ব্লগার হত্যায় যুদ্ধপরাধী ইস্যু (আলোচনা)

সাম্প্রতিক সময়ে একটা বিতর্ক লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, নাস্তিক ব্লগার হত্যায় কি শুধু তাদের লেখালেখি জড়িত নাকি যুদ্ধাপরাধী ইস্যু এর সাথে জড়িত আছে? অনলাইনে অনেককেই বিভিন্ন দৃষ্টিতে বিষয়টা ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছে। বিষয়টা বিভিন্ন দৃষ্টিতে কিছুটা জটিল কিন্তু ব্লগার হত্যার সাথে যুদ্ধাপরাধী কিংবা জামাত শিবিরের মতন ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধের ইস্যু কি একেবারে নেই?

ব্লগ জগতে নাস্তিকতা নিয়ে লেখালেখি কি নতুন কিছু? অবশ্যই না। ব্লগের শুরু থেকেই নাস্তিকতা নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল। বরং বর্তমান লেখার থেকে তৎকালীন ব্লগে নাস্তিকতা কিংবা ধর্মের সমালোচনা হয়েছে সবচেয়ে বেশি! কামরুজ্জামানের ছেলেও ব্লগিং করত। সেখানেও তর্ক-বিতর্ক অনলাইন ধোলাই সবই হয়েছিল। এবার আসি জঙ্গিবাদ কি বাংলাদেশে নতুন কিছু? অবশ্যই না। বিএনপির আমল থেকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার শুরু। জঙ্গিবাদের বীজ নম্বই-এর পর থেকেই বপন করা হয়েছিল। এখন শুধু ফল পাচ্ছি কিংবা গাছ বড় হচ্ছে তাই বড় আকারে হাজির হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ১৩০টির মতন জঙ্গি সংগঠন আছে।

জঙ্গি সংগঠন আনসার বাংলা তাদের ফেসবুক পেইজে ঘোষণা দিয়েছে তারা ইসলামের দুশমন ও নবীর বিরুদ্ধে যারা লিখবে সেসব নাস্তিকদের হত্যা করবে। মূল কথায় ইসলামের বিরুদ্ধে লিখলেই হত্যা করবে। সেই সূত্র ধরে আমারা অনেকেই সিদ্ধান্তে আসলাম যে, ইসলামের সমালোচনা করলেই মারা পড়তে হবে। এখানে প্রশ্ন আসে; আনসার বাংলা কি ব্লগার হত্যা করেই তাদের কার্যক্রম শেষ করে নাকি সমাজ ও রাষ্ট্র দখলের উদ্দেশ্য কি তাদের নেই? খেলাফত প্রতিষ্ঠান করার জন্য কি তারা কাজ করছে না?

পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্টদের নাস্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হত। ওয়াজ মাহফিলেও কমিউনিস্ট মানে নাস্তিক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিত। মূল কথা ভিন্ন ধারার প্রগতির চিন্তাকে নাস্তিক ট্যাগ দিয়েই প্রতিহত করত। নাস্তিক যে কেউ ছিল না তা কিন্তু নয় কিন্তু নাস্তিক ট্যাগ দেওয়া সম্পূর্ণ ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে কমিউনিস্টদের সাথে সাথে প্রগতির আন্দোলনকে প্রতিহত করা। মুসলীম লীগের বিপরীতে আওয়ামী লীগ যখন জন্ম ছিল তখন এই ট্যাগ খাওয়ার ভয়ে আওয়ামী মুসলীম লীগ নাম করণ করে। যা পরবর্তীতে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ হয়। আর নাস্তিক তকমার কারণে কমিউনিস্টদের উপর দমন পীড়ন চলে পাকিস্তান শুরুর প্রথম থেকে।

