আজিজুল হকের পুরো সাক্ষাৎকার

অনেকেই আজিজুল হকের পুরো সাক্ষাৎকার পড়তে চেয়েছেন। আমার সংগ্রহ থেকে পুরো সাক্ষাৎকারটা এখানে দিলাম।

 

৭১ এ আমগো অবস্থান ছিলো নিরপেক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে: শাইখুল হাদিস আজিজুল হক – [সাক্ষাৎকার: সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ২৬ বর্ষ ১৬ সংখ্যা ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭]।

 

শাইখুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হক, আমীর, খেলাফত মজলিস। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর যিনি বলেছিলেন, ইসলাম নামের বৃক্ষটির গোড়ায় পানি নয়, রক্ত ঢালতে হবে। তারপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরুর উপক্রম হয়েছিলো। ১৯৬৯ সালে তিনি চাঁদে যাবার ঘটনাকে মিথ্যা বলেছিলেন। দুই বিয়ে করে ১৩ সন্তানের বাবা। তার জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এসেছে বহুবার।

 

১৯৯৭ সালের সালের ৫ সেপ্টেম্বর বিচিত্রায় প্রকাশিত শাইখুল হাদিসের সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সাংবাদিক গোলাম মোর্তুজা।

 

বিচিত্রা: আপনার নামের আগে এই শাইখুল হাদীস বিষয়টি কী?

শাইখুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হক: হাদীস শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞকে শাইখুল হাদীস বলা হয়।

 

বিচিত্রা: এই উপাধী কারা দেয়?

আ.হ: এইডা কেউ কাউরে দেয় না। হেঃ হেঃ। এইডা এমনে এমনেই হইয়া যায়। তার স্টাডি, সুখ্যাতি আল্লাহর রহমতে আলেম ওলামাদের দোয়ায় জনগণের মধ্যে ছড়াইয়া পড়ে।

 

বিচিত্রা: তারপর কি নিজে নিজেই নামের আগে শায়খুল হাদীস টাইটেল লাগিয়ে নেয়া যায়?

আ.হ: হ্যাঁ, লাগায়া নেয়া যায়। না… মানে… আলেম… উলামাদের দোয়ায় এইডা এমনে এমনেই হইয়া যায়।

 

বিচিত্রা: আপনারা ইসলামী ঐক্যজোট গঠন করেছেন। আসলে আপনাদের উদ্দেশ্য কী?

আ.হ: আমরা বর্তমান সরকারের ইসলাম বিরোধী কাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি।

 

বিচিত্রা: মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের সম্মান জানানোর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘শিখা চিরন্তন’। আপনারা এর বিরোধিতা করছেন কেনো?

আ.হ: এইগুলা ফালতু কথা। ঐহানে আগুন-পূজা করতাছে। এইডা মহাপাপ শিরিকি। ক্ষমার যোগ্য না।

 

বিচিত্রা: ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে তো শিখা অনির্বাণ আছে। শিখা অনির্বাণ জ্বলছে অনেক আগে থেকে। এটার বিরুদ্ধে আপনারা কিছু বলছেন না কেনো?

আ.হ: ক্যান্টনমেন্টে তো অস্ত্র নিয়া মিলিটারি পাহারা দেয়। ঐখানে যাইতে হইলে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়া যাইতে হইবো। আমরা সেই প্রস্তুতি নিতাছি। এছাড়া এমনি এমনি গেলে কিছু করা যাবে না। যেমন রেলগাড়ি দেইখ্যা সামনে লাফ দিয়া পড়লে থামবো না। রেলগাড়ি থামাইতে হইলে সেইরকম একটা প্রস্তুতি নিয়া, দুচারটা হাতি নিয়া রেলের সামনে যাইতে হইবো। হাতির ওপর দিয়া তো আর গাড়ি যাইতে পারবো না। আমরা শক্তি সঞ্চয় করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতাছি।

 

বিচিত্রা: যুদ্ধের প্রস্তুতিটা কী?

আ.হ: সরকার যদি এই আগুন-পূজা বন্ধ না করে তাহলে দেশে গৃহযুদ্ধ বাইধা যাইবো। তখন আর কিছু করার থাকবে না। আমরা সেই প্রস্তুতি নিতাছি।

 

বিচিত্রা: আপনারা কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন?

আ.হ: আমরা ট্রেনিং নিতাছি।

 

বিচিত্রা: এবার আমরা একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। আপনি ৭১-এ কোথায় ছিলেন?

আ.হ: তেমন কিছু না। নিরপেক্ষ ছিলাম।

 

বিচিত্রা: কিছুই করতেন না?

