আজকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কিত একটি সংবাদ দেখলাম দৈনিক যুগান্তর মারফত। সংবাদে রয়েছের যে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী ইসলামী ব্যাংকের চেক তুলে দিচ্ছেন বিডিয়ার হত্যাকান্ডের ক্ষতি গ্রস্থ পরিবারকে। ব্যাপারটা আমার জন্য শুরুতে খানিকটা বিষ্ময়ের ছিলো, বেশ আশ্চর্যের ছিলো কিন্তু একবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমি বাংলাদেশের লৌহ মানবী বলেছি, সুতরাং এই ঘটনাতেও এত দ্রুত আমি আমার সে অবস্থান পাল্টাইনি। তবে কিছু অনুধাবন হোলো আজকে। ইনফ্যাক্ট বন্ধু কাওসার ভাইয়ের সাথেও কালকে এই রকম কয়েকটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় আড্ডা দিয়েছি।
আসলে অনলাইন যায়গাটাই মূলতঃ ভয়াবহ। আর আমরা বাংলাদেশীরা ফেসবুক যায়গাটাকে আসলেই কলুষিত করে ফেলেছি। এই দায়ের অংশ আমার নিজেরও। আমরা অনলাইনে খুব সহজেই একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলে দেশপ্রেমের দোকান খুলে বসতে পারি। ইসলামী ব্যাংক ছাগু, অমুক প্রতিষ্ঠান ছাগু, অমুক কোচিং সেন্টার ছাগু, অমুক বাস কোম্পানী ছাগু, অমুক প্রতিষ্ঠান ছাগু। আর কত মানুষকে যে আমরা প্রতিদিন ছাগু বলেছি তার ইয়ত্তা নেই। ব্যাপারটা অনেকটা হয়ে গেছে নকশাল আন্দোলনের শ্রেণী শত্রু খতমের লাইনের মত। বুর্জোয়া, শ্রেণী শত্রু খতমের লাইনে আমরা নিজের ব্যাক্তি শত্রুকে এই অনলাইন দেশপ্রেমের জোয়ারে মেরে রেখে দেই।
প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে সংবাদ আজকে আমাকে নতুন ডাইমেনশনে ভাবিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে যদি আমি ভাবি তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের যম তবে আজকের সংবাদ সেটির সাথে দ্বন্দ করে, সংঘর্ষ করে। আমার নিজের পূর্বের বক্তব্যকে এখন দ্বিতীয়বার ভাবায়। যে ইসলামী ব্যাংককে আমরা জামাতের প্রধান অর্থের সংস্থান বলে বলে মনে করি সেই ব্যাংক যখন নিহত আর্মি অফিসারদের পরিবারকে টাকা দেয় এবং সেই টাকা দেবার চেক যখন শেখ হাসিনা নিজেই তুলে দেন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই আমি একটু হোঁচট খাই। এই ইসলামী ব্যাংকের অনুষ্ঠানে যাওয়া নিয়ে আমরা তুষার ভাইয়ের মত এমন স্বাধীনতার পক্ষের মানুষকে নিয়ে অনলাইনে ট্রলিং করেছি, গাল দিয়েছি, কত ঘটনা ঘটিয়েছি। অথচ দেখা গেলো অর্থমন্ত্রী মাল সাহেব বলছেন ইসলামী ব্যাংক মানেই সন্ত্রাসী সংগঠন নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মইনুদ্দিন খান আলমগীর বলেছেন ইসলামী ব্যাংক জনতার ব্যাংক। আবার এইদিকে আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা ও যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক হানিফ জামাতী নেতাদের আওয়ামীলীগে আনছেন, শিবিরকে আহবান করছেন ইত্যাদি।
