, একই সাথে লিখেছি গণিত নিয়েও। এই সময় আমি বিবর্তন নিয়ে একটি লেখা লিখলাম ‘বিবর্তনের ধারায় লিঙ্গের আবির্ভাব।‘ এটি সম্ভবত ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে। মুক্তমনায় বিবর্তনের বিষয়টিকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় কারণ এর সাথে সংশয়বাদ এবং মুক্তচিন্তা বেশখানিকটা জড়িত। তাই আমি ফেসবুকে অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার লেখার লিংকটিসহ যোগাযোগ করলাম। তিনি লেখাটি বেশ পছন্দ করলেন এবং আমাকে মুক্তমনায় একটি একাউন্ট খুলে দিলেন এবং সেখানে এই লেখাটি প্রকাশ করতে বললেন। সেই থেকেই আমার মুক্তমনায় সক্রিয় পদচারণা। এবং সেখান থেকেই অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার পরিচয়ের সুত্রপাত।

ফেসবুকে মাঝে মাঝে টুকটাক তাঁর এবং আমার পোস্টে কমেন্ট প্রকাশের মাধ্যমে এবং মুক্তমনায় কমেন্ট আদান প্রদানের মাধ্যমেই যোগাযোগটুকু চালু ছিলো। এর বাইরে খুব কমই ইনবক্স ইত্যাদিতে যোগাযোগ হতো। ২০১৪ সাথে আমার গণিতের উপর লেখা ব্লগআর্টিকেলসমূহের সংকলন নিয়ে একটি বই “গণিতের সৌন্দর্য”প্রকাশিত হয়। বেশ অস্বস্তি ও দ্বিধা নিয়ে আমি বইটির একটি সফট কপি নিয়ে ফেসবুকের চ্যাটবক্সে তাঁর সাথে যোগাযোগ করলাম এবং যদি বইটি তাঁর পছন্দ হয় তাহলে একটি ছোটখাটো রিভিউ লিখে দিতে আবদার করলাম। তিনি আমাকে হতবাক করে দিয়ে বিশাল রিভিউ লিখলেন এবং তাতে আমার বইটির বেশ প্রসংশা করলেন যা আমার জন্য কল্পনাতীত ছিলো। সেই থেকে তাঁর সাথে সম্পর্কটি আরো প্রগাঢ় হয়ে উঠলো এবং মতামত আদান-প্রদান আরো জোরদার হলো। আমি মুক্তমনায় কোনো লেখা লিখলেই সেখানে তাঁর মতামত দিতেন এবং তা নিয়ে আলোচনা করতেন। বিশেষ কিছু ব্যতীক্রম ছাড়া মু্ক্তমনায় তাঁর লেখায় আমি অবশ্য তেমন আলাপ-আলোচনায় অংশ নিতাম না তবে মাঝে মাঝে ফেসবুক পোস্টগুলোতে মতামত জানাতাম, তিনিও কখনো কখনো আমার পোস্টগুলোতে মতামত জানাতেন।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারীর চার তারিখে তিনি ফেসবুক চ্যাটবক্সে নক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মেলায় আমার নতুন কোনো বই আসছে কিনা। আমি তাঁকে জানালাম দুটি বই আসার কথা। একটি অনুবাদ গ্রন্থ যার মূল বইটির লেখক আইজ্যাক আসিমভ এবং আমার অনুবাদকৃত সংস্করণটির নাম ‘পরমাণুর গহীন নিসর্গে’। অপর বইটি হলো গণিতের প্রথম বইটির একটি সিক্যুয়েল, নাম “গণিতের আরো সৌন্দর্য”। আমি জানুয়ারীর শেষ দিক থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করছিলাম এবং ফেব্রুয়ারীর শেষ দিকে দেশ থেকে ফিরে আসার পরিকল্পনা ছিলো। তাই তাঁকেও জিজ্ঞেস করলাম তিনি দেশে যাবেন কিনা? যদি যান তাহলে তাঁর সাথে দেখা হবে। তিনি জানালেন ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি দেশে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমার ২০১৫ এর বইমেলায় প্রকাশিতব্য প্রথম বই এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিলো, দ্বিতীয় বইটি তখনো প্রকাশককে জমাই দিতে পারি নি। দুটি বইয়ের উৎসর্গপত্রও ঠিক করে রেখেছিলাম। প্রথম বইটি বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক দীপেন ভট্টাচার্যকে উৎসর্গ করেছিলাম, দ্বিতীয় বইটি উৎসর্গ করার কথা ছিলো স্বয়ং অভিজিৎ রায়কেই। কিন্তু আমি ছুটির আমেজে থাকায় শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বইটি আর বইমেলায় প্রকাশ করা হয় নি এবং আমার অতিবড় দুর্ভাগ্য যে তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে আমার বইটি উৎসর্গ করে যেতে পারি নি। এই আনুশোচনা আমাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

