পারমাণবিক ক্ষুধা

আমার শিথানের পাশ দিয়ে একটা কানাগলি একেবেকে হারিয়ে গেছে দূরে। সেই পথ ধরে গ্রীষ্মের প্রতি কাকডাকা ভোরের শান্ত-শীতল বাতাসেরা জানালার খোলা কপাট গলিয়ে আমার ঘরে ঢুকে পড়ে। আমার মাথায় ‘ভালোমায়ের’ মতন হাত বুলিয়ে গাঢ় ঘুমটাকে আরো গাঢ় করে দিয়ে যায় তারা। যেন জীবনের সব পাওনা এক ভোরেই মিটিয়ে দিতে চায়। আজ হঠাত করে কী যে হলো, বাতাসের আস্তিন ধরে সেখানে ঢুকে পড়লো এক ফেরিওয়ালা বুড়ীর হাকডাক- মেদহীন কর্কশ এক বানিজ্যিক বিজ্ঞাপন।
-ছাই নাকফা, ছাই।
বিরক্ত হলাম। চোখে মোলায়েম ঘুম মেখে জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে বিরক্তিটুকু ঢেলে দিলাম।
-কেন বাপু, তুমি আমার এই বাড়া ঘুমটায় ছাই ছিটালে? বেলা করে আসলেও পারতে।
-ক্ষিদে বাজান, ক্ষিদে। ক্ষিদেয় তাড়ায়ে নিয়ে বেড়ায়।
বুড়ীর কথা শুনে গায়ের জ্বালা যেন বাড়লো।
-কেন, আমার ক্ষিদে নেই? সেই গতসন্ধ্যায় ভাত খেয়েছি, সারা রাত উপোস। কই, আমি তো কারও বাড়া ভাতে ছাই দিনা।
-আমারডা হলো আসল ক্ষিদে, বাজান- তুমারডা সখের।
-কেন, আসল ক্ষিদে লাগলে কি হয়?
-শইলে আসল ক্ষিদে লাগলি চারদিকি আগুন জ্বলে গো বাজান, আগুন জ্বলে। আর ক্ষিদে ছাড়াই যারা দশের সবকিছু গিলে ফেলায় তাগো জ্বালায়ে পোড়ায়ে ভস্ম করে। তয় ক্ষিদেটা সবার একসাথে লাগতি হবি। ছাই নাকফা, ছাই………ছাই নাকফা, ছাই।
ফেরিওয়ালা বুড়ী বিজ্ঞাপনী আগ্রাসনে দশদিক কাঁপিয়ে অন্ধগলি দিয়ে হাটতে হাটতে একসময় অন্ধকারে হারিয়ে যায়। আমার ঘুম যায় টুটে। ড্রেসিংটেবিলে আটকানো বেলজিয়ামের আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের শরীরে খুজতে থাকি আসল ক্ষুধার শুভ-চিহ্ন, কিন্তু দেহের কোত্থাও মেলে না তা। অতীত দিনের তেভাগা আর চলতি সময়ের ফুলবাড়ীর আগুনের ঝাঁঝ চকিতে আমার আয়েসী মনে একটু ছোয়া দিয়ে গেল বুঝি। বুঝলাম, আর দেরী করা ঠিক হবে না- সময় হয়েছে শরীরে সব ভস্ম করা সেই আসল বুনো ক্ষুধাটাকে জাগিয়ে তোলার। কিন্তু কিভাবে?