ইসলামিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ, যেখানে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাটা দুর্বিষহ। আর এই দেশের সমকামী মেয়েরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার কারণে এবং একজন এলজিবিটি অধিকার কর্মী হিসেবে দেশের অনেক সংগঠনের সদস্যদের সাথে আমার কথা হয়। দেশের বাইরে থাকার কারণে এই সকল কাজ আমি স্বাভাবিক ভাবে করতে পারলেও যারা দেশে থাকেন তাদের পরিস্থিতি ভিন্ন। তাদের এই নির্মম কষ্টের অবসান কবে হবে আমার জানা নেই। তবে তাদের জীবন থেকে নেয়া কথা গুলো আমাকে প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা দেয়।
সমাজে মেয়েদের সমস্যা এমনিতেই বেশি, লেসবিয়ান হলে আরো বেশি ভুগতে হয়৷ তাঁদের কর্মশালায় যোগ দেয়া এক নারী সমকামীর তিন সন্তান রয়েছে৷ তিনি এখনও স্বপ্ন দেখেন সংসার ত্যাগ করে কোনো নারীর হাত ধরে চলে যাবেন৷ ‘‘অনেক লেসবিয়ান নারীকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছে৷ তারা প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে,” অর্থাৎ ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর পূর্বক প্রতিনিয়ত যৌন মিলনে আবদ্ধ হতে হচ্ছে।
আমার সাথে একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন নারী সমকামীর সাথে কথা হয়৷ তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন মেনকানামে৷ শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি যখন বুঝতে শুরু করেছি, তখন কাঁদতাম আর ভাবতাম, আমি এমন কেন, আমার মেয়েদের কেন ভালো লাগে? বড় হওয়ার পর, গুগল করার পর বুঝলাম যে, শুধু আমি না, আমার মতো আরো অনেক জনই আছে বিশ্বে৷”
সমকামী হওয়ার কারণে কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়– এমন প্রশ্নের জবাবে মেনকা জানান, নিজেকে মানিয়ে নেয়াটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা৷ ‘‘আমার আশেপাশের মানুষগুলোকে আমি বোঝাতে পারি না যে, আমি আর আট-দশটা মানুষের মতো না৷ আমি মেয়ে হলেও নিজেকে ছেলে ভাবি৷ প্রথমে আমার সমস্যা হয়েছে পোশাক নিয়ে৷ যেহেতু আমি মেয়ে, বাসা থেকে সব সময় থ্রিপিস পরতে বলে৷ কিন্তু আমি সেখানে শার্ট-প্যান্ট পরতে ভালোবাসি৷ আমাকে সবাই জিজ্ঞাসা করে, ‘এমন কেন তুমি?’ আমার কাছে তার কোনো উত্তর নেই৷”
এক আত্মীয়ের সাথে মেনকার সাত বছরের ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে৷ তাঁরা বন্ধু পরিচয়ে একসাথেই থাকেন৷ এখন তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন৷ ‘‘এটা কেউ স্বাভাবিকভাবে নেয় না৷ বাবা-মা জানলে বিয়ে দিয়ে দেবে৷ আমি যেহেতু সমকামী, আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলে কী অবস্থা হবে সেটা বোঝেন৷ আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না৷” এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে একটি পথই খোলা দেখছেন মেনকা৷ সমকামী হিসেবে জীবন যাপন করতে বাধা থাকবে না, এমন কোনো পাড়ি জমানো৷
২০১৫ সালের দিকে বাংলাদেশের সমকামীরা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে৷ কিন্তু জুলহাজ-তনয় হত্যাকান্ডের পর জীবনের নিরাপত্তাই এখন তাদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে। সমকামী কমিউনিটির প্রত্যেকেই এখন লুকায়িত অবস্থায় বা হাইডিং এ আছে৷ যারাই এক্সপোজ হচ্ছে তাদের উপরই থ্রেটটা চলে আসছে প্রবল আকারে৷ কাজেই আগে যে অবস্থা ছিল তার চেয়েও এখন খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে৷”
আগে জঙ্গি হামলার হুমকি ছিল, এর সঙ্গে এখন রাষ্ট্রীয় চাপও যুক্ত হয়েছে৷ ‘‘আমরা যারা লেখালেখি করেছিলাম, তাদের কণ্ঠটা রোধ করে দেয়া হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে৷” সমকামীদের নিরাপত্তা দেয়ার ন্যূনতম মানসিকতাও সরকারের নেই৷ উল্টো নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তাঁরা নিগ্রহের শিকার হন৷
২০১৭ সালের মে মাসে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে ২৭ জন সমকামীকে আটক করে র্যাব৷ তাঁদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা দিয়ে থানায় হস্তান্তর করা হয়৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা তো দূরে থাক, উল্টো গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় থাকে৷ তাঁরা শুধু হোমোসেক্সচুয়ালের মামলা দেয় না, মাদকসহ অন্য মামলাও দিয়ে দিচ্ছে৷
যেখানে সাধারণ জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখি আমরা সেখানে আইন দিয়ে, মিথ্যা মামলা দিয়ে, ধর্ম অবমাননার মামলা দিয়ে আমাদেরকে মুক বন্ধ করে রাখতে ছায় দেশের সরকার। আমাদের মতো এরকম হাজারো মানুষ আছেন যারা ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন। আমরা যারা দেশের বাইরে আছি আমরা কনভহাবে বেঁচে গেলেও যারা দেশে আছেন তারা সবচেয়ে বিপদ্গ্রস্থ জীবন যাপন করছেন। আমি ইউকে থাকার কারণে বেঁচে গেছি। দেশের আমার মতো অগণিত মানুষের কণ্ঠ হয়েছি আমি। তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা লিখছি। কই ইউকেতে তো আমাকে এরকম মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে না। আমি ভালো থাকলেও আমার বন্ধুরা তো ভালো নেই।