অভিজিৎ রায়ের সাথে, আমার বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে
সম্ভবতঃ ১৮ তারিখ হবে, এর মধ্যে অভিজিৎ রায়ের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি, আমি আর বিজ্ঞান লেখক আব্দুল গাফফার রনি বিকেল বেলায় আড্ডা দিচ্ছিলাম বইমেলায় ছায়াবীথি প্রকাশনীর স্টলের সামনে। এমন সময় একজন মধ্যবয়সী মানুষ স্টল থেকে আমার “পরমাণুর গহীন নিসর্গে” বইটি কিনে এনে আমার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন ‘স্যার, একটা অটোগ্রাফ দেন’। ইতিমধ্যে দু’চারজনকে অটোগ্রাফ দিয়ে আমার মধ্যে একটা নির্লিপ্তভাব চলে এসেছে! আমি নির্লিপ্তভাব নিয়েই কলম হাতে বললাম, আপনার নাম? তিনি বললেন, ‘অভিজিৎ’। শুনে বিশ্ময়বিমূঢ় আমি কেঁপে উঠলাম এবং হাত থেকে কলম পেড়ে গেলো। অভিজিৎ রায়ের চেহারা দেখে তাঁকে না চেনার কোনো কারণ ছিলো না, কিন্তু আমার মস্তিষ্ক সেই মূহুর্তে সেই অবস্থানে তাঁকে অনুমান করতে পারে নি, তাই এ বিড়ম্বনা। সেদিন তাঁর সাথে প্রচুর আড্ডা হলো, আমাদের সাথে পরবর্তীতে আরো বিভিন্ন লেখক আড্ডা দিয়েছিলেন। তিনি বেশ মজার মানুষ, প্রচুর রসিকতা করেন, এমনকি তাঁর উপর মৌলবাদীদের দেয়া হুমকী নিয়েও সেদিন বা পরবর্তীতে বেশ হাসি-থাট্টা হয়েছে কিন্তু এসব যে এভাবে ফলে যাবে তা কখনো কল্পনাও করিনি। দ্বিতীয়বারের মতো তাঁর সাথে আমার দেখা হয় ১৯ তারিখে, আমার বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের দিন। সেদিনও তাঁর সাথে প্রচুর আড্ডা হয়েছে। ২৪ তারিখ দুপুরে আমার ফ্লাইট ছিল, ২৩ তারিখে শেষবারের মতো বইমেলায় যাই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য এবং সেদিনই শেষবারের মতো অভিজিৎ রায় এবং প্রথম বারের মতো বন্যা আহমেদের সঙ্গে দেখা হয়। দক্ষিন কোরিয়ায় ফিরে আসার পর আর তাঁদের সাথে যোগাযোগ হয় নি।

অভিজিৎ রায়ের হত্যার খবর পাই সিউলে অবস্থিত আমার এক পরিচিত জনের কাছ থেকে আনুমানিক রাত ১ টার দিকে। আমি তখন ঘুমিয়ে, এসময় সেই পরিচিত জনের কাছ থেকে ফোন আসে। প্রথমবার ফোন করে তিনি যখন বুঝতে পেরেছেন আমি ঘুমিয়েছিলাম, তখন আর কিছুই জানান নি, খোঁজ-খবর নিয়ে ফোন রেখে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরে আবারো তিনি ফোন করেন এবং জিজ্ঞেস করেন অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার সম্পর্ক কেমন? আমি বললাম, অভি’দার সাথে খুবই ভালো সম্পর্ক। বইমেলায় তাঁর সাথে কয়েকবার আড্ডা দিয়েছি, তিনি আমার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে দিয়েছেন। তারপর সেই খবরটি দিলেন। শুনে ফোনে আমার যা প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো তাতে তিনি আর কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দিয়েছিলেন। পরের দু’দিন কেমন কেটেছে তা বোধ হয় আর ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

