মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা বাঙলায় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য শেল্টার হোম (আস্তানা) ছিল। এই শেল্টার হোমগুলো ছিল মানুষের বসতবাড়ি, দোকান, গুদাম সহ নানান স্বাভাবিক স্থাপনা।
শেল্টার হোম যে বা যারা পরিচালনা করতেন, তাঁদের বলা হয় শেল্টার মাস্টার। মুক্তিযুদ্ধে এই শেল্টার মাস্টারদের অবদান অনস্বীকার্য।
এঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন, লুকিয়ে রাখতেন, খবর সংগ্রহ করে দিতেন, রাস্তা চিনিয়ে দিতেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন, অস্ত্র পারাপার করে দিতেন-লুকিয়ে রাখতেন, অন্যত্র পৌঁছে দিতেন, খাবার দিতেন, রাজাকারদের চিনিয়ে দিতেন, আর্মি ক্যাম্পের অবস্থান জানাতেন, গেরিলা অপারেশন করার যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করতেন ও এলাকার ভূ-মানচিত্র সম্পর্কে ধারণা দিতেন; অর্থাৎ অপারেশনকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যাবতীয় আশ্রয়ের ব্যবস্থা ও তথ্য সরবরাহ করতেন।
এই শেল্টার মাস্টাররা অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পাননি, অনেকে নেননি। এই শেল্টার মাস্টাররা না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা অপারেশানগুলো অনেক কঠিন হয়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির গণযুদ্ধ ছিল, তার একটি প্রমাণ হলো এই শেল্টার মাস্টাররা।
এই শেল্টার মাস্টাররা অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন। অনেক শেল্টার মাস্টার ধরা পরে যেতেন। তাঁদের পরিণতি হতো ভয়ংকর। তাঁদের তিলে তিলে যন্ত্রনা দিয়ে হত্যা করা হতো মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যের জন্য; বাড়ির মেয়েদের সবার সামনে ধর্ষণ করা হতো, পুত্রদের জবাই করা হতো, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হতো; এমন কোন নৃশংসতা হয় না, যা তাঁদের সাথে করা হতো না কিন্তু সব কষ্ট সয়ে শেল্টার মাস্টাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কোন তথ্য দিতেন না।
আজকে আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। যোগ্যতা অর্জন করলে অনেক বড় কিছু হতে পারি। কিন্তু পাকিস্তানে অামাদের অবস্থা এমন ছিল না। পাকিদের দাস না হলে, ওরা বাঙালিদের উপরে উঠতে দিতো না। অধিকাংশ বাঙালি যোগ্যতা থাকা সত্বেও ছিলেন অধ:স্তন।
অথচ, আজ সবকিছু পরিবর্তন হয়েছে। বাঙালিদের রাষ্ট্র আছে, যোগ্যতা থাকলে বাঙালিরা সর্বোচ্চ পদে যেতে পারে। এসব সবকিছু সম্ভব হয়েছে দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বলে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই।
মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা শেল্টার মাস্টারা হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের গণযোদ্ধা। যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি, তাঁদের যুদ্ধটি ছিল ভিন্ন পন্থায়- মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে, তথ্য দেয়ার মাধ্যমে; শেল্টার মাস্টারহীন মুক্তিযুদ্ধ কল্পনা করা যায় না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শেল্টার মাস্টারদের অবদান বাঙালি কৃতজ্ঞতা চিত্তে স্মরণ রাখবে।
অতল শ্রদ্ধা, আকন্ঠ কৃতজ্ঞতা ও হৃদয়ভরা ভালোবাসায় স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের গণযোদ্ধা এইসব শেল্টার মাস্টারদের; আজ বাঙালি যতটুকু ভালো আছে, তা মুক্তিযুদ্ধের এইসব যোদ্ধাদের কাঁধের উপর দাঁড়িয়ে…