জামাত ও ইসলামিক দলগুলোর বিরোধী হওয়ায় বাংলাদেশের লেখক, প্রগতিশীল কর্মীর কপালে নাস্তিকতার তকমা কম পড়ে নি। যারা প্রকাশ্যে নিজেদের নাস্তিক ঘোষণা করেছে সেই সংখ্যা নগণ্য। যারা নিজেদের প্রকাশ্যে নাস্তিক বলে কখনো ঘোষণা দেন নি সেই সংখ্যা সবসময় ছিল বেশি। নাস্তিক, ইসলাম ধ্বংস, ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এই শব্দগুলোর সাথে আমরা বাংলাদেশের জন্ম থেকেই পরিচিত। The Colonel Who Would Not Repent: The Bangladesh War and Its Unquiet Legacy বইতে দেখতে পাই; “রোকেয়া কবির ভারতের এক হাসপাতালে এক পাকিস্তান সৈন্যকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তুমি কেন যুদ্ধ করতে এসেছ? প্রশ্নের উত্তরে সৈনিকটি বলে; পূর্ব পাকিস্তানের সবাই হিন্দু হয়ে গেছে!” ভারতের কারণে ৭১-এ নাস্তিক থেকে হিন্দু প্রচারটা বেশি কাজের ছিল। তাই তাজউদ্দীনের খোঁজে যখন পাকিস্তানী সেনারা তাঁর বাড়িতে আসে তখন তাজউদ্দীনের শ্বশুরকে পাকিস্তানী সেনা বলে তোমার জামাই তো হিন্দু। সে ভারতীয় চর। তার আসল নাম তেজারাম। দেশ স্বাধীন হলে ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে, মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছু নেই ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে! এসব প্রচার সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। ৯০ সালের দিকে জামাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের সকল ক্যাম্পাস দখলে মাঠে নামে। তখন প্রগতিশীল সংগঠনগুলো যেমন-ছাত্র ইউনিয়নের মতন বামপন্থী সংগঠনগুলোকে নাস্তিকদের দল কিংবা এদের সকল কর্মী নাস্তিক হিসেবে তারা প্রচার করতে থাকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে জাহানারা ইমাম যখন আন্দোলন শুরু করেন তখন রাজাকার সাঈদী জাহানারা ইমামকে জাহান্নামের ইমাম। এছাড়া এই আন্দোলনের কর্মীদের নাস্তিক, ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযোগ করে।

আহমদ শরীফের সময় মোল্লাদের এতো সাহস ছিল না। লতিফ সিদ্দিকীর কল্লা ফেলে দেওয়ার মতন হুমকি দেওয়ার সাহস তাদের ছিল না। হুমায়ুন আজাদের পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়; মুগদা পাড়ায় রাজাকার সাইদি হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করা উচিত বলে বক্তব্য দেয়। লক্ষ্য করুণ মেলে ফেল এই হুকুম দেওয়ার সাহস তখনও এদের ছিল না। আহমদ শরীফের বেলায় অন্য ধর্মীয় সংগঠনগুলো মুরতাদ ঘোষণা করে ফাঁসি দাবী করে ছিল। যা তাদের নিত্য দিনের কর্মসূচী। হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমণের মধ্য দিয়ে লেখকের উপর প্রথম চাপাতি হামলার ঘটনা ঘটে। আর আগে অনেক লেখকের উপর হামলা কিংবা নির্যাতন হলেও মেরে ফেলার জন্য চাপাতি হামলা সেটাই ছিল প্রথম। বিএনপির আমলে ধরা খাওয়া সকল জঙ্গি অতীতে জামাত-শিবিরের কর্মী ছিল। পরবর্তীতে তারা বোমা হামলার মধ্য দিয়ে নিজেদের সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। এখানে মনে রাখা ভাল হুমায়ুন আজাদ জামাত-শিবির ও ধর্মীয় দলগুলোর ঘোর বিরোধী ছিলেন। হুমায়ুন আজাদের উপর হামলার ৪-৫ বছর পর জামায়াতুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ-নেতা শায়খ আব্দুর রহমান হুমায়ুন আজাদ এবং একই সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম ইউনুসকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছিলেন। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন- ২০০৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেন সাঈদী জাতীয় সংসদে হুমায়ুন আজাদের পাক সার জমিন সাদ বাদ (২০০৩) বইটিকে ইসলাম বিরোধী আখ্যায়িত করে বক্তব্য দেন এবং এ ধরনের লেখকদের লেখা বন্ধ করতে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই বইটিতে হুমায়ুন আজাদ তীব্র ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় বাংলাদেশের মৌলবাদী-গোষ্ঠী স্বরূপ চিত্রিত করেন। হুমায়ুন আজাদ বই লিখছেন পাকিস্তান ও মোল্লাদের বিরুদ্ধে কিন্তু রাজাকার সাঈদী অভিযোগ করছে বইটি নাকি ইসলাম বিরোধী! “এক মুরতাদ ছিল। আমরা তাকে সরিয়ে দিয়েছি। এ দেশে সরিয়ে দিলে নানা ঝামেলা হতো। তাই বিদেশে নিয়ে সরিয়ে দিয়েছি।” প্রথাবিরোধী প্রথিতযশা বহুমাত্রিক লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ জঙ্গি হামলায় আহত হয়ে জার্মানিতে মৃত্যুবরণ করার পর এ কথা বলেছিল গ্রেফতারকৃত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে সাঈদীর দেয়া বক্তব্য ও জামায়াত-শিবির এবং জঙ্গিদের মিষ্টি বিতরণের দৃশ্য-সংবলিত ভিডিও দেখানো হয়েছে সাঈদীকে। ভিডিও দেখে সাঈদী বাকরুদ্ধ হয়ে যান। এরপর তাৎৰণিক ঘেমে অস্থির সাঈদী অসুস্থতার ভান ধরে শুয়ে পড়ে। তথ্যসূত্র-দৈনিক জনকন্ঠ।

