আওয়ামীলীগের ধর্মীয় অপরাজনীতি

জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সব মানুষের দেহেরই রক্তের রং লাল। এর মধ্যে কারো বাহ্যিক বর্ণ কালো কারো বা সাদা আর কারো বা বাদামী। তবে সবকিছুর উপরে এটাই সত্য পৃথিবীতে যে যেখানেই বাস করুক না কেন, সবারই একটি পরিচয়- মানুষ। এছাড়া সব মানুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণা, শীত-গরমের অনুভূতি এক।
চন্দ্র-সূর্য সবাইকে সমান আলো ও তাপ দেয়। আর জাতি বা বর্ণপ্রথা মানুষের সৃষ্টি। ব্যক্তি-পরিবার, গোত্র-সমাজ ও জাতি থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি। সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভিন্ন গোত্রের মানুষের বসবাস। এছাড়া সমাজে বসবাসকারী মানুষ বিভিন্ন মতাদর্শের হলেও, রাষ্ট্রীয় শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে সবাইকে মিলেমিশে থাকতে হয়।
সমাজে সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে হলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তর ঢেলে সাজাতে হবে। দেশের প্রতিটি মানুষকেও যার যার অবস্থান থেকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের ভূমিকাও অপরিসীম। ধর্ম-বর্ণের কুৎসিত রাজনীতি রুখে না দিলে সেই সমাজ বসবাসের উপযোগীতা হারায়।
একটা কথা মনে রাখা জরুরী যে, কোন বিশেষ সম্প্রদায়ে জন্ম নিলেই কেউ সাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না। তবে একজন মানুষকে কোনো গোত্র বা বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত বলে বিবেচনা করা যেতেই পারে। এক্ষেত্রে কোনো মানুষ যখন অসৎ উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিভিন্ন গোত্র-সম্প্রদায়ের মধ্যে হানাহানি, হামলা, পাল্টা হামলা এবং লুণ্ঠনের মতো অপকর্ম করে বা সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত হয়- তখনই তা সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে পরিণত হতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যা ঘটেছে তাকে সাম্প্রদায়িক হামলা বলা ঠিক হবে না। এটাকে বলা চলে পূর্বপরিকল্পিত অত্যন্ত ঘৃণ্য একটি চক্রান্ত।
শারদীয় দুর্গাপূজার সময়কেই হামলার উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেয়ার উদ্দেশ্য হলো- ধর্মীয় ইস্যুটাকে উসকে দিয়ে জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করে বিশ্বের দরবারে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা। মানে এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মেরে ফেলার একটা প্রয়াস।
মানুষের জন্যই ধর্ম। তাই ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার দরকার নাই তবে বিদ্রোহ করতে হবে ধর্ম-ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। যুগে যুগে ধর্মকে শোষণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই ভণ্ড মোল্লা-মৌলভি আর পুরোহিত-পাদ্রির বিরুদ্ধে সংগ্রামে সোচ্চার হতে হবে।
সমস্যা হয় তখনই যখন বেশিরভাগ মানুষই নিজধর্মের মূল সারবস্তু না বুঝেই সংস্কারের কথা বলে কাদা ছোড়াছুড়ি করে, হিংসা-হানাহানি করে। এ অবস্থাকে এককভাবে কোনো গোত্রীয় বা সাম্প্রদায়িক সমস্যা বলা যাবে না। বিভিন্ন মহলের ইন্ধনে এই ধরনের  বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে। সাধারণ বিষয় থেকে শুরু করে অত্যন্ত নোংরা ও ন্যক্কারজনক ঘটনার সংঘটনে কারো কোনো দ্বিধা বা সংকোচ কাজ করছে না।
এসব অপকর্মকে আড়াল করার জন্য অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামাজিক প্রভাব, আর্থিক দাপটসহ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব পর্যন্ত কাজে লাগানো হয়। যদি দীর্ঘদিন ধরে এরকম অন্যায়-অবিচার চলতে থাকে তবে তা একসময় বিষাক্ত হতে হতে এক সময় বিস্ফোরিত হবেই। ক্রমশ সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে উঠতে থাকবে। শুরু হবে দেশ-বিদেশে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও তোলপাড়। বাড়তে থাকবে গণমামলা ও হয়রানি।
এ মহূর্তে দেশে সব ধর্মের মানুষের জন্য ভয় ও শঙ্কামুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও যার যার ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করা সরকার এবং রাষ্ট্রের একান্ত দায়িত্ব। বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র বানাতে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের আত্মত্যাগ রয়েছে। কিন্তু আফসোস যে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সেই কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র পাওয়া যায়নি। এখনও ‘সংখ্যালঘু’ পরিচয়ে কিছু মানুষকে বাঁচতে হয়। এর চেয়ে দুঃখের কিছু হতে পারে না।
প্রকৃতপক্ষে প্রচুর অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেয়ে মানবিক, পরমতসহিষ্ণু, স্বদেশ ও সংস্কৃতি চেতনায় উদ্ভাসিত মানুষ তৈরি করা বেশি জরুরি। এদেশে অতীতেও নানা সময় ধর্মীয় ইস্যুকে ঘোলা জলে মাছ শিকারের মতো রাজনীতি করার মোক্ষম হাতিয়ার করা হয়েছে। এটা ততদিন হতে থাকবে যতদিন পর্যন্ত না মানুষ শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি চিন্তা-চেতনায়ও যৌক্তিক আচরণ করার মতো শুভবুদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ হবে।
এই উপমহাদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও ফায়দা আদায় করা স্বার্থান্বেষী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের চর্চিত বিষয়। বর্তমান যুগেও এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আসলে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো মাথাচাড়া দেয়ার এত সাহস ও শক্তি পেত না যদি আগে সংঘটিত রামু, নাসিরনগর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর সুষ্ঠু বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে মূল হোতা ও সংশ্লিষ্টদের বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হতো। হয়নি বলেই এর পুনরাবৃত্তি ঘটে।
কিছু জঘন্য মানুষ বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে  রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি ও ধর্মীয় উগ্রবাদের নাম করে ‘সংখ্যালঘু’ মানুষের উপর শোষণ ও নির্যাতন চালায়। মৌলবাদী ও সুবিধাভোগী এ গোষ্ঠীর সঙ্গে কোনোক্রমেই আপস নয়। রাষ্ট্রীয় শান্তি-শৃঙ্খলা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার স্বার্থে সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল থাকা প্রয়োজন। এর ব্যত্যয় ঘটলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। এর সঙ্গে বিসর্জন হবে সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব ও জাতীয় সংহতির। ফলে জাতি হিসেবে আমাদের আত্মাহুতি ঘটবে। বাংলাদেশ পরিণত হবে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে।
সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতাদের সামাজিকভাবে বর্জন ও প্রতিহত করে বিচারিক আদালতে সোপর্দ করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করতে হবে। যা সমাজে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের বসবাসের জন্য অপরিহার্য।
মানুষে মানুষে বৈষম্য আর ভেদাভেদ সৃষ্টি করা নেহায়েত মানবতার অবমাননা করা। এমনকি এটি রাষ্ট্রীয় সংবিধান অমান্য করার শামিল। সাম্প্রদায়িক কোনো হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ধর্মীয় আচার-আচরণে নাশকতা ও অনুভূতিতে আঘাত করা অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। যা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে গণ্য।