মুখোশের আড়ালে মোডারেট মুসলিম

মধ্যপন্থী মুসলিমরা ধর্মকে নিজেদের সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করে। আমি হাসলাম। কেন এই অপচেষ্টা? সব কিছু জেনে ও বুঝেও তারা নিজেদের ইচ্ছামতো টুকরো টুকরো করে ধর্ম পালন করে। একটি দ্বিমুখী অভিশাপ। তারা অপরাধ করে কিন্তু যখনই ইসলামকে আক্রমণ করা হয়, তারা তাদের সুর পাল্টে ভয়ানক বিষাক্ত অভিশাপে পরিণত হয়। তারা অনেক বেশি ভয়ংকর। আপনার কাছে তাদের অভাব হবে না।

অভিজিতের মৃত্যুতে হাজারো কণ্ঠস্বর গর্জে উঠেছিল- আশা ছিল রাষ্ট্র ও সচ্ছল মানুষ মিলে ধর্ম সন্ত্রাসীদের রুখে দেবে। ওয়াশিকর রহমান বাবু হত্যার পর বাংলাদেশের যুবরাজ বলেছিলেন, তিনি আসলেই একজন ভোটার। যেহেতু নাস্তিকদের হত্যাকারীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাংক সেহেতু নাস্তিক হত্যার ঘটনায় রাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবে। ওই দিনই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সন্ত্রাসীরা অনন্তবিজয় দাসকে হত্যা করে।

সেই গর্জন প্রতিবাদী কণ্ঠ আজ তাদের সুর পাল্টেছে। তারা ভীত ইঁদুরের মতো তাদের গর্তে প্রবেশ করেছে। সবাই আমাকে বলে- অভিজিৎ নাকি অনন্তরা খুব মৌলবাদী ছিল! ইসলামী ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার কি দরকার ছিল? ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে আপনি (মুক্তমনা মানুষ) মুসলিম সমাজের কী লাভ করছেন?

প্রশ্নটি যৌক্তিক। উত্তরটি আরও সহজ। যে সমাজে ধর্মীয় অনুভূতি প্রবল সেখানে বস্তুবাদী উন্নয়ন রাজনীতি অসম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির কথাই ধরুন। যে দলই ইসলামী মৌলবাদে ইন্ধন দিতে পারে, তারা মুসলিম ভোটের জোরে ক্ষমতায় আসবে। চিট ফান্ডের কারণে পশ্চিমবঙ্গে পরিবারের পর পরিবার ধ্বংস হয়েছে – তবুও আজ সেই দলের চুরির কারণে রাজ্যের মানুষ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তারা এখনও রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে মুসলিম ভোট ও অনুগ্রহের জন্য। গুন্ডাদের হ্যাঁ, কারণটা সেই ধর্মীয় অনুভূতি। বিজেপির বৃদ্ধির কারণ সেই ধর্মীয় অনুভূতি। অভিজিৎ বা আমি বা মুক্তমনা কোনো সদস্য বস্তুবাদী পাওয়ার আশায় এসব লিখিনি। বরং আমরা আমাদের জীবন দিয়ে সত্য লিখেছি। বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় এই ধর্মীয় অনুভূতি। যাকে কাজে লাগিয়ে সীমাহীন দুর্নীতি ও ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়।

কণ্ঠের এই পরিবর্তনে আমি অবাক হই না। অ্যালান ব্লুম লিখেছেন, আপনি কি বুর্জোয়াদের সঠিক সংজ্ঞা জানেন? বুর্জোয়া হল সেই ব্যক্তি যে সর্বদা মৃত্যুকে ভয় পায় এবং নিজেকে বাঁচানোর জন্য সর্বদা “পরিকল্পনা করতে” ব্যস্ত থাকে [
Nietzsche, Nihilism and the Philosophy of the Future-পৃষ্ঠা ৬৯]। তাই যখন এটা স্পষ্ট যে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সাধারণ মুসলমানরা নাস্তিকদের হত্যার পক্ষে, তখন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে ফেসবুকে বেশিরভাগ নাস্তিকরা তাদের প্যান্ট ভিজেছে। সর্বোপরি, এই খুনিদের নেটওয়ার্ক সর্বত্র। অসংখ্য সন্ত্রাসী সেল। তারা সবাই আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী। উপর থেকে আদেশ এলেই তারা দেয়ালে নেমে যাবে।

