সমকামীদের বৈধতা এবং অধিকার নিয়ে কোন আলোচনা উঠলেই শুরু হয়ে যায় সমকামী বিদ্বেষীদের নানা কুযুক্তি ও অদ্ভুত প্রশ্ন। অনেক বার সে সব কুযুক্তি ও প্রশ্নের ব্যখ্যা ও উত্তর দেয়া হয়েছে এবং অনেকে এখনও দিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞান তাদের অযৌক্তিক সমকামী বিদ্বেষকে রোগ হিসেবে চিহ্নত করেছে। এত যৌক্তিক উত্তর ও বৈজ্ঞানীক প্রমাণ দেয়ার পরও তারা তাদের সেই কুযুক্তি আর অদ্ভত প্রশ্নকে এখনও বহাল রেখেছে। তাই আজ ঠিক করেছি তাদের অদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর যুক্তি কিংবা বিজ্ঞান দিয়ে দেব না বরং অদ্ভুত উত্তর দিয়েই তাদের প্রশ্ন ও কুযুক্তির মোকাবেলা করব। প্রশ্নসমূহ ও উত্তর নিচে দেয়া হলঃ
১. সমকামীদের স্বাধীনতা দিলে সবাই সমকামিতা করবে।
উত্তরঃ সমকামীদের স্বাধীনতা দিলে আপনি কি সমকামিতা করবেন? যদি সমকামিতা করেন তাহলে সমকামীদের বৈধতার বিরোধীতা না করে বরং বৈধতার জন্য সমকামীদের সাপোর্ট করুন। আর যদি স্বাধীনতা দিলেও সমকামিতা না করেন তাহলে নিজের দিকে তাকিয়েই বুঝুন যে স্বাধীনতা দিলেই কি বা না দিলেই কি, সমকামীরা সমকামীই থেকে যাবে আর বিসমকামীরা বিসমকামীই থেকে যাবে।তাই এ ধরণের অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন।
২. সমকামীদের স্বাধীনতা দিলে পৃথিবী জনশূন্য হয়ে যাবে এবং প্রকৃতি ধ্বংস হবে।
উত্তরঃ ১০% সমকামীকে বৈধতা দিলে বাকি ৯০% বিসমকামী কি বাচ্চা জন্ম দেয়া বন্ধ করে দেবে? যদি ৯০% বিসমকামী বাচ্চা জন্ম দেয়া বন্ধ করে দেয় তখন না হয় আবার ৩৭৭ ধরা দিয়ে সমকামিতা রোধ করবেন।তবে আগে সবাই বাচ্চা জন্ম দেয়া বন্ধ করুক তারপর ৩৭৭ ধারা গ্রহণযোগ্যতা পাবে। আর যদি বাচ্চা উৎপাদন বন্ধ না হয় তাহলে পৃথিবী জনশূন্য আর প্রকৃতি ধ্বংস হওয়ার চিন্তা করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আর যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে এবং বস্তিগুলোতে শিশুরা কষ্ট পাচ্ছে তাতে যদি সমকামীরা বাচ্চা জন্ম না দিয়ে তাদেরকে দত্তক নেয়ার সুযোগ পায় তাহলে প্রকৃতি এবং সমাজ দুয়েরই উপকার হবে।
৩.ছিঃ ছিঃ পশুরাও সমকামিতা করে না আর মানুষ সমকামিতা করতেছে।
উত্তরঃ দেখেও না দেখার ভান করলে সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। প্রযুক্তির এই যুগে এরকম মন্তব্য করে নিজেদের অজ্ঞানতাকে জাহির করবেন না। নিজ দায়িত্বে ইউটিউব চালু করে কিছু মেগাবাইট ব্যয় করুন এবং ১৫০০ প্রজাতির মধ্যে সমকামিতা নিজ চোখে দেখে চোখ গুলো ছানাবড়া করুন।
৪. সমকামী যৌনতায় বাচ্চা উৎপাদন হয় না তাই সমকামীদের বিবাহের বৈধতা দেয়া যাবে না।
উত্তরঃ যৌনতার উদ্দেশ্য যদি বাচ্চা উৎপাদন করা হয় তাহলে বিসমকামীদের মধ্যেও যে অসংখ্য বন্ধা নারী-পুরুষ আছে তাদের বিবাহের বৈধতা দেয়ারও কারণ নাই। আর কন্ডম এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কি দরকার? কন্ডম কিংবা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার না করে বছরে বছরে বাচ্চা উৎপাদন করে যৌনতার উদ্দেশ্যকে সফল করুন। যদি তা না পারেন শুধু মাত্র সমকামীদের ক্ষেত্রে দ্বিচারিতা করবেন না।