একটা সময় এগুলো নিয়ে অনেক লেখা লিখলেও আজ খুব হোঁচট খেয়েছি। আসলে অনলাইন আর বাস্তব হিসেব ভিন্ন। অনলাইনে এক জাতীয় মানসিক বিকারগ্রস্থ, হতাশ শিশু, কিশোর নানা ধরনের গ্যাং খুলে স্কুল সাজিয়েছে। এরা ভার্চুয়াল আওয়ামীলীগ। বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙ্গিয়ে এরা সবাইকে জামাতি মনে করে শুধু নিজেদের গুন্ডা-পান্ডাদের ছাড়া। শ খানেক কিশোর-কিশোরী এক একজন দুটো করে নতুন নিক খুলে জামাতী ছাগু তাড়াবে এই বলে এরা একটা দলও খুলে ফেলেছে। পুরো ব্যাপারটাই শিশুতোষ। অনেকটা “নেই কাজ, তো খই ভাজ” কিংবা বলা যায় এরা এসব করে দেশের প্রতি তাদের প্রবল ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ থেকে। আমি এদের ছোট করব না। কিন্তু এদের কর্মকান্ড আর বাস্তবে তাদের নেতা-নেত্রীদের কর্মকান্ড দুইটাই যোজন যোজন দূরের ব্যাপার।
এইসব কিশোর-কিশোরীরা আসলে এই নেতা-নেত্রীদের কখনো কাছে যেয়ে দেখতে পারেনি। এরা অনেকটা ঘোরের মধ্যে আক্রান্ত। অনলাইনে এরা পন করেই নেমেছে পুরো দেশকে দেশপ্রেমিক বানিয়ে ছাড়বে, কেউ দেশ প্রেমিক বা হতে চাইলে, আওয়ামীলীগ সমর্থন না করলে তাকে ঠেঙ্গিয়ে দেশ ছাড়া করবে। একটা সময় এরা ফটোশপ করে বিভিন্ন ব্যাক্তির মা, বাবা, চাচাকে তুলে গাল দেয়, এরা নানাবিধ গোয়েন্দা এডভেঞ্চার করে বের করে আবুলের মামাত ভাইয়ের চাচার শালার শশুর জামাতী সমর্থক। মার শালারে!!! পিডা শালারে!!! ব্যাস তার পরদিন থেকে আবুল হয়ে গেছে জামাতী? কেন জামাতী? কারন আবুলের মামাত ভাইয়ের চাচার শালার শশুর জামাত।
আমার মনে আছে একটা সময় অনলাইনের কিছু লোক সারাদিন মালালাকে গাল দিত। আসিফ মহিউদ্দিন নামে এক ব্লগার মালালার ছবি ফেসবুকে লাগানোতে সেই দুষ্টু কিশোর-কিশোরীরা সারাদিন গাল দিত আসিফকে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, শেখ হাসিনা খোদ জাতি সংঘে গিয়ে মালালাকে চুমু দিয়ে এসেছিলো। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি বুদ্ধিমতী। তিনি বোঝেন ভালো-মন্দ। কোথায় কাকে কি বলতে হবে, কোথায় কি করতে হবে তিনি-ই বোঝেন। কিন্তু দুঃখ লাগে ওইসব দেশপ্রেমিক বানাবার আস্ত মেশিন গেং-ফেং দের কর্মকান্ডে। এই ঘটনার পর তাদের শিবিরে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিলো।
অনলাইন যায়গাটা আসলেই খুব ইন্টারেস্টিং। এখানে মানুষ আসে সারাদিনের কাজ শেষে একটু আড্ডা দিতে, কেউবা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে, কেউ প্রেম করতে, কেউ ব্যাবসা করতে, কেউবা রাজনৈতিক প্রচারণায়, কেউবা নিজেকে সবচাইতে বড় দেশ প্রেমিক প্রমাণ করতে। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় আমরা বাঙালী জাতি এখনো টিভির রিমোট কন্ট্রোল ব্যাবহার করাই শিখিনি কিংবা ঠিকমত রেডিও ব্যাবহার করতে পারিনা, সেই আমাদের হাতে এসে গেছে ইন্টারনেট, ফেসবুক। ফেসবুকে যেহেতু আপনার ওয়ালের আপনিই মালিক, সুতরাং আপনার যা ইচ্ছে হয় বলেন, দেশপ্রেম দেখান, গাল দেন। কেউ কিছু বলার নেই। দল বানান, গেং বানান। আপনার ইচ্ছা। যার যেভাবে ভালো লাগে। জীবনের নানা নৈরাশ্য, হতাশা, না পাওয়া, না বলা, ক্ষোভ, ইচ্ছে, এসব আপনি অবশ্যই জানাবেন। আপনার জানানো উচিতও হয়ত…
