পুরুষ এবং নারী এই দুই লিঙ্গের বাইরেও আরও লিঙ্গ আছে। আমরা হয়ত অনেকেই জানি না। জানবই বা কেমন করে? কেননা নারী এবং পুরুষের বাইরে অন্য লিঙ্গের মানুষদের আমরা কখনই স্বাভাবিক চোখে দেখি নি। এর কারণ ধর্ম এবং সংকীর্ণ চিন্তাধারার সমাজ ব্যবস্থা আমাদেরকে তাদের সম্পর্কে সব সময় ভুল তথ্য দিয়ে এসেছে।
আমাদেরকে শেখানো হয়েছে নারী এবং পুরুষের বাইরে কোন লিঙ্গ হতে পারে না। নারী এবং পুরুষের বাইরে অন্য লিঙ্গ বৈচিত্র্যকে আমরা সব সময় অস্বীকার করে দমিয়ে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে দামিয়ে রাখতে চাইলেও তা সম্ভব হয় নি। এ রকমই একটি লিঙ্গ বৈচিত্র্য হচ্ছে উভলিঙ্গ।
উভলিঙ্গ হচ্ছে একই সঙ্গে দুই লিঙ্গেরই সহাবস্থান। বাংলাদেশে উভলিঙ্গ মানবদের হিজরা বলে সম্মোধন করা হয়। উভলিঙ্গত্ব প্রকৃতিতে একেবারে বিরল কিছু নয়। আফ্রিকার নিশাচর স্ত্রী হায়েনাদের মধ্যে এ রকম উভলিঙ্গ দেখা যায় । বুশ বেবী, স্পাইডাই মাম্কি, উলি মাম্কি মধ্যেও উভলিঙ্গত্ব বিদ্যমান ( Joan Roughgarden, Evolution’s Rainbow: Diversity, Gender, and Sexuality in Nature and People, University of California Press, May 17, 2004)।
বিভিন্ন প্রজাতির কাকড়া ও প্রজাপতির মধ্যেও এরকম দেখা যায়। একজন ব্যক্তির উভলিঙ্গ হয়ে জন্ম গ্রহণের পিছনে নিজের কোন হাত থাকে না। এ বিষয়ে বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে ক্রোমোজোমের ত্রূটি কারণে যাদের জন্মপরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়, মূলত তারাই উভলিঙ্গ মানব। এদের শারীরিক গঠন ছেলেদের মতো হলেও মন-মানসিকতায় আচার আচরণে সম্পূর্ণ নারীর মতো (she-male)।
উভলিঙ্গ মানবদের বৈশিষ্ট্যগতভাবে দুইটি ধরন রয়েছে, নারী ও পুরুষ। নারী উভলিঙ্গ মানবদের মধ্যে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য থাকলেও স্ত্রীযৌনাঙ্গ না থাকায় তার শারীরিক গঠন আলাদা। পুরুষ উভলিঙ্গ মানবদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। শারীরিকভাবে পুরুষ, কিন্তু মানসিকভাবে নারী স্বভাবের উভলিঙ্গদের বলা হয় ‘অকুয়া’। অন্য উভলিঙ্গদের বলা হয় ‘জেনানা’। উভলিঙ্গ মানব থেকে উভলিঙ্গ মানবের জন্ম হয় না। একটি বিসমকামী দম্পতি থেকে উভলিঙ্গ মানবের জন্ম হয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী মাতৃগর্ভে একটি শিশুর পূর্ণতা প্রাপ্তির ২৮০ দিনের মধ্যে দুটো ফিমেল বা স্ত্রী ক্রোমোজোম X – X প্যাটার্ন ডিম্বানু বর্ধিত হয়ে জন্ম হয় একটি নারী শিশুর এবং একটি female chromosome X ও একটি male chromosome Y মিলে X-Y প্যাটার্ন জন্ম দেয় পুরুষ শিশুর। ভ্রূণের পূর্ণতা প্রাপ্তির একটি স্তরে ক্রোমোজোম প্যাটার্নের প্রভাবে পুরুষ শিশুর মধ্যে অণ্ডকোষ এবং মেয়ে শিশুর মধ্যে ডিম্বকোষ জন্ম নেয়। অণ্ডকোষ থেকে নিঃসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্বকোষ থেকে নিঃসৃত হয় এস্ট্রোজন। পরবর্তী স্তরগুলোতে পুরুষ শিশুর যৌনাঙ্গ এন্ড্রোজেন এবং স্ত্রী শিশুর যৌনাঙ্গ এস্ট্রোজনের প্রভাবে তৈরি হয়। ভ্রূণের বিকাশকালে এই সমতা নানাভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। প্রথমত ভ্রূণ নিষিক্তকরণ এবং বিভাজনের ফলে কিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সূচনা হতে পারে। যেমন X-Y-Y অথবা X-X-Y।
X-Y-Y প্যাটার্নের শিশু দেখতে নারী-শিশুর মতো। কিন্তু একটি এক্সের অভাবে এই প্যাটার্নের স্ত্রী-শিশুর সব অঙ্গ পূর্ণতা পায় না। একে স্ত্রী-উভলিঙ্গ মানব বলে। আবার X-X-Y প্যাটার্নে যদিও শিশু দেখতে পুরুষের মতো, কিন্তু একটি বাড়তি মেয়েলি ক্রোমোজম এক্সের জন্য তার পৌরুষ প্রকাশে বিঘ্নিত হয়। একে পুরুষ উভলিঙ্গ মানব বলে। উভলিঙ্গ হয়ে জন্ম গ্রহণ করার পিছনে উক্ত ব্যক্তির কোন ভূমিকা না থাকলেও সমাজে সহ্য করতে হয় নানা অবহেলা ও নির্যাতন। নির্যাতনের কিছু চিত্র নিচে তুলে ধরা হলঃ
পারিবারিক নির্যাতনঃ একটি উভলিঙ্গ সন্তানকে নিয়ে তার পরিবার সব সময় হিনমন্যতায় ভোগে। এই শিশুকে নিজেদের জন্য অভিশাপ মনে করে। ফলে নানা সময় শারিরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্পদ থেকেও বঞ্চিত করে। এসব নির্যাতন থেকে বাঁচতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজ গোত্রভুক্ত একজনকে প্রধান করে গড়ে তোলে একটি গোষ্ঠি। যাকে আমরা হিজরা গোষ্ঠি বলি। উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় এরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হয়। কাজের সুযোগ না থাকায় বাজারে চাঁদা আদায়,ভিক্ষাবৃত্তি ও যৌন কর্মী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হয়।
