‘বাল্য বিবাহ’ বলতে কি বুঝানো হয় জানি না। কনের বয়স ১০ আর বরের বয়স ১২, এরকম বিয়েকে অবশ্যই বাল্য বিবাহ বলা হবে, কিন্তু এর সঙ্গে ৪০ বছরের বর আর ১৩ বছরের কনের বিয়েকে কি এক করে দেখার সুযোগ আছে? অল্প বয়েসী বর-কনের বিয়ে তাদের যৌন জীবন ও সামাজিক জীবনকে ধ্বং করে ফেলে। এটি প্রতিরোধ করা আমাদের সামাজিক কর্তব্য। অন্যদিকে বয়স্ক বর আর নাবালিকা কনের বিয়ে একটি ক্রাইম। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই ভয়াবহ অপরাধ, শিশু নিপীড়নকে আমাদের প্রধান ধর্মগুলো শুধু সমর্থন নয়, ধর্মীয় মহাপুরুষরা নিজেরা সেই কাজটি করে অনুসারীদের জন্য নজির রেখে গেছেন!
আমাদের দেশে ‘বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন’ ঠিক কোন ধরণের বিয়েকে প্রতিরোধ করতে করা হয়েছে আমার জানা নেই। তবে এই আইনের বিরুদ্ধে হুজুরদের লম্ফঝম্ফ দেখে অনুমান করি বুড়া বয়েসে শিশু বিয়ে করার সুযোগ হাতছাড়া হবার ভয়েই তারা আন্দোলনের ডাক দেন। আওয়ামী লীগের মৌলবাদী অঙ্গ সংগঠন ওলামা লীগ শিশু বিয়ের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বাল্য বিয়ে করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল। বিষয়টা ঠিকই আছে তবে বঙ্গবন্ধু যখন বিয়ে করেন তার নিজেরই বয়স ছিল অল্প। আমাদের দাদা-নানারাও সে যুগের নিয়ম মেনে ১৮-২০ বছরে আমাদের দাদীদের বিয়ে করে ঘরে এনেছিলেন যখন তাদের বয়স ছিল ১৩-১৪। শীর্ষেন্দুর দূরবীন উপন্যাসে আমরা দেখি ৩৫ বছর বয়েসে ছেলের ঘরের নাতি মুখ দেখছে একজন ‘যুবক’! কিন্তু ৫০ বছর বয়েসে ১৩ বছরের মেয়েকে বিয়ে করার অশোভনটা সে কালেও ছিল। নবী মুহাম্মদ যখন সেই হাজার বছর আগে মাত্র ৫ বছরের আয়েশাকে বিয়ে করতে মনস্থির করেছিলেন তখন সে যুগেও বিরূপ সমালোচনা শুরু কয়েছিল। আয়েশা তখন পুতুল খেলে। আবু বকর বন্ধু মোহাম্মদ যে তার শিশু কন্যাকে বিয়ে করতে চান সেটা ঘূণাক্ষরেও অনুমান করতে পারেননি। লোক মুখে যখন নবী প্রস্তাব পাঠান আবু বকর সেটা বিশ্বাসই করেননি। আবু বকর মন্তব্য করেছিল, সে তো অনেক ছোট…। এসব কারণেই কি বাল্য বিবাহ বিরোধী আইন করলে হুজুররা ক্ষেপে উঠেন? তারা একে নবীকে খাটো করা হচ্ছে বলে মনে করেন? নইলে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ নির্ধারণ করলে ধর্মানুভূতিতে আঘাত তো লাগার কথা না।
হিন্দু ধর্মে ‘গৌরীদান’ বলে বাল্য বিবাহকে উৎসাহিত করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ দূর্গা নাবালিকা বয়েসে বয়স্ক শিবের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। এই করে একশত বছর আগেও বাঙালী হিন্দু ঘরের মেয়েদের বয়স ১২ হয়ে পড়লেই আইবুড়ি বলে ডাকা হতো! প্রায় ১০-১১ বছর বয়েসে মেয়েদের মা হতে হতো। হাজার হাজার নারী সন্তান হতে গিয়ে মারা যেতো। মেয়েদের শৈশব বলতে কিছু ছিল না। একই চিত্র ছিল মুসলমানদের। আজো বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ১৫! সম্প্রতি বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন-২০১৬ মন্ত্রী সভায় চূড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু যা দেখা যাচ্ছে এই আইনটি আসলে বাল্য বিবাহকে সুরক্ষা দিতেই করা হচ্ছে। মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বেধে দিয়ে ‘বিশেষ কারণ’ দেখিয়ে শিশু বিয়েকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। যুক্তি দেখানো হয়েছে অপ্রাপ্ত বয়সে ছেলেমেয়েরা পালিয়ে বিয়ে করে গর্ভবতী হয়ে পড়ে, সেই বাস্তবতাকে মাথায় রেখে ‘বিশেষ অবস্থা’ আইনে রাখা হয়েছে! বাংলাদেশে কত সংখ্যক অল্প বয়েসী ছেলেমেয়েরা পালিয়ে বিয়ে করে আর কত সংখ্যক নাবালিকা মেয়ে ৩০ উর্ধ পুরুষের সঙ্গে বিয়ে করে সংসার করতে যায় তা পরিসংখ্যান ছাড়াই বুঝতে সক্ষম হবার কথা যদি না আপনি মঙ্গল গ্রহের অধিবাসী হয়ে থাকেন। এই আইনটি যখন মন্ত্রীসভা অনুমোদন পেয়েছে তখন একটা খবর দেখলাম রাজশাহীর তাহেরপুরে এক স্কুল ছাত্রীকে যুবলীগ নেতা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। যুবলীগ নেতার বয়স কত জানা যায়নি। তবে এইসমস্ত বিয়েকে ‘বৈধ্যতা’ দিতেই মনে হয় আইনি এখন খুব কাজে আসবে। কিছুদিন আগে তুরষ্ক সরকার ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে রাজি হলে ধর্ষককে রেহাই দেয়া হবে এরকম আইন পাস করতে চেয়েছিল। আমার কাছে বর্তমান আইনটিকে তরুষ্কের প্রস্তাবিত আইনটির ছদ্ম রূপ বলেই মনে হয়েছে। কারণ আইন প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “অবিবাহিত মাতা, কিন্তু তার বাচ্চা আছে- এ রকম কেইস যদি হয়, এসব ক্ষেত্রে তাকে প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য এই বিধান করা হয়েছে।… কত ধরনের সমস্য দেখা দেয়.. এজন্য বিয়েগুলো হয়ে যায়। ওটাকে লিগালাইজ করার জন্য এই প্রক্রিয়া”। ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে- আইনে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটের’ কোন সংজ্ঞা রাখা হয়নি! তারমানে শিশু ধর্ষককারীরাও বিয়ের নামে খুব সহজেই এই আইনের মারপ্যাচে বেরিয়ে আসবে…।