আ.হ: না। ৭১ এ আমগো অবস্থান ছিলো নিরপেক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। আমরা কখনোই চাই নাই পাকিস্তান ভাইঙ্গা বাংলাদেশ স্বাধীন হোক।

 

বিচিত্রা: রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো না?

আ.হ: না না এইগুলা জামাতিগো কাম।

 

বিচিত্রা: বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। আবার এখন বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। আসলে আন্দোলনটা কাদের বিরুদ্ধে?

আ.হ: যখন যে দল মতায় থাকে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করি। তাই আগে বিএনপির বিরুদ্ধে করছি। এখন করতাছি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আমাদের আন্দোলন বিএনপি সাপোর্ট করতাছে।

 

বিচিত্রা: নারী নেতৃত্ব বিষয়ে আপনাদের মতামত কী?

আ.হ: আমাদের ‘মসলা’ নারী নেতৃত্বের পুরোপুরি বিপক্ষে। নারী নেতৃত্ব অবৈধ।

 

বিচিত্রা: বিএনপির নেতৃত্বে রয়েছেন খালেদা জিয়া। তিনি একজন মহিলা। তাহলে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করছেন কেন?

আ.হ: জি না। মানে বিএনপিরে সাথে নিয়া আন্দোলন করতাছি না তো। নারী নেতৃত্ব অবৈধ। বিএনপি আমাদের আন্দোলনে সাপোর্ট করছে।

 

বিচিত্রা: আপনি আগের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করছি।

আ.হ: এরকম কিছু বলি নাই। হেঃ হেঃ হেঃ। দেশে নারী নেতৃত্ব থাকলে দেশের উন্নতি অইব না। দেশ রসাতলে যাইবো। তাড়াতাড়ি নারী নেতৃত্ব সরান।

 

বিচিত্রা: কবে নাগাদা ক্ষমতা যাবার আশা করছেন?

আ.হ: এইডা কি বলা যায় নাকি? আল্লাহ যহন চাইবো। আল্লাহ চাইলে যাইতে পারি তাড়াতাড়ি।

 

বিচিত্রা: ক্ষমতায় যেতে হলে তো আন্তর্জাতিক লবি শক্তিশালী হতে হয়। বাইরের কোন দেশ আপনাদের পক্ষে আছে?

আ.হ: পাকিস্তান। আরব। আরবের মুসলিম দেশগুলো একটু দূরে এইডা একটা অসুবিধা।

 

বিচিত্রা: আফগান তালেবানদের সঙ্গে তো আপনাদের যোগাযোগ রয়েছে।

আ.হ: আফগান তালেবানদের সাপোর্ট করি। তারা ইসলামের জন্য যুদ্ধ করছে। আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি, তাদের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। পাকিস্তান আফগানদের স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরাও তাদের সবরকম সাহায্য সহযোগিতা দেয়ার জন্য প্রস্তুত আছি।

 

বিচিত্রা: শোনা যায়, তালেবানদের সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ থেকে আপনারা কিছু যোদ্ধা পাঠিয়েছেন।

আ.হ: না। পাঠাই নাই। তালেবানরা এখনো সেরকম সাহায্য চায় নাই। চাইলে তো দুই একজন না লাখ লাখ যোদ্ধা পাঠামু। যেমন বসনিয়ার মুসলমানরা যখন সাহায্য চাইছিলো তখন আমরা একলাখ মুজাহিদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছিলাম। পরে আর দরকার হয় নাই দেইখা পাঠাই নাই।

 

বিচিত্রা: আপনাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে কোথায়?

আ.হ: আছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

 

বিচিত্রা: ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যেও বিরোধ। জামাতের সঙ্গে আপনাদের এতো বিরোধ কেন?

আ.হ: না, জামাতিরা দাড়ি রাখে ছোট ছোট। হেঃ হেঃ হেঃ। ওরা মানুষের রগ কাইটা দেয়। তাগো রক্ত গরম। এইগুলা ইসলাম সাপোর্ট করে না।

 

বিচিত্রা: তাবলীগ জামাতিদের সঙ্গেও তো আপনাদের বিরোধ আছে?

আ.হ: তাবলীগ জামাতিরা হইলো এক্কেবারে নির্জীব। রক্ত ঠাণ্ডা। ইসলাম রার জন্য কিছু করে না। তাই আমরা পছন্দ করি না।

 

বিচিত্রা: আপনারা মানিক মিয়ার জনসভায় বলেছেন, ১৪ মাসে সরকার দেশের অর্ধেক ভারতের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। কীভাবে বিক্রি করলো, একটু বুঝিয়ে বলবেন?