সামাজিক নির্যাতনঃএকজন উভলিঙ্গ মানবকে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হতে হয় সমাজ থেকে। পাড়া-প্রতিবেশি,আত্মীয়-স্বজন, ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে শুনতে হয় নানা গঞ্জনা। শারিরীকভাবে পুরুষ এবং চালা-ফেরায় ও মানসিকভাবে নারী আচরণের কারণে বিদ্যালয়ের সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ছোট বেলাতেই লেখা-পড়া থেকে ঝড়ে পড়তে হয়।
ধর্মীয় নির্যাতনঃ ধর্ম পুরুষকে যে চোখে দেখে সেই চোখে নারী এবং উভলিঙ্গ মানবদের দেখতে পারে নি। প্রভাবশালী ধর্ম গুলোতে সব সময় পুরুষকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। হিন্দু ধর্ম সরাসরি শাস্তির বিধান না করলেও পুরুষের মতো প্রধান্য উভলিঙ্গ মানবদের দিতে পারে নি।ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্ম এদের যৌনতা রুখতে সডোমি আইন করেছে। বাংলাদেশে ৩৭৭ ধারা বিট্রিশ প্রণিত এ রকমই একটি আইন।যেখান নারী-পুরুষের যৌনতা ছাড়া সমস্থ্য যৌনতাকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম উভলিঙ্গ মানবের প্রতি আরও কঠোর। ইসলামে এদেরকে জ্বীন ও মানুষের মিলিত সন্তান বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে।তাদেরকে অভিশাপ দেয়া হয়েছে এবং বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার হুকুম দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে একটি হাদিস নিচে তুললে দেয়া হলঃ-
গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৮৬/ দন্ডবিধি (كتاب الحدود)
হাদিস নম্বরঃ ৬৮৩৪
৮৬/৩৩. গুনাহ্গার ও নপুংসকদের নির্বাসিত করা।
৬৮৩৪. ইবনু ‘আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা‘নত করেছেন নারীরূপী পুরুষ ও পুরুষরূপী নারীদের উপর এবং বলেছেনঃ তাদেরকে বের করে দাও তোমাদের ঘর হতে এবং তিনি অমুক অমুককে বের করে দিয়েছেন। (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৩৬০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৩৭৩) . হয়ত ধর্মীয় এসব বিধানের কারণে বাংলাদেশে হিজরা শব্দটাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গালি হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
রাষ্ট্রীয় নির্যাতনঃ রাষ্ট্রের উচিৎ তাদেরকে নিরাপত্তা দান ও সমান অধিকার নিশ্চিত করার। কিন্তু তা না করে নানা ক্ষেত্রেই বৈষম্য করেছে। জাতীয় পরিচয় পত্র এবং ভোট দানের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের বাইরে আলাদা কোন লিঙ্গ পরিচয় রাখা হয়নি। যার ফলে প্রায় সময় নানা সমস্যায় পড়তে হয় সংখ্যালঘু এই মানুষগুলোকে। শিক্ষা,স্বাস্থ্য ও পূনর্বাসন ক্ষেত্রেও যথেষ্ট কোন উদ্যোগ এবং বরাদ্দ করা হয়নি। ২৮ জুলাই ২০১৩ তারিখের BBC BANGLA র একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে উভলিঙ্গ মানবদের দূর্দশার নানা চিত্র। বিস্তারিত দেখুন এখানে https://www.bbc.com/bengali/multimedia/2013/07/130728_fp_bd_hizra
আমাদের কিছু আবেদনঃ
১.নারী, পুরুষের বাইরেরও সমস্থ্য ভিন্ন লিঙ্গের মানুষদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দান ও তার বাস্তবায়ন।
২.সব রকম বৈষম্য দূরীকরণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ।
৩. রাষ্ট্র কর্তৃক নিরাপত্তা দান করা।
৪.প্রচলিত কুসংস্কার দূর করতে সচেতন মূলক প্রচারণার ব্যবস্থা গ্রহণ।
৫.নিরাপদ পরিবেশে শিক্ষার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ।
৬.সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে চাকুরির সুযোগ প্রদান।
৭.৩৭৭ ধারার মতো অযৌক্তিক আইনের বিলোপ সাধন।
৮.যৌন সংখ্যালঘুদের আইনের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ দান।
৯.রাষ্ট্রীয় নির্যাতন বন্ধ করা।
১০.পিছিয়ে পড়া যৌন সংখ্যালঘুদের জন্য শিক্ষা,স্বাস্থ্য ও পূনর্বাসন ক্ষেত্রে যথাযথ বরাদ্দ গ্রহণ।
১১. সমাজের সকল ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতা ও সকলের মর্যাদা নিয়ে বসবাসের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ।
পরিশেষে উপরোক্ত এগার দফা দাবি রাষ্ট্র ও সকল সচেতন মানুষের উদ্দেশ্যে পেশ করা হল।