২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ হওয়ার আগে জামাত-শিবির কিংবা ধর্মীয় সংগঠনগুলো অসংখ্য লেখককে নাস্তিকদের তকমা দিয়েছে। কাদের মোল্লার রায়ের ফলেই গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয়। এই রায়ের আগে অনলাইনে লেখালেখির কারণে আসিফ মহিউদ্দিন ছুরি হামলার শিকার হয়। শাহবাগ সৃষ্টি হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে রাজিব হায়দার খুন হন। প্রধানমন্ত্রী রাজিব হায়দারের বাসায় যান। পুলিশও খুনি ধরার জন্য তৎপর হয়। ঠিক তখনই ব্লগের কিছু লেখালেখি ‘আমাদের দেশ’ পত্রিকা ছেপে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় যে, ব্লগার মানেই নাস্তিক এবং এই টাইপ লেখালেখি করে। ছাত্র রাজনীতির প্রতি মানুষের একটা নেগেটিভ ধারণা থাকায় মিডিয়া ব্লগার শব্দটি ফোকাস করে। লাকি আক্তার একজন রাজনৈতিক কর্মী কিন্তু মিডিয়ার লোক লাকি আক্তারকেও ব্লগার হিসেবে পরিচয় করেয়ে দিচ্ছিল। ব্লগার শব্দটি যেহেতু নতুন। এছাড়া নোংরা রাজনীতির কালিমা যেহেতু ব্লগার গায়ে নেই সেহেতু এটাই ফোকাস করা হল। এখন কথা আসে হেফাজত ব্লগারদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে কেন গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে দাঁড়াল? গণজাগরণের সংগঠকদের ক্ষুদে অংশ ব্লগার ছিল। এছাড়া এই মঞ্চের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে কয়েক লাখ মানুষ শুধু সমবেত হয়েছে ফাঁসির দাবীকে কেন্দ্র করে। হেফাজতের সুরে বিএনপি নেত্রীও শাহবাগীদের নাস্তিক ট্যাগ দিল। গণজাগরণ যেহেতু যুদ্ধাপরাধী ইস্যু নিয়ে হাজির হয়েছে সেহেতু আদর্শিক ও জামাতের সাথে রাজনৈতিক বিবাহের কারণে বিএনপি এতে যুক্ত হবে না। এবং এটাই ছিল স্বাভাবিক। ‘আমার দেশ’ পত্রিকা ব্লগার মানেই নাস্তিক এমন ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে মাঠে নামে। অথচ যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে জামাতি ব্লগারও অনলাইনে আছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে প্রতিহত করতে তাদের ব্লগার মানেই নাস্তিক এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন পড়ে। গণ-জোয়ারে আওয়ামী লীগসহ অন্যরা ফায়দা নেওয়ার জন্য এসেছিল এবং ফায়দা শেষ হওয়ার পরে চলেও যায় এটাই বাস্তবতা। এখানে খেয়াল রাখা উচিত; বিএনপি নেত্রী যে নাস্তিক ট্যাগ দিল সেই ট্যাগটি মোটেই ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে নয় পুরোটাই রাজনৈতিক। আর এই রাজনৈতিক ক্ষমতা ও ফায়দার জন্য কিশোরগঞ্জের সোয়ালাখিয়া মসজিদের ইমানকেও নাস্তিক ও ইসলামের দুশমন হিসেবে অনলাইনে হাজির করে জামাত-শিবির। এর প্রধান কারণ তিনি গণজাগরণ মঞ্চের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

