রক্তের বন্ধনে মুছে যাক ধূসর জীবনের ক্লান্তি

লেখক: হাসনাত সুজন (হাসনাত সুজনঃ www.facebook.com/DrHasnatSujon)

কার্ল ল্যান্ডস্ট্যাইনার সাহেব তখন ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনায় কাজ করেন। ১৯০১ সালের কোন এক দিন তিনি তাঁর সাথে কর্মরত আরো পাঁচজন বিজ্ঞানী (প্রধানত তাঁর ছাত্র), আর তাঁর নিজের রক্ত নিয়ে ঘুঁটাঘুঁটি শুরু করলেন। সবার রক্তের প্লাজমা আর রেড ব্লাড সেল (বাংলায় বলে লোহিত রক্ত কণিকা, আমার কাছে আরবিসি শব্দটাই সহজ মনে হয়) আলাদা করে একজনের সাথে অন্যজনেরটা মিশিয়ে দেখতে লাগলেন। তাঁর আবিষ্কারটা খুব চমৎকার আর সহজ, কিন্তু প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ।
1

ড. কার্ল ল্যান্ডস্ট্যাইনার (উইকিপিডিয়ায় প্রাপ্ত)

দেখতে পেলেন তিনি, কারো প্লাজমাই নিজের রেড সেলের সাথে কোন রিএকশন করে না। কিন্তু, একজন বিজ্ঞানী ড. প্লেচিং-এর প্লাজমা আরেকজন বিজ্ঞানী ড. স্টার্লির সেলকে, আর ড. স্টার্লির প্লাজমা ড. প্লাচিং এর সেলকে ভেঙে ফেলে (সহজে বোঝানোর জন্য বললাম ‘ভেঙে ফেলে’, সঠিক মেডিকেল টার্ম হচ্ছে Clumping) । রেড সেলের গায়ে লেগে থাকে এক ধরণের এন্টিজেন, আর প্লাজমায় থাকে এন্টিবডি। এই এন্টিজেন আর এন্টিবডিই এই ভাঙাভাঙির জন্যে দায়ী। (১)

ড. স্টার্লির রেড সেলের এন্টিজেনের নাম দেয়া হলো A এন্টিজেন, আর প্লাজমার এন্টিবডির নাম B এন্টিবডি (বিটা এন্টিবডি বা এন্টি বি এন্টিবডিও বলা হয়)। এন্টিজেনের নামে তাঁর রক্তের গ্রুপ হলো A। ড. প্লেচিং-এর ক্ষেত্রে নাম দেয়া হলো B এন্টিজেন আর A এন্টিবডি (আলফা বা এন্টি এ এন্টিবডিও বলা হয়)। তাঁর রক্তের গ্রুপ হলো B। A এন্টিবডি A এন্টিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ক্লাম্পিং করে, আর B এন্টিবডি B এন্টিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ক্লাম্পিং করে। এজন্য ড.প্লেচিং-এর প্লাজমা ড. স্টার্লির সেলকে আর ড. স্টার্লির প্লাজমা ড. প্লেচিং-এর সেলকে ভেঙে ফেলে। ল্যান্ডস্টাইনারের নিজের রক্তে কোন এন্টিজেন নেই, কিন্তু দুই এন্টিবডিই আছে। কোন এন্টিজেন নেই বলে তাঁর রক্তের গ্রুপ হলো O। ১ বছর পরে আমাদের পুরনো বন্ধু ড. স্টার্লি আবিষ্কার করেন কারো কারো রক্তে দুই এন্টিজেনই থাকে, কিন্তু কোন এন্টিবডি থাকে না। তাদের রক্তের গ্রুপ হলো AB। রক্তের এই গ্রুপিং সিস্টেমকে বলে ABO সিস্টেম। (২)

2
(ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ‘বিজ্ঞানের মায়েরে বাপ’ ফেসবুক পেজ)