৫. সমকামিতা! ছিঃ ছিঃ কি নোংরা কাজ।
উত্তরঃ আপনি বিসমকামী। তাই আপনার কাছে নোংরা লাগতেই পারে। সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যপার। আপনার ব্যক্তিগত ব্যপারকে আপনার ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখে এই কাজ যার ভাল লাগে তাকেই করতে দেন। আর আপনাকে কেউ নোংরা কাজ করতে বাধ্য করে নি। আপনার যৌনতাও তাদের কাছে নোংরা মনে হলেও তারা যেমন আপনার যৌনতায় বাধা দিতে আসে নি তেমনি আপনারও কোন অধিকার নেই তাদের যৌনতায় হস্তক্ষেপ করার।
৬.সমকামিতার ফলে নৈতিকতা হ্রাস পাবে।
উত্তরঃ বিসমকামিতার বৈধতা থাকলেও যেমন কেউ জনসম্মুখে সেক্স করছে না তেমনি সমকামিতার বৈধতার ফলে কেউ রাস্তা ঘাটে জনসম্মুখে সেক্স করে না। আর দুজন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিজের বিছানায় যৌন কার্য করলে যদি নৈতিকতার সমস্যা হয় তবে বলব সে নৈতিকতা থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল।
৭. সমকামিতা প্রকৃতি বিরুদ্ধ যৌনচার।
উত্তরঃ প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক নির্ধারণ করার আমি বা আপনি কে? সমকামী এবং বিসমকামীদের মধ্যকার পার্থ্যকগুলো জেনে নেবেন। আর এই পার্থক্যগুলো প্রকৃতিই নির্ধারণ করছে। তাই সমকামিতাকে প্রকৃত বিরুদ্ধ যৌনাচার বলার অধিকার আপনার নাই। আর প্রকৃতির দ্বারা তৈরী এসব পার্থক্যের কারণে সমকামীরা সমকামিতা করবেই। সেটা আপনার ভাল না লাগলেও করার কিছু নাই। সমকামীদের যদি প্রকৃতির কাছে ভাল না লাগে তাহলে প্রকৃতিই তাদের ধ্বংস করবে কিন্তু প্রকৃতির ঘাড়ে অস্ত্র রেখে সমকামীদের ধ্বংস করার কোন অধিকার আপনার নেই।
৮.সমকামিতার কারণে এইডস্, পাইলস্ এবং ক্যান্সার হয়।
উত্তরঃ বাহ্, কোথা থেকে আসে এসব তথ্য? সমকামিতার কারণে যদি এসব রোগ হয় তাহলে বিসমকামীদের এসব রোগ হওয়ার কারণ কি? HIV ভাইরাস সমকামী বিসমকামী বোঝে না। যে ব্যক্তিই অনিরাপদভাবে যৌন কার্য করবে তাকেই আক্রমণ করবে। আর বাকি রোগগুলোর প্রকৃত কারণ সমকামিতা নয়।
৯. সমকামীরা মানসিক সমস্যায় ভোগে।
উত্তরঃ সমকামীদের উপর যা নির্যাতন পরিবার, সমাজ,ধর্ম এবং রাষ্ট্র করে তা একজন বিসমকামী ব্যক্তিকে করলেও সেই ব্যক্তি আরও আগেই মানসিক সমস্যায় ভুগবে। তাই সমকামীদের মানসিক সমস্যা আপনাদের কর্মের ফল।
১০. সমকামীরা বিকৃত মস্তিস্কের।
উত্তরঃ একজন ব্যক্তি আপনার কোন ক্ষতি না করার পরেও যদি আপনি লাঠি নিয়ে তেড়ে যান তাহলে সবচেয়ে বড় বিকৃত মস্তিস্কের মানুষ হচ্ছেন আপনি। একজন সমকামী আপনার কোন ক্ষতি না করেও যদি আপনার কাছে বিদ্বেষী আচারণের শিকার হয় এবং তাদেরকেই বিকৃত মস্তিস্কের বলে চিল্লান তবে সেটা আপনার মস্তিস্কের সমস্যা তাদের নয়।
১১.সমকামীদের ধর্ষণ করে বিসমকামী বানাতে হবে।
উত্তরঃ এত কষ্ট সমকামীদের জন্য না করে বরং বিদ্যুতের শক দিয়ে নিজের মস্তিস্কের এই চিন্তাধারাকে পরিষ্কার করুন। তাহলে সবার জন্যই মঙ্গল হয়।
১২. সমকামীরা ছোটবেলায় ধর্ষণের শিকার হয়ে সমকামী হয়েছে।
