বাংলাদেশে সকল মানুষের মানবিক মর্যাদা

টর্চার, গুম অপহরণের ভিকটিমরা কী ঘটনার শিকার হওনের পরেও, আমাদের মতই আবার স্বাভাবিক মানুষ থাকতে পারেন? বাইরে থেকে দেখলে কোন পার্থক্য বুঝা যায় না। তাঁদের দেখতে স্বাভাবিক মানুষের মত লাগতে পারে… কিন্তু আসলে তো তারা তা থাকেন না। আবার, ধরেন ভিকটিমের নিকট আত্মীয় স্বজনকে, যখন আমরা (বিশেষত মিডিয়া) যে ধরণের স্বাভাবিক পরিস্থিতি জ্ঞান কইরা প্রশ্ন করি– য্যান সব কিছু সুষ্ঠ ভাবে সরল ভাবে চলতেছে… এই সব প্রশ্নে আমরা কি উত্তর আশা করি…? আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়া ভিকটিমের নিকট আত্মীয় যে পরের দিন গায়েব হয়া যাইতে পারেন–সেইটার সম্ভাবনা কী আমরা মাথায় রাখি? বা মাথায় রাইখা প্রশ্নগুলা করি? আসলে আমি ভাবতেছিলাম– আমরা যদি যথেষ্ট দায়ীত্বশীল না হই, তাইলে হয়তো অজান্তে আমরা, দেশে গুম অপহরণের সংখ্যা আরও একটা বাড়ায়া ফেলতে পারি।

ইতোমধ্যে টর্চার ভিকটিমদের কিভাবে ইন্টারভিউ করতে হইবো, সেই বিষয় নিয়া কানাডার শরনার্থী বিষয়ক স্বাধীন প্রশাসনিক ট্রাইবুনাল, IRB (Immigration and Refugee Board of Canada) তার নিজেগো কর্মীদের ট্রেনিং দিতে, যে ট্রেনিং ম্যনুয়েল বানাইছে – সেইটার পাতা উল্টাইতেছিলাম।IRB সারা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের উপদ্রুত এলাকা থিকা আসা শরনার্থীদের নিয়া ডিল করে। কানাডার মাটিতে আশ্রয় প্রার্থী এই সব শরনার্থীদের অনেককেই, তাগোর প্রতিপক্ষের হাতে, অথবা নিজ নিজ রাষ্ট্রের বিভিন্ন এজেন্সির হাতে ভিন্ন মতের কারনে নির্যাতিত হওনের অভিজ্ঞতা নিয়া দেশ ছাড়তে হয়।

এই সব সন্ত্রস্ত আর বিপর্যস্ত মানুষগুলি– নানান দেশ ঘুইরা কখনো কখনও সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়া যখন কানাডার মাটিতে আইসা পৌছান, তখনও তাঁদের অনেকেই থাকেন ট্রমাটিক, মানসিক ভাবে বিস্রস্ত, আর মানুষ হিসাবে বিধ্বস্ত । কানাডায় নিরাপদ আশ্রয় পাইতে তাঁদের দাবীর যৌক্তিকতা নিয়া– এই Immigration and Refugee Board কে কখনও কখনও আশ্রয় প্রার্থীদের কেসের মেরিট যাচাই করতে হয়…। আশ্রয় প্রার্থীদের তথ্য যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে, তাঁদের অনেককেই ইন্টারভিউ করতে হয়। নির্যাতনের শিকার এই সব মানুষদের ইন্টারভিউ নেওনের টাইমে IRB কর্মীদের কি ভাবে নিজদের প্রস্তুত করা উচিত, কি কি বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত– সেই সকল বিষয়ে প্রশিক্ষনের জন্যই মুলতঃ এই ম্যনুয়েল।