ড. ল্যান্ডস্টাইনারের এই আবিষ্কারের পরবর্তী একশ বছর আরো প্রায় ২৭০ ধরণের রক্তের গ্রুপ আবিষ্কার হয়। এগুলোকে বলা হয় রেয়ার বা মাইনর ব্লাড গ্রুপ। তাঁর এই আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে ১৯০৭ সালে রিউবেন ওটেনবার্গ নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হসপিটালে প্রথম ব্লাড ট্রান্সফিউশন করেন। এজন্যে ল্যান্ডস্ট্যাইনারকে বলা হয় ফাদার অব ট্রান্সফিউশন মেডিসিন। ১৯৩৭ সালে আলেকজান্ডার উইনারের সাথে Rhesus বানর নিয়ে গবেষণায় তিনি Rh ফ্যাক্টর আবিষ্কার করেন। যাদের রক্তে D Rh ফ্যাক্টর থাকে, তাদের রক্তের গ্রুপ পজিটিভ, যাদের থাকে না তাদের গ্রুপ নিগেটিভ। এই সিস্টেমকে বলে Rh সিস্টেম। রক্তের গ্রুপিং করার সময় ABO এবং Rh দুই পদ্ধতিই পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়।

সোশাল মিডিয়া আর ইন্টারনেটের কল্যাণে নিচের এই ছবিটা প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে।

3
এটা দেখে এক নজরে বোঝা যায়, কে কোন গ্রুপকে রক্ত দিতে পারবে, আর কে কোন গ্রুপ থেকে রক্ত নিতে পারবে। এমনকি আমি যখন ইন্টারমেডিয়েটে পড়তাম তখন আমাদের প্রাণিবিজ্ঞান বইয়েও এরকম একটা চার্ট ছিলো। সত্যি কথাটা হচ্ছে, নিজের গ্রুপ ছাড়া অন্য গ্রুপকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কখনোই রক্ত দেয়া যায় না। উপরের চার্টটি স্রেফ থিওরেটিকেল। এর কোন প্র্যাকটিকেল ব্যবহার নেই। কারণ ব্যাপারটা এমন না যে, রক্তে শুধু আমি উপরে যে এন্টিজেন আর এন্টিবডির কথা বলেছি শুধু সেগুলোই থাকে। রক্তে আরো হাজারো রকম উপাদান থাকে এবং সেগুলোও বিভিন্ন ধরণের বিক্রিয়া করতে পারে। তাই রক্ত দেয়ার আগে শুধু গ্রুপিং নয়, ডোনার আর রিসিভারের রক্ত একে অন্যের কম্পেটিবল কি না তা জানার জন্য ক্রস ম্যাচিংও করতে হয়। এমনকি ক্রসম্যাচড রক্তও রিসিভারের শরীরের অনুপযুক্ত হতে পারে।

নোবেল লরিয়েট কার্লের জন্মদিন ১৪ জুন। তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে এই দিনটিকে ‘বিশ্ব রক্তদাতা দিবস’ হিসেবে প্রতিবছর পালন করা হয়।

প্রতি বছর বাংলাদেশে কয়েক লাখ ব্যাগ রক্তের দরকার হয়। সন্ধানী, মেডিসিন ক্লাব, বাঁধনের মতো সংগঠনগুলো সংগ্রহ করতে পারে মোটামুটি ৭০ থেকে ৮০ হাজার।

আপনার জীবনে আপনি যত কাজ করেছেন, তার মধ্যে কোন কাজটা নিয়ে আপনি সবচেয়ে গর্ববোধ করেন?- এই প্রশ্নটা আমাকে করা হলে আমি সাথে সাথে উত্তর দেবো, আমার এই ২৪ বছরের জীবনে আমি ১৯ বার রক্ত দিয়েছি।

আমার জীবনের খুব কষ্টের কিছু দিন আমি পার করছি মেডিকেল কলেজে। না, খাওয়া-পরার কষ্ট নয়- মৃত্যু দেখার কষ্ট। মৃত্যু দেখতে দেখতে মেডিকেল কলেজের ছেলেমেয়েরা একসময় অনুভূতিশূন্য হয়ে যায়। আমিও মোটামুটি তাদের লেভেলে পৌঁছে গেছি। কিন্তু পুরোপুরি তাদের লেভেলে এখনো পৌঁছাতে পারি নি মনে হয়। বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যুতে আমার কোন আবেগ আসে না, কিন্তু কোন শিশুর মৃত্যু আমি এখনো সহ্য করতে পারি না।

