বাঙলাদেশের আপনাকে খুব প্রয়োজন

আমাদের মনস্তত্ত্ব সম্ভবত নারীকে নির্যাতিত হবার পরে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, নতজানু হয়ে করুণা প্রত্যাশা করতে দেখতেই অভ্যস্ত। নির্যাতিত না হোক, একজন নারী মাত্রই সে নতজানু হবে, সামাজিক নিয়ম কানুন এবং পুরুষতন্ত্রের প্রতি সদা সর্বদা জ্বী হুজুর রকমের বাধ্য থাকবে, এটাই আমরা দেখতে চাই। একজন নারীও অপর নারীকে এভাবেই দেখতে চায়। এই প্রবল কঠিন ধারণার মধ্যে তসলিমা নাসরিন এক বড় চপেটাঘাতের নাম। এক বিশাল ধাক্কার নাম। আমরা আসলে ভয় করি এই নামটি, উচ্চারণ করতেও আমাদের মেরুদণ্ড বেয়ে এক ভয়ের স্রোত নেমে যায়।
একজন লেখকের কলম কতটা শক্তিশালী হতে পারে, সেটা তসলিমা নাসরিনকে দেখে বুঝতে হয়। যেই মোল্লাদের হাতে অসংখ্য চাপাতি, অসংখ্য বোমা, অসংখ্য রামদা, যাদের হাত রক্তাক্ত, তারা তসলিমার একটা সামান্য কলমের খোঁচায় ভয়ে হেগে মুতে একাকার করে দেয়। তসলিমা নাসরিন নামটিই মোল্লাতন্ত্রের জন্য এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। তসলিমা নাসরিনের ছোট বলপয়েন্ট কলম সারারাত ধরে উপর্যুপরি ধর্ষণ করতে পারে তামাম পুরুষতন্ত্রকে, তামাম মোল্লাতন্ত্রকে। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত পুরুষতন্ত্র চিৎকার করে কাঁদে, তসলিমার কলমের কাছে নতজানু হয়ে করুণা ভিক্ষা করে। আমরা এই দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত নই। আমাদের দ্বিধা হয়। আমাদের ভয় হয়। এ কেমন দৃশ্য? এরকম তো আগে কখনো দেখি নি!

যে দেশে আপনার নামে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত ছিল, সেই দেশে আপনার নাম উচ্চারণও নিষিদ্ধ। আপনি এক জলজ্যান্ত ধর্মানুভূতি, শিশ্নানুভূতিতে আঘাতের নাম। পুরুষতন্ত্রের দু’পায়ের মাঝে কষিয়ে এমন জোরে লাথি মারতে আর কেউ এদেশে পারে নি। আপনার এক একটা কবিতা তাদের পিছ মোরা করে বেধে সারারাত পেটাবার অনুভূতি দেয়। আপনার উচ্চারিত এক একটা শব্দ তাদের লক্ষ লক্ষ ওয়াজ নসিহতের চাইতে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আপনার ফিরে আসা এদেশের পুরুষতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর, এদেশের মোল্লাতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু বাঙলাদেশে পুরুষতন্ত্রের নিচে চাপা পরে থাকা অজস্র নারী তসলিমা নাসরিন হতে চায়। তারা স্বপ্ন দেখে, একদিন ঠিকই তারা আপনার মত হবে।

তসলিমা নাসরিনের ভার বহনের ক্ষমতা বাঙলাদেশের হয় নি। তাই তিনি বাঙলাদেশে ফিরে আসতে পারেন না। তার অনুমতি নেই এদেশে ফেরার। তিনি ফিরে আসলে এই দেশ দুই হাত তলিয়ে যাবে হয়তো! যেই জাতি একজন লেখকের কলমকে ধারণ করতে পারে না, সে জাতির ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের চাইতে উন্নত কিছু নয়। তসলিমা নাসরিন বহির্বিশ্বে নিজেই একজন বাঙলাদেশ। উদ্ধত, অহংকারী, খ্যাপাটে, আবার শিশুর মত সরল এই মানুষটিকে সামনা সামনি দেখে মুগ্ধতা আর ঘোর এখনো কাটে নি। আজ এই প্রিয় মানুষটির জন্মদিন। তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

বাঙলাদেশের আপনাকে ধারণ করার ক্ষমতা তৈরি হোক। আপনি ফিরে আসুন আপনার জন্মভূমিতে। বাঙলাদেশের আপনাকে খুব প্রয়োজন।