তখন যুগান্তরে স্পোর্টস-এ কাজ করি। ‘বাউন্সার’ নামে একটা নিয়মিত কলাম লিখতাম। কলামের নাম ‘বাউন্সার’ দেয়ার কারণ ছিল সোজাসাপ্টা আক্রমণাত্মক লিখতাম। সঙ্গত কারণেই তা ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের পছন্দ হত না। পছন্দ নাই বা হতে পারে, তাই বলে লেখককে রগড়ে দেয়ার হুমকি? হ্যাঁ, এখানে সেটাও সম্ভব। খুবই সম্ভব। কিন্তু কি করব? সেই শৈশব থেকেই যে এই ক্রিকেট অস্থিমজ্জায় মিশে গেছে! রাশিরদোষ, কিছুই করার নেই। আমাদের সময়ে টিভিতে খেলা দেখাত না। একমাত্র উপায় ছিল রেডিও। ১৩/১৪ বছর বয়সে আর সবাই যখন ফুটবল নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছে আমি তখন কানের কাছে রেডিও নিয়ে হোল্ডিং, গার্নার, মার্শালদের তোপের মুখে গাভাস্কার, বিশ্বনাথ, সোলকারদের নাস্তানাবুদের কথা শুনছি..।
ক্রিকেটে যে টার্মসটা সচারচর কেউ ব্যবহার করেনা আমি সেটাই করতাম, প্রিডিকশন করতাম। ‘ক্রিকেট ইজ গ্লোরিয়াস আনসার্টেনিটি’ কথাটা মানতাম না।কারণ আমি মনে করতাম খেলাটা যখন দেখা যেত না তখন শুনে শুনেই তার ভেতর চলে যেতে পারি। সুতরাং সম্ভবত খেলাটা বুঝি। সেই বুঝ থেকে হোক বা খেলাটার প্রতি প্রচণ্ড টান থেকে হোক প্রিডিকশন করতাম। সব ফলে যেত না, কিছু কিছু ফলত। আর কিছু কিছু অনেক দেরিতে ফলত।
৯৭ সালে ‘ভোরের কাগজে’ ভারতের আজহার উদ্দিনকে নিয়ে সন্দেহ করতে করতে একদিন দুম করে লিখে বসলাম-‘আজহার ম্যাচ গড়াপেটা করে’! আর যাই কোথায়! সাথে সাথে পত্রিকা অফিসে ফোনের পর ফোন। এবং পরদিন কয়েকজন আজহারপ্রেমী লাঠিসোটা নিয়ে বাংলামটরে ভোরের কাগজে এসে হাজির! ‘শালা বাইরা, হুতাইয়া হালামু’। সে যাত্রা অনেক কসরত করে রক্ষা পেলাম। আবার কলকাতায় ভারত-পাকিস্তান টেস্টে বলে দিলাম-‘আজহার ম্যাচ গড়াপেটা করছে’। আবারও হৈ হৈ রৈ রৈ।
সেই ভোরের কাগজেই ৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল রওনা হওয়ার আগেই লিখে ফেললাম-‘বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হারাবে’। এবারও পাকিপন্থী সমর্থকদের হুমকি-‘শালা গণকগিরি মারাও, পাকিস্তান না হারলে তোর খবর আছে!’ ২০০৩ বিশ্বকাপে নিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমর্থক হয়েও কি মনে করে একটা ম্যাচের আগে লিখে বসলাম-‘লারা এই ম্যাচে ডাক মারবে!’ পোড়া কপাল আমার! ২১টি বল খেলে আমার হিরো ডাক মারলেন! সেই বিশ্বকাপে ‘আজকের কাগজ’-এ প্রতিদিনই প্রথম পাতায় আমার প্রিডিকশনমূলক লেখা থাকত। যদ্দুর মনে পড়ে সেই বিশ্বকাপেই কেনিয়া সেমিতে উঠেছিল। সে সময় ভোরের কাগজ, আজকের কাগজ, যুগান্তর, জনকণ্ঠ, অন্যদিনের খেলা, ক্রিড়াজগৎ-এ নিয়মিত লিখছি..।
ঠিক সেই সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটাকাশে উল্কার মত আবির্ভূত হলেন আশরাফুল। শ্রীলংকায় প্রথম টেস্টেই সেঞ্চুরী মেরে দিলেন। সবাই কাছা খুলে প্রশংসা করলেন। আমিও করলাম। কিন্তু যতটা না ক্রিকেট তার চেয়ে বেশি লিখলাম ব্যক্তি আশরাফুলকে নিয়ে। লেখাটা ছিল টাচি। আশরাফুলের বাবা লেখটা পড়েআবেগাপ্লুত হলেন। বাড়ি গিয়ে ওর মাকে দেখালেন। আশরাফুল দেশে ফিরলে ওর মা লেখাটা দেখিয়ে বললেন- ‘এই লেখকের সঙ্গে দেখা করে দোয়া নিয়ে আয়, উনি তোকে আপন ছোট ভাইয়ের মত পরামর্শ দিয়েছে’। যথারীতি আশরাফুল যুগান্তর অফিসে হাজির। স্পোস্টস সেকশনে এসে সোজা পা-ছুঁয়ে সালাম করাতে আমি ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম। এর পর ঘন্টাখানেক ওর সাথে কথাবার্তা হল। ওই লেখাটার সারমর্ম ছিল- ‘কখনো ভুলে যাসনে তুই কোথা থেকে উঠেএসেছিস।তুই ধনী পরিবার বা এলিট পাড়া থেকে আসিসনি।তাই তোকে পা ফেলতে হবে খুবসাবধানে। তোর মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়া লোকের অভাব হবে না।সো বি কেয়ারফুল মাইব্রাদার!’