লক্ষ করুণ, ব্লগারদের লিস্ট তৈরি হয় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ হওয়ার পরেই। এর আগে না। তাহলে স্বাভাবিকভাবে কথা আসে এতো বছর ব্লগে এতো লেখালেখি হল সেই সময় কেন এতো লিস্ট তৈরি হল না। এর সহজ উত্তর হয়তো তারা সুযোগ কিংবা পরিবেশটা পায় নি। যা হেফাজতের উত্থানে মধ্য দিয়ে পরিবেশটা সৃষ্টি হয়। গণজাগরণ মঞ্চের পর হেফাজতের সমমনা সরকারের ওলামা লীগ নাস্তিক ব্লগারদের একটি লিস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এই লিস্টে ৮৪টি নাম যুক্ত করে। এই ৮৪ নামে একজনের দুই তিনটা আইডি যেমন আছেন তেমনি অনেকে নিজেকে নাস্তিক হিসেবে ঘোষণা কিংবা লেখালেখি করে নি এমন মানুষের নামও আছে। তবে এই ৮৪ আইডিগুলোর মধ্যে একটা কমন মিল ছিল; এরা সবাই জামাত শিবির বিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী বিচারের পক্ষে। ওলামা লীগের আগে সম্ভবত ২০১২-১৩ সালের দিকে সামু ব্লগে একটা নাস্তিক লিস্ট বানানো হয়। সৌদিতে অবস্থানকারী আহমেদ আরিফ এই লিস্টটা বানায়। তবে ঐ লিস্ট ছিল সামু ব্লগ কেন্দ্রিক। গণজাগরণের পরেই ব্লগ ছোট্ট গণ্ডি থেকে বড় পর্দায় হাজির হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে ৪ জন ব্লগার গ্রেফতার হলেও পরবর্তীতে আরও অনেক অনলাইনে এক্টিভিস্ট গ্রেফতার হয়। এবং এদের মধ্যে অনেককে প্রথমে শারীরিকভাবে প্রহার করে তারপর পুলিশের কাছে দেয় জামাত-হেফাজত-পন্থী কর্মী বাহিনী।

পাবলিক যেহেতু যুদ্ধাপরাধী বিচারের কারণে ব্লগারদের সমর্থন করে মঞ্চের পক্ষে অবস্থান করছে সেহেতু এর বিপক্ষ শিবিরের লোকজদের সমর্থন আদায়ের জন্য হেফাজত পাবলিক এটেনশন মাথায় রেখে ব্লগারদের নাস্তিক ঘোষণা করে মাঠে নামে। এবং কোরান, হাদিসের বিভিন্ন রেফারেন্স উল্লেখ করে ধর্মের সমালোচনার জন্য ব্লগারদের ফাঁসি দাবী করে। এবং পরবর্তীতে নাস্তিক হত্যা ওয়াজিব ঘোষণা দেয় হেফাজতে ইসলাম। অনলাইনে নাস্তিক ব্লগাররা জামাত-শিবিরের আদি শক্র। মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে মাঠে কিংবা অনলাইনে সুবিধা করতে না পেরে নাস্তিক ব্লগারদের প্রথম টার্গেট করে। গণজাগরণ মঞ্চ হওয়ার পর যতো মানুষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাওয়ার জন্য খুন হল তাদের অধিকাংশকে নাস্তিক ট্যাগ দিয়েই হত্যা করা হয়েছে। উল্লেখ; সিলেটের গণজাগরণ কর্মীকে যখন কুপিয়ে হত্যা করা হয় তখন বলছিল তারা নাস্তিক মারছে। তাহলে একটু ভেবে দেখতে হয় সে ছেলেটা ব্লগিং করে নি সেই ছেলেটি কেন খুন হওয়ার সময় নাস্তিক ট্যাগ খাচ্ছে! একই ঘটনা বগুড়ার গণজাগরণ কর্মীর উপর ঘটে। সমস্যা হল এরা যেহেতু ব্লগিং করত না সুতরাং অনলাইনে এদের নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় নি। কিন্তু আলোচনা না হলেও এদের মৃত্যুর কারণ যে গণজাগরণ মঞ্চ এবং যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাওয়া তা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। বছর খানেক আগে হিজাবের জের ধরে চট্টগ্রামে এক অমুসলিম টিচারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গণজাগারণ মঞ্চের কারণে যতো মানুষ মারা গেল তাদের সবাই মৃত্যু হয়েছে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ইস্যুতে এবং অধিকাংশ নাস্তিক হিসেবে ট্যাগ পেয়েছেন, অথবা ইসলাম বিরোধী ট্যাগ পেয়েছে। এর বাহিরে গোপীবাগের সিক্স মার্ডার, মাওলানা ফারুকী, সর্বশেষ ওলামা লীগের একাংশের নেতা ছুরির আঘাতে আহত হয়। এর খুন গুলো ক্ষমতা ও আদর্শের বিরোধ। যেমন এক পীর আরেক পীরকে ভণ্ড হিসেবে খেতাব দেয় যা পুরোটাই প্রভাব বিস্তারের স্বার্থ।