যুক্তির পথ ধরে মুক্তির আলো ছড়িয়ে গিয়েছেন সর্বত্র, সর্বদা....
যতদিন বেঁচে থাকব ততোদিন অভিজিৎ রায়ের স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। মাঝেমাঝে ভাবি তাঁর মৃত্যুর আগে তাঁর সাথে দেখা করার, আড্ডা দেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে এটা আমার জন্য পরম পাওয়া। আবার ভাবি, এই ক্ষনিকের হৃদ্যতা না হলেই হয়তো ভালো হতো, তাহলে হয়তো সারা জীবন এই লিগেসি বয়ে বেড়াতে হতো না। আবার হয়তো ভাবি মুক্তচিন্তার প্রসারের ক্ষেত্রে ধর্মান্ধ, মৌলবাদীদের সাথে এধরনের সংঘর্ষ হয়তো অনিবার্য ছিলো। যুগে যুগে এধরনের কুপমন্ডুক কাপুরুষদের আক্রমন মোকাবেলা করেই আজকের সভ্য পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অভিজিৎ রায় নিজেই কখনোই মনে করতেন না বিনা যুদ্ধেই মুক্তমত ও মুক্তচিন্তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই ব্যপারে তিনি নিজেই বলে গিয়েছিলেন, “যারা ভাবে বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয়ে যাবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মত জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালিখি করছি।জামাত শিবির, রাজাকারেরা নির্বিষ ঢোঁরা সাপ না, তা একাত্তরেই আমরা জেনেছিলাম। আশি নব্বইয়ের দশকে শিবিরের রগ কাটার বিবরণ আমি কম পড়ি নি।আমার কাছের বন্ধুবান্ধবেরাই কম আহত হয় নাই।” স্বাধীনভাবেই তিনি তাঁর জীবন যাপন করতে চেয়েছেন। তাই যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হলেও বিভিন্ন সময় বইমেলায় হলেই তিনি ছুটে এসেছেন দেশের টানে। পাঠক-লেখকদের সাথে আড্ডা দিয়েছেন নির্ভীক চিত্তে।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারীরই মুখে কোনো রা নেই। নিজের পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত এবং সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সমর্থন আর আনুকূল্য প্রত্যাশী এবং ঈর্ষান্বিত অনেকেই আবার পরোক্ষভাবে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিজিৎকেই দায়ী করার চেষ্টা করছেন। অথচ নগরে আগুন লাগলে দেবালয় যে রক্ষা পায় না সেই বিষয়টি তাঁরা বেমালুম ভুলে আছেন। ফলস্বরূপ, “বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদিতা চাই না” জাতীয় বিষ্ঠাও প্রসূত হয় অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল আর একদা স্বঘোষিত নাস্তিকের কলম হতে। এসবের সুযোগেই ধর্মান্ধ কাপুরুষরা একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এতকিছুর পরেও কারো কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সবাই নিজ নিজ আখের গোছানোর তাগিদে বিভেদের মন্ত্রে দীক্ষা নিচ্ছেন এবং একই সাথে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে পথ করে দিচ্ছেন। অপর দিকে প্রতিক্রিয়াশীলদের নানাবিধ কুকর্মে রাষ্ট্রীয় নীরবতা এসবের প্রতি উৎসাহ বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রবলভাবে। মৌলবাদী হামলার ঘটনার কোনো মামলারই এখন পর্যন্ত যথাযথ বিচার হয় নি; উল্টো রাষ্ট্র বিভিন্ন সময় মুক্তচিন্তার কর্মীদের উপর নানাভাবে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। এতে ভবিষ্যতে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলো আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।
তবে এতসব নেতিবাচক তথ্যের ভিড়েও আশার বাণী হচ্ছে, দমন-পীড়ন, নির্যাতন আর হত্যার মাধ্যমে মুক্তচিন্তার প্রসার বন্ধ করা যায় না। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রগতিশীল আন্দোলনকারীরা দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে গিয়েই অনেক সমাজে পরিবর্তন এনেছিলেন। তাছাড়া এর জন্য কোনো সোজা-সাপটা রাস্তাও নেই। সভ্য প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে পেছন থেকে ছুরি-চালানো কাপুরুষ কূপমণ্ডুকদের মোকাবেলা করেই তা করতে হবে। আইডিয়ার মৃত্যু নেই। একজন অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর চিন্তা-চেতনা হাজারো অভিজিতের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অভিজিৎ রায়ও তা জানতেন। তাই তিনি মৌলবাদীদের হুমকি-ধামকিতেও তাঁর স্বাধীন চিন্তাভাবনা, স্বাধীন জীবন-যাপন বিসর্জন দেন নি। যাঁরা প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে জড়িত তাদেরও বিষয়টি মাথায় রেখেই চলতে হবে।

Print Friendly