কিন্তু ওই আলাপচারিতায় সে এমন কিছু কথা বলে বসল যা শুনে আমি হতবাক! ও চলে যাওয়ার পরে যুগান্তরের পারভেজকে বলেছিলাম-এই ছেলে মরবে। স্টার হওয়ার বিড়ম্বনা সইতে পারবে না। যে কোনো সময় হড়কে যাবে। যা হোক ওকে নিয়ে আর কখনো কোনো হৃদয়গ্রাহী বা স্ক্রুপ লেখা লিখিনি। তারপর সময় পেরিয়ে গেছে সময়ের নিয়মে।
এরপর বাংলাদেশের পাকিস্তান সফরের মুলতান ম্যাচ নিয়ে লেখার পর পরই আমার ক্রিকেট লেখার যবনিকাপাত। কিন্তু কেন? কারণ আমরা এখনো ক্রিকেট সংস্কৃতিতে রপ্ত হতে পারিনি। ভারত-পাকিস্তানের ধারাবাহিকতায় আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতি ঋদ্ধ হলেও আমরা ক্রিকেট কেন, যে কোনো বিষয়ে পরমতসহিষ্ণু হতে পারিনি। বিশ্বকাপ থেকে ভারতের বিদায়ের পর সারা ভারত জুড়ে রাহুল আর সৌরভের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়েছিল। এমনকি খাটিয়ায় ডামি দিয়ে লাশ বানিয়ে শ্মশাণযাত্রাও হয়েছিল। কই, তারা তো তেড়ে ফুড়ে তাদের মারতে যায়নি! আমাদের রক্তে সমালোচনা সহ্য করার উপাদান নেই। আছে সব কিছু মাস্তানি দিয়ে রফা করার গ্রাম্যতা। আছে ক্ষমতা প্রদর্শনের হার্মাদী।
মুলতান ম্যাচের বাংলাদেশের জয় যখন ‘সময়ের ব্যাপার’। যখন ইনজি তার শেষ পার্টনার উমর গুলকে নিয়ে ম্যাচ বাঁচানোর জন্য দোয়া-দুরুদ পড়ছে ঠিক সেই সময় ম্যাচটা হারতে ইচ্ছে হল খালেদ মাহমুদের। এর আগে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের সময় রশীদ লতিফের সেই বিখ্যাত চুরি তো ছিলই, কিন্তু তার চেয়েও বড় বিস্ময় হয়ে উঠল হঠাৎই রফিককে সরিয়ে বল বদলে নতুন বল হাতে সুজনের আবির্ভাব! রফিকের বলে ইনজি খেলতে পারছিল না। গুল তো রীতিমত কাঁপছিল। সেই অবস্থায় সুজন নতুন বল শুরু করতেই ইনজি ধমাধম গোটা কয়েক বাউন্ডারি মেরে ম্যাচটা বের করে নিল।
ম্যাচ শেষে বাংলাদেশের প্রায় সব ক্রিকেট সাংবাদিক আঙ্গুল তুলল রশীদ লতিফের দিকে এবং অশোকা ডি সিলভার দিকে। ওর জালিয়াতির কারণেই আমরা ম্যাচটা হারলাম। আমি লিখলাম- ওটা ছিল সেকেন্ডারি। হারার অন্যতম কারন সুজনের পল্টি। হয় সুজন পল্টি মেরেছে, অথবা ওর নির্বুদ্ধিতায় ম্যাচ হেরেছি। যে কোনো বিচারে ৮০ ওভারের পুরোনো বলে রফিকের মত স্পিনারকে মোকাবেলা করা সম্ভব না গুলের পক্ষে। সেখানে কি কারণে সুজন তার স্লো মিডিয়াম পেস শুরু করল? হিরো হওয়ার বাসনা?