উত্তরঃ বিপরীত লিঙ্গের কেউ আপনাকে ধর্ষণ করে যদি বিসমকামী বানায় তাহলে সমকামীরা সমলিঙ্গের কাছে ধর্ষণের শিকার হয়ে সমকামী হয়েছে এটা মেনে নেব। আর যদি আপনার ক্ষেত্রে তা না হয় তাহলে সমকামীদের ব্যপারে আপনার এই অভিযোগও ভিত্তিহীন।
১৩.সমকামীদের জোর করে বিবাহ দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
উত্তরঃ আপনাকে জোর করে সমলিঙ্গের কারও সাথে বিয়ে দিলে আপনার কেমন লাগবে? একবার নিজেরটা চিন্তা করুন তারপর সমকামীদেরটাও চিন্তা করুন। সমলিঙ্গের সাথে জোর করে আপনাকে বিবাহ দিলে যদি আপনি সমকামী হতে পারেন তাহলে সমকামীরাও বিসমকামী হতে পারবে। আর যদি তা না পারেন তাহলে সমকামীরাও পারবে না।
১৪.সমকামীদের স্বাধীনতা দিলে তো চোর ডাকাত,মাদকাসক্ত,সন্ত্রাসী সবাই কে স্বাধীনতা দিতে হবে।
উত্তরঃ একজন ব্যক্তি সমলিঙ্গের কাউকে ভালবাসলে, চুমু খেলে বা যৌন সম্পর্ক করলে আপনার কোন ক্ষতি আছে কি? আর কেউ চুরি, ডাকাতি,মাদকাসক্ত, সন্ত্রাসী হলে আপনার এবং সমাজের ক্ষতি কতটা? এই দুটো বিষয় যদি নিজে নির্ণয় করতে পারেন তাহলে বুঝতে পারবেন কাকে স্বাধীনতা দেয়া উচিৎ আর কাকে দেয়া উচিৎ নয়।
১৫. সমকামিতা একটি মহা গর্হিত পাপ কাজ।
উত্তরঃ হ্যা, পাপ কাজ হতে পারে কিন্তু অপরাধ নয়। যেমন ঃ ভিন্ন ধর্ম বা মতের হওয়া পাপ কিন্তু অপরাধ নয়, গান শোনা পাপ কিন্তু অপরাধ নয়, নারী নেতৃত্ব পাপ কিন্তু অপরাধ নয়, ভাস্কর্য নির্মাণ করা পাপ কিন্তু অপরাধ নয়, নারীদের বাইরে চলাফেরা করা পাপ কিন্তু অপরাধ নয়,ধর্ম পালন না করা পাপ কিন্তু অপরাধ নয় আবার বাল্য বিবাহ অপরাধ কিন্তু পাপ নয়,বহুবিবাহ অপরাধ কিন্তু পাপ নয়, যুদ্ধে গণহত্যা অপরাধ কিন্তু পাপ নয়, যুদ্ধে ধর্ষণ করা অপরাধ কিন্তু পাপ নয়, দাস প্রথা এবং যৌন দাসি রাখা অপরাধ কিন্তু পাপ নয়। ইশ্বর, আল্লাহর বিধানে সমকামিতা যেহেতু পাপ তাই ধর্মবাদীদের উচিৎ সমকামীদের ইশ্বর আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়। ক্ষমতা থাকল ইশ্বর আল্লাহরাই শাস্তি দেবে। যদিও এখন প্রযুক্তির কারণে ইশ্বর আল্লারা আর শাস্তি নিয়ে আসতে পারে না।
১৬. সমকামীদের কারণে পৃথিবীতে গযব আসবে।
উত্তরঃ মসজিদ,মন্দির, মাদ্রাসা, গীর্জায় অহরহ ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড হওয়ার পরেও যখন কোন গযব আসে নি তাহলে সমকামীদের ভালবাসাকে রুখতে কোন গযব আসার যৌক্তিক কারণ নেই। আর যে দেশগুলোতে সমকামীদের বৈধতা দেয়া হয়েছে সেই দেশগুলো সমকামী বিদ্বেষী দেশগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। গযবের ভয় কিছু ব্যক্তি নিজের স্বার্থের জন্য তৈরী করেছে।
১৭.সমকামীতার কারণে আল্লাহর গযবে লূত সাগর তৈরী হয়েছে।
উত্তরঃ ধর্ম গ্রন্থের লূত সাগর এবং উইকিপিডিয়া ও আরও কিছু সোর্স খুজে তথাকথিত লূত সাগর বা ডেড সি এর প্রকৃত কারণ দেখুন। তাহলেই এই মিথ্যাচার থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবেন।
পরিশেষে বলব সমকামীরাও আপনাদের মত মানুষ এবং সমকামিতাও একটি স্বাভাবিক যৌনতা। তাই সমকামীদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর আগে সব কিছু একটু সুস্থ্য মস্তিস্কে ভেবে দেখুন।
তাশনোভা ফেরদৌসী