আমার কাছে মনে হয়, প্রতিটি শিশুর এই পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার আছে। আবার বলছি, ইটস নট আ প্রিভিলেজ, ইটস হিজ/হার রাইট। আর এটা আমাদের দায়িত্ব, তার অধিকার নিশ্চিত করা। যখন একটা শিশু মারা যায়, তখন আমার মনে হয় শিশুটির প্রতি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি। আর একটা বাচ্চা যখন রক্তের অভাবে মারা যায়, তখন আমার মনে হয়, আমরা বাচ্চাটাকে হত্যা করেছি।

উপরের লাইনটা ব্যাখ্যা করা দরকার। আপনার শরীরে রক্তের রেড সেলগুলোর আয়ু ১২০ দিন। ১২০ দিন পর পর আপনার কিছু করা লাগবে না, এরা মরবে এবং নতুন করে তৈরি হবে। অন্যান্য যেসব সেল আছে যেমন হোয়াইট সেল বা শ্বেত কণিকা, প্লেটলেট বা অণুচক্রিকা, তাদের আয়ু আরো কম-সপ্তাহখানেক। আরেকটা ব্যাপার নোট করুন, অনেকে ভাবেন, রক্ত দিলে তো আমার শরীরে রক্ত কমে যাবে। আমার তখন কী হবে? স্যার, আপনার কিছুই হবে না। হিউম্যান বডি ইজ আ ফেসিনেটিং মেশিন। একজন মানুষের শরীরে রক্ত থাকে গড়পড়তা ৫ লিটার। আপনার শরীর থেকে যদি হঠাৎ করে ১ লিটার রক্তও বের হয়ে যায়, ‘নেগেটিভ ফিডব্যাক’ নামক মেকানিজমের কারণে আপনি মারা যাবেন না, ঠিকই সুস্থ হয়ে উঠবেন। (৩) ১ লিটার রক্ত বের হয়ে গেলেও যেখানে কিছু হয়না, সেখানে আপনার কাছ থেকে আমরা রক্ত নেই মাত্র ৩৫০ এমএল। তাই ঐ রক্তটুকু দেয়ার ফলে আপনি ইচ্ছা করলেও মারা যেতে পারবেন না।
4
(ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Textbook of Medical Physiology by Guyton and Hall)

এই যখন বাস্তবতা, তখন একটা বাচ্চা যখন রক্তের অভাবে মারা যায়, তাকে আমি ‘হত্যা’ ছাড়া আর কোন নাম দিতে পারি না। সুতরাং আপনার শরীরে নষ্ট হতে যাওয়া সামান্য রক্ত দিয়ে—যে-পরিমাণ রক্ত দিলে আপনার কিছুই হবে না— কারো একদিনের বাচ্চাটাকে বাঁচাবেন, না তাকে মরতে দিবেন, কারো অসুস্থ মাকে বাঁচাবেন, না ভাববেন, দূর! বুড়ি মরুক, আমার তো আর মা নয়, একজনের প্রেয়সীকে বাঁচাবেন, না মেরে ফেলবেন, তা একান্তই আপনার সিদ্ধান্ত।

আপনি যখন রক্ত দিচ্ছেন না, এবং তার ফলে একটা সদ্য জন্ম নেয়া টুকটুকে বাচ্চা মারা যাচ্ছে, তখন শুধু একটা কথাই মনে রাখবেন, ঐ বাচ্চাটা আপনারও হতে পারতো।

5

(ছবি কৃতজ্ঞতাঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)

আমাদের রক্তের বন্ধনে মুছে যাক ধূষর জীবনের ক্লান্তি।

পুনশ্চঃ লেখার শিরোনাম মেডিসিন ক্লাবের ২০০৯-১০ সেশনের শ্লোগান।
পুনশ্চ পুনশ্চঃ লেখাটি লেখার জন্য প্রিয় হিল্লোলদার অবদান অনস্বীকার্য।

সূত্রঃ
(১) British Journal of Haematology, Volume 121, Issue 4, May 2003
(২) (৩)Textbook of Medical Physiology by Guyton and Hall