মজার জিনিষ খেয়াল করেন– IRB কর্মীরা যাদের নিয়া ডিল করেন– তাঁরা কেউ কানাডিয়ান সিটিজেন নন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা তৃতীয় বিশ্বের দুঃস্থ নাগরিক। অথচ যে কোন মানুষের মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা, নির্যাতিতের প্রতি সহানুভুতিশীল আচরন বজায় রাখাকে তাঁরা তাঁদের কাজের প্রয়োজনীয় অঙ্গ হিসাবেই দ্যাখেন। লক্ষ্য করেন, একজন আশ্রয় প্রার্থী দুঃস্থ মানুষের সাথেও যথাযথ মানবিক আচরন করা, তার ট্রমাটিক সিচ্যুয়েশন নিয়া Immigration and Refugee Board কি পরিমান সতর্ক আর যত্নবান।

সাম্প্রতিক সময়ে অপহৃত ফরহাদ মজহার যখন উদ্ধার হন–সেই সময়ের একটা ভিডিও দেখতেছিলাম। অনেকেই এই ভিডিও দেইখা থাকবেন হয়তো। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একটা দলের হাতে ফরহাদ মজহার। চারদিকে ক্যমেরার চড়া আলো, চোখের সমস্যায় ভুগতে থাকা ফরহাদ এই তীব্র উজ্জ্বল আলো থিকা চোখ বাঁচাইতে অসহায়ের মতো তার পরনের কাপড় দিয়া চোখ ঢাকতে চাইতেছেন। বুকে ক্রশ বেল্ট ধারী কৌতুকপ্রবন এক অফিসার কিছুতেই উনাকে চোখ ঢাকতে দিচ্ছিলেন না। এই রকম জান্তব উল্লাসের সুযোগ, যখন তখন খুব বেশি মানুষের ভাগ্যে জুটে না… রঙ্গপ্রিয় অফিসার নিশ্চিত জানতেন।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই অনন্ত যুদ্ধের কালপর্বে– আমরা অনেকেই এই সংবাদ পায়া গর্ব অনুভব করি– সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারি সংস্থার সদস্যবৃন্দও নাকি উন্নত বিশ্বের সংস্থাগুলার মতোন, একই মাত্রার ট্রেনিং এর সুযোগ পায়া থাকেন। বাংলাদেশী অফিসারদের ট্রেনিঙ প্রাপ্তি ঘটে– যুক্তরাজ্যের এম আই ফাইভ এর থেমস হাউস, কিংবা ল্যঙলির সিআইএ’র হেডকোয়ার্টারে…। একই মাত্রার ট্রেনিং প্রসিডিউর — ক্যান আমাদের লাইগা পৃথক ফল বইয়া নিয়া আসে… এইটার কোন উত্তর আমাদের জানা নাই।

বন্দীদশা থিকা উদ্ধারের কয়েক ঘণ্টার মাঝে, পুলিশি হেফাজতে থাকাকালিন সময়ে এবং আদালতে দেওয়া জবানবন্দী হিসাবে ফরহাদ মজহার যা যা স্টেটমেন্ট দিছেন– সেইটাকে ভিত্তি হিসাবে ধইরা পুলিশ বাহিনী আর তার শাগরেদ মিডিয়া পুরা ঘটনার ব্যাখ্যা দেওন শুরু করছিলেন। সেই সব ব্যাখ্যা বিবৃতির উপর দাড়ায়া আজ অবধি আমরা সবাই ঘটনার বয়ান নিয়া কুস্তাকুস্তি কইরা যাইতেছি…

এইদিকে আই আর বি’র ট্রেনিং ম্যনুয়েল Difficulties Testifying নামক সাব হেডিং এ আমাদের জানাইতেছে– In addition to disincentives to testifying, it is quite common for victims of torture to have difficulty in relating their story, due to problems with memory, concentration and/or stress and anxiety. During their testimony, they may falter, appear confused, be unresponsive, retreat into prolonged silence, or provide explanations that lack coherence and seem contradictory….

মহান মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের The Proclamation of Independence… আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমরা এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করছিলাম– যেইখানে সকল নাগরিকের জন্য সমতা (Equality), মানবিক মর্যাদা (Human dignity) এবং সামাজিক সুবিচার (Social justice) নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ছিল।

আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে সকল মানুষের মানবিক মর্যাদা– আমরা কবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবো…??

#টর্চার #গুমঅপহরন #ফরহাদমজহার