আ.হ: বুঝেন না, লোক দেখানো পানিচুক্তি করছে। হেঃ হেঃ হেঃ। ভারতরে ট্রানজিট দিতে চায়। বিদ্যুৎ আমদানি করতে চায়। সরকার খালি ভারত ভারত করে। একটু দূরে হইলেও পাকিস্তান থেকেও তো বিদ্যুৎ আনা যায়।

 

বিচিত্রা: পাকিস্তান একটু বেশি দূরে হয়ে যায় না?

আ.হ: দূরে… হ্যাঁ তা একটু বেশি হয়। চেষ্টা করলে আনুন চায়।

 

বিচিত্রা: ইসলাম বিরোধীদের তালিকা তালিকা তৈরি করে কী করবেন?

আ.হ: রসুল (সাঃ)- এর বদনাম করছে আলী আজগর। এই রকম আরো যারা আছে ইসলাম বিরোধী, যেমন কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, শাহরিয়ার কবির এই গুলার বিচার কইরা শাস্তি দিতে হইবো।

 

বিচিত্রা: কী শাস্তি দেবেন?

আ.হ: বিচারে যে শাস্তি হয়। দেশের মানুষ বিচার করব।

 

বিচিত্রা: ড. আলী আজগর তো বলেছেন, তিনি রসুল (সাঃ) কে অপমান করে কোন কথা বলেননি।

আ.হ: সে এখন কইলেই তো আর হইলো না। সে কইছে। আমগো লোকজন শুনছে। এইডার কোনো মাপ নাই। তারে শাস্তি পাইতে অইবো।

 

বিচিত্রা: আপনি একবার বলেছিলেন, মানুষের চাঁদে যাওয়ার কথা মিথ্যা। অন্য কোনো দেশ থেকে ঘুরে এসে বলছে, চাঁদে গিয়েছিলাম। মানুষ যে চাঁদে গেছে এটা কি আপনার এখনো বিশ্বাস হয় না?

আ.হ: হ্যাঁ, চাঁদে মনে হয় যাওয়া যায়।

 

বিচিত্রা: এখন তো মানুষ মঙ্গল গ্রহেও যাওয়ার চিন্তা করছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

আ.হ: আরে চাঁদে যাওয়া, মঙ্গল গ্রহে যাওয়াএইগুলা বড় কোনো কাম হইলো নাকি? শুধু শুধু টাকা পয়সা নষ্ট। মঙ্গল গ্রহে, চাঁদে যে কেউই যাইতে পারে। ইচ্ছা করলে আমরাও যাইতে পারি। এইডা কোনো ব্যাপার না।

 

বিচিত্রা: পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে আপনার মতামত কী?

আ.হ: ইসলামে পরিবার পরিকল্পনা এক্কেবারে হারাম। নাজায়েজ। এই নাফরমানি প্রচারণা বন্ধ করতে হইবো।

 

বিচিত্রা: অপরিকল্পিতভাবে জনসংখ্যা বেড়ে গেলে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেবে না?

আ.হ: না। আহার আল্লাই যোগাইবো। আল্লাহর দয়ায় আগের চেয়ে এখন খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে। যত বেশি পোলাপান হোক না কেন এইডা খারাপ না। জন্মনিয়ন্ত্রণ মহাপাপ।

 

বিচিত্রা: বাংলাদেশ তো নেপালকে ট্রানজিট দিলো। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

 

আ.হ: নেপালকে ট্রানজিট পাকিস্তান আমলেই দেয়ার কথা ছিলো। পাকিস্তান দিতে চাইছিলো। তাই এইডাতে কোনো সমস্যা নাই। এখানে ভারতের কোনো মাতুব্বরি ছিলো না। কিন্তু এখন ভারত এইখানেও মাতুব্বরি করতাছে। তাই আমরা এইডারও বিরুদ্ধে। ভারতের মাতুব্বরি ছাড়া ভুটান, শ্রীলঙ্কা এইগুলারেও ট্রানজিট দেয়া যায়।

 

চিত্রা : শুধু ভারত ছাড়া…

আ.হ: অন্য দেশগুলোরে দিলে আমগো সার্বভৌমত্ব নষ্ট অইবো না। কিন্তু ভারতরে দিলে অইবো। ভারত আমগো বুকের ওপর দিয়া আসা যাওয়া করবো। এইডা আমরা মেনে নিতে পারি না।

 

[কার্টেসি: সেই রাজাকার এই রাজাকার]

কৃতজ্ঞতাঃ শওকত খান