গণজাগরণ পর যুদ্ধাপরাধী ইস্যু ও ব্লগিং কিংবা নাস্তিক ইস্যুতে যতো মানুষ খুন হল তার মধ্যে ছয়জন ছিল ব্লগিং ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। এছাড়া গণজাগরণ হওয়ার এক বছর পর রাকিব মামুন নামের এক অনলাইন এক্টিভিস্টের উপরও হত্যার উদ্দেশে হামলা চালানো হয়। লক্ষ্য করে বোঝা যাবে যে নিহত সকল ব্লগার গণজাগরণ মঞ্চের সাথে জড়িত ছিল। এদের অনেকে হয়তো ব্যক্তিগতভাবে নাস্তিক কিন্তু এরা জামাত-শিবির বিরোধী ও ধর্মীয় রাজনীতির বিরোধী ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ কে এম সফিউল ইসলাম বোরকা বিরোধী করার জন্য হত্যা করা হয়। এর আগেও জামাত-শিবিরের হাতে রাজশাহীতে অসংখ্য শিক্ষক নিহত হয়। তবে বর্তমান সময়ে মৃত্যুর পর কোন এক ধর্মীয় বিরোধী যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। বলা যায় ব্লগারদের নাস্তিক তকমা যেহেতু প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছে এবং একটি নেগেটিভ ধারণা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে সুতরাং হত্যাকারী মৃত ব্যক্তিকে নাস্তিক ঘোষণা করে একটি অংশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। অন্যরা নাস্তিক ইস্যু শোনা মাত্র নো কমেন্টস শ্রেণিতে চলে যায়।

তাই ব্লগার হত্যা পুরোটাই রাজনৈতিক হত্যা। এটাকে এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। আনসার বাংলা মতন বিভিন্ন নামে জঙ্গি সংগঠনগুলো শুধু নাস্তিক ব্লগার মারে নি, মেরেছে অন্যদেরও। রাস্তা পরিষ্কার করার প্রধান বাঁধা হিসেবে টার্গেট করেছে নাস্তিকদের। কারণ তারা অনলাইনে ধর্মের বিরুদ্ধে যারা লেখে এবং যারা ধর্মীয় রাজনীতির বিরোধী সেই মানুষগুলোকে থামিয়ে দিতে পারলে মানুষের মধ্যে এক ধরণের ভয় কাজ করবে। ফলে কেউ আর প্রকাশ্যে এদের বিরুদ্ধে কিছু লিখবে না। এসব হত্যাকে এরা ইমানী দায়িত্ব হিসেবে হাজির করলেও মূল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক মাঠ দখলের চেষ্টা। আর এই জন্য বেঁছে নেওয়া হয়েছে ব্লগারদের আর হত্যাকারী হিসেবে ব্যবহার করছে একদল ধর্মান্ধ খুনিদের। তাই রাজনৈতিক হিসেবটা বিবেচনা না নিয়ে শুধু ধর্মের জন্য মারা পড়ছে মেরে ফেলছে এমনটা ভাবা সম্ভবত বোকামির শামিল। কারণ রাজনৈতিক স্বার্থ ও ক্ষমতার ফায়দা ছাড়া জঙ্গি সংগঠনগুলোকে কেউ আর্থিক সাহায্য দেয় না।