অনলাইনে আমি নিজেও রাজনৈতিক প্রচার করেছি আওয়ামীলীগের পক্ষে, আমি নিজেও ট্রাইবুনাল নিয়ে অনেক লেখা, পোস্ট করেছি। আজকে সব অর্থহীন লাগে। মনে হয় খামাখাই টাইম নষ্ট। দয়ত… দিনের শেষে সেই জামাত পায় ১৩ টা আসন, ২৩ টা ভাইস চেয়ারম্যানের আসন, প্রধানমন্ত্রী দেয় ইসলামী ব্যাংকের চেক, মাল সাহেব ইসলামী ব্যাংকে সার্টিফিকেট দেয়, মইনুদ্দিন খান আলমগীরও দেয়।
আসলে পুরো ব্যাপারটা হয়ে গেছে একটা কুয়োর ব্যাঙ্গের গল্পের মত। আমরা আসলে যারা অনলাইন নিয়ে বেশী সিরিয়াস তারা অনেকটা কুয়োর ব্যাঙ্গের মত। আমাদের ধারনা আমরা একটা কথা লিখলে এটা বাংলাদেশের সবাই জানতে পারে, পড়তে পারে। আমরা মনে করি আমরা আজকে জামাতকে ধমক দিলাম, জামাত কালকেই উরি বাবা…উরি বাবা বলে পালিয়ে গেলো। আমরা ভাবি আজকে একটা দুষ্টু কিশোর কিশোরীদের নিয়ে ছাগু মারার গেং বানালাম ব্যাস সব ছাগু ভেগে গেলো রুদ্ধশ্বাসে, আমরা আসলে এসব ভেবে নিজের ভেতর এক ধরনের আনন্দ পাই। প্রবল উল্লাসে মাতি। কিন্তু আদতে ব্যাপারটা এমন না। কুয়োর ব্যাঙ্গের কাছে তার ওই কুয়োটাই পৃথিবী। তার ধারনা কুয়োতে বসে একটা ধমক দিলেই সারা পৃথিবী প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে। এটা আসলে আমাদের এক ধরনের কল্পনা, এটা এক ধরনের কাল্পনিক জগতের ভাবনা।
বাস্তব হচ্ছে দেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ। ইন্টারনেট ব্যাবহার করে বেশী হলে ১০-২০ লাখ। এর বেশী ব্যাবহার করলেও মানুষ এগুলো নিয়ে পাত্তা দেয়না। বাংলাদেশের কোটি কোটি ভোটার আছেন যারা অনলাইনে জীবনেও আসেন নি, নামই শুনেন নি। ফেসবুক দূরের কথা। আমরা অনলাইনে বসে প্রতিটি অক্ষর ধরে ধরে সমালোচনা করি। বাস্তব জীবনে কেউ হোয়ত এভাবে ভাবেই না। একবার আপনার ল্যাপ্টপ টা বন্ধ করে একটু বাইরে মানুষের ভীড়ে আসলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। ল্যাপ্টপ কিংবা পিসি বন্ধ করে দিলেই ভার্চুয়াল জগৎ মৃত। কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না।
সে কারনে প্রধানমন্ত্রীর এই চেক প্রদানের ঘটনা দেখে অনলাইনে খাবি খেলেও, চোখ বন্ধ করে যদি ভাবি। যদি বাস্তব জীবনে ঢুকি তাহলে আসলে এর কোনো মূল্যই নেই। নেতা-নেত্রীরা শেষ পর্যন্ত নিজেদের ভালো নিজেরাই বুঝে নিবেন, কোথায় কোথায় ভোট আসবে সেটা নির্ধারিত হবে মাঠে, ময়দানের রিয়েল রাজনীতিতে। আমরা যতই অনলাইনে বসে হাউ, কাউ করে দেশ প্রেমের বের্যপাত দিয়ে ভ’রে ফেলি, কোনো লাভ নেই।
অনলাইন আসলে একটা ভ্রান্ত ধারনা…খামাখাই সব কিছু…