ওই যে আমি বললাম- হয় হিরোইজম থেকে নির্বুদ্ধিতা, অথবা ডাল মে কুছ কালা! ব্যাস! আর কোথায় যাই! সাথে সাথে আমার সমালোচনায় কাগজের পাতা ভরে উঠল। প্রায় সব ক্রিকেট সাংবাদিক আমার মুণ্ডু চেয়ে বসলেন। এখানেই শেষ হল না। প্রথম আলো’র মোস্তাফা মামুনের নেতৃত্বে ক্রিকেট সাংবাদিকরা জরুরি মিটিং করে আমাকে বয়কট করার জন্য সব কাগজকে নির্দেশ দিলেন। আকরাম, সুজন, রফিক, পাইলট এমনকি আশরাফুল পর্যন্ত আমার চামড়া দিয়ে জুতো বানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। মাত্র একজন এসব কিছু না করে আমাকে সমর্থন করেছিলেন, হাবিবুল বাশার সুমন।
তারপর আরো কিছুদিন অনিয়মিত লিখেছি। কিন্তু আগের সেই আগ্রহ আর ছিলনা। মনটা এতটাই বিষিয়ে উঠেছিল যে শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট লেখার ইতি টেনে দিয়েছিলাম। কিন্তু ইতি টানার আগে যে কথাগুলো বলে গেছিলাম তার প্রায় সবই সময় মত ফলে গেছে। এতে আমার গৌরব বাড়েনি, বরং কষ্ট বেড়েছে। রাজ্জাকের বোলিং অ্যকশন দেখেই বলেছিলাম, ও চাকিংয়ের দায়ে পড়বে। পড়েছিল। পরে অস্ট্রেলিয়া থেকে সংশোধন করে এসেছে। যে তিন-চার জনকে সন্দেহ করে তাদের নাম বলেছিলাম আজ সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের মুখোস খুলে পড়েছে। রাজশাহী থেকে ঝুড়িভর্তি আম এনে সিলেক্টরদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়া পাইলট থেকে শুরু করে এদের সবার কেমিস্ট্রি এখনো পুরোটা উন্মোচিত হয়নি। যতটুকু হয়েছে তা সামান্য। জানিনা বাকিটুকু আবারও মুখোসের নিচে ঢাকা পড়ে থাকবে কি না। এদের শাস্তি হবে কিনা তাও জানিনা। হওয়া উচিত। নিশ্চিতভাবেই হওয়া উচিত। তবে আমি আমার অবস্থান নিয়ে আজ এত বছর পরও নিশ্চিত এবং গর্বিত। যে ‘প্রথম আলো’ নেতৃত্ব নিয়ে আমার ক্রিকেট লেখায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে দলবল নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা দেখিয়েছিল, আজ সেই প্রথম আলো-ই ব্যানার হেডিংয়ে ম্যাচ গড়া পেটার কেচ্ছা ছেপেছে। প্রথম পাতা জুড়েই আজ প্রথম আলো’র ব্যাক টু দ্য প্যাভেলিয়ন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন থ্রি-ডি-তে নেই। অবৈধ কালো টাকার উপর ভাসছে গোটা দেশের ক্রিকেট। সেই কালো টাকার মালিকেরা কোটি কোটি টাকা সাদা করা এবং আরো কোটি কোটি টাকা কামানোর জন্য ডবকা তরুণী ভাড়া করে বেশ্যাবৃত্তি করার বদলে ‘সাফ-সুতোর’ খেলা ক্রিকেটকে বেছে নিয়েছে। টি-টুয়েন্টি নামক এই অপ্রতিরোধ্য জুয়ার বলি হচ্ছে নিম্নবিত্ত ঘরের উচ্চাভিলাষী আশরাফুল, রফিক,পাইলটরা। জানিনা, হয়ত ঢাকনা সরালে আরো কিছু বেরিয়ে পড়তে পারে। এখানে কোনো আপোষের যাজায়গা নেই। যে দেশে টাকার অভাবে হাসপাতাল হয় না, স্কুল হয় না, উপকূলরক্ষা বাঁধ হয় না, আশ্রয়কেন্দ্র হয় না, টিনের চাল হয়না, ফুটপাথে কাটানো লাখো মানুষের মাথার উপর আচ্ছাদন হয় না, ভূখা, নাঙ্গা কোটি মানুষের পেটের অন্ন হয় না, সেই দেশের ক্রিকেট বিলাসিতায় শত শত কোটি দু’নম্বরি টাকা বাতাসে উড়ে বেড়ায়। সেই কোটি টাকা নিয়ে চলে আরো কোটি কোটি টাকার জুয়া। জুয়া যদি খেলতেই হয় তা সাধারণ মানুষের আবেগ নিয়ে কেন? বড় বড় ক্লাবে যেতে কে মানা করেছে? এই শহরের কোনো একটি অঞ্চলকে লাস ভেগাস বানাতেই বা কে মানা করেছে? তবে সেটা আপনারা আপনাদের সমাজেই সীমাবদ্ধ রাখুন। সাধারণ মানুষকে আর এরমধ্যে টানবেন না।