মুশকিল হল তারা সেই ভয়ের কথা বলতে পারে না – এখন অভিজিৎ রায় শুরু করেছেন, বাবু, অনন্তের চিন্তাধারা কি মৌলবাদী ছিল নাকি!! এগুলো নির্লজ্জ মিথ্যা। অভিজিৎ রায় কোনো বিকল্প রাজনীতি বা সমাজ নিয়ে লেখেননি। তারা অসীম বিজ্ঞান নিয়ে লিখতেন। তারা কি কাউকে বন্দুক দিয়ে হত্যা করতে বলেছে? তারা কি বলেছে এটাই জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, রাষ্ট্র বা সমাজ? কমিউনিস্টরা বলে নাকি ধর্মীয় উগ্রবাদীরা? তারা শুধু চোখ-কান খোলা রেখে ধর্মের নামে প্রতারণা করেছে। কবে থেকে ধর্মের প্রতারণা, কুসংস্কার-বিজ্ঞানের চর্চা উগ্র চিন্তাধারায় পরিণত হলো?

না – এগুলো মোটেও মৌলবাদী নয়। যুক্তিবাদী চিন্তা। আর আসল সত্য হল, বুর্জোয়াদের আসল ভয় এখন নির্ভীক। দুঃখিত, আমি দুইবার এত মহান জীবনের মৃত্যু হজম করতে পারি না।

অবশ্যই সবার ভয় আছে। কিন্তু ধর্মীয় উগ্রবাদীরা যদি মৃত্যুভয়কে জয় করে থাকে, আর নাস্তিকরা যদি সবসময় মৃত্যুকে ভয় পায়, তাহলে বলতেই হবে যে, যে দর্শন মৃত্যুভয়কে দূর করেছে- সেই দর্শন অনেক বেশি শক্তিশালী! সেই দর্শনে যত জলই থাকুক না কেন! সর্বোপরি, জীবন একটি দুর্ঘটনা। জীবনের কোন চূড়ান্ত উদ্দেশ্য নেই। একজন সত্যিকারের নাস্তিক মৃত্যুকে ভয় করতে পারে না – কারণ জীবনের যদি কোন উদ্দেশ্য না থাকে – তাহলে জীবন থাকা বা না থাকার মধ্যে পার্থক্য কী? পার্থক্য খুবই সামান্য। আমরা যে সময়টা বেঁচে থাকি, আমরা আমাদের জীবনকে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারি কি না।

ইতিহাসের শিক্ষা হল এই – যে দর্শন যুক্তিবিদ্যা বা বুদ্ধিমত্তা বা মানবিকতায় সেরা – সামাজিক বিবর্তনে তা নির্বাচিত নাও হতে পারে। যে দর্শন বেশি সামরিক শক্তি, অধিক প্রজনন সক্ষমতা, বিবর্তনের নিয়ম অনুসারে জয়ী হয়। যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমুখী দর্শনের পেছনে জঙ্গিবাদ বা সামরিক শক্তি না থাকলে বিজ্ঞানমুখী সমাজ আসবে না। ইউরোপ বা আমেরিকায় বিজ্ঞানমুখী সমাজ গড়ে ওঠার প্রধান কারণ হল এই সমাজগুলো একসময় উপনিবেশ দখলের জন্য উন্নত সামরিক ও যন্ত্র শিল্পের উপর নির্ভর করত। তাই আজকে যে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা তৈরি হয়েছে তাদের মারধর না করা পর্যন্ত থামানো যাবে না। যুক্তি, লেখালেখি, ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে কিছু হবে না।