‘অন্য পালা’ অদ্ভুত এক ভালোলাগা

বাংলাদেশে তো সমকামিতা নিয়ে চলচিত্র বানানোর কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবা যায় না। আর যদিওবা ভবিষ্যতে হয় তাহলে সে ছবির মুক্তি পাওয়া হবে না। সেন্সর বোর্ড থেকেই প্রথম ধাক্কায় বাতিলের খাতায় নাম উঠে যাবে। আমরা আসলে জাতগত ভাবে অনেকটাই দ্বিমুখী। ভাল কিছু হলে সেটার কঠোর সমালোচনা তো করবই এবং কেউ যেন ভাল করতে না পারে তাকে টেনে হিঁচড়ে নামানর চেষ্টা করবো। এটা আমাদের স্বভাবগত। আর কিছু পারি আর না পারি এই টেনে হিঁচড়ে নামানোর কাজটা আমরা অত্যন্ত ভালোভাবেই করতে শিখেছি। 

ভারতীয় উপমহাদেশ সহ মুসলিম রাষ্ট্র গুলোতে সমকামিতাকে খুব ভুল ভাবে ইন্টারপ্রেট করা হয়। বিষয়টা নিয়ে গবেষণা বা তলিয়ে দেখা থেকে এটাকে চেপে রাখার পক্ষেই অধিকাংশের রায়। খুব সকালে উঠে যখন অনলাইন পোর্টালে সংবাদ পেলাম “সৌদি আরবের আদালত সমকামী ঘোরাকে মৃত্যু দন্ড দিয়েছে”। তখন মানসিক ভাবে একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। মানুষের বর্বরতা শেষ অবধি মানুষের সমাজ ছাড়িয়ে পশুদের জগতেও ঢুঁকে গেল। মানুষ নিজের অজ্ঞতার দায় পশুর উপরে চাপিয়ে দিচ্ছে। কি অদ্ভুত আমাদের এই জগত!! 
নন্দন থিয়েটারে সিনেমা দেখি না বেশ কিছুদিন হল। পড়ন্ত বেলায় যখন বাড়ি ফিরব ঠিক সেই মুহূর্তেই কি মনে করে ঢুঁকে গেলাম থিয়েটারে। সিনেমার নাম ‘অন্য পালা’। পরিচালক শতরূপা শ্যান্নাল। সিনেমার পোস্টার বা নাম শুনে কোন মতেই বুঝতে পারিনি আসলে কি সিনেমা দেখতে যাচ্ছি। সিনেমার আসল খোলস খুলতে সময় লেগে গেল প্রায় এক তৃতীয়াংশ সময়। 
প্রয়াত কিংবদন্তী পরিচালক ঋতু পর্ণ ঘোষ সমকামিতা বা উভকামিতা নিয়ে সিনেমা করেছেন। কিন্তু আমার মতে বাংলা ভাষায় সমকামিতা নিয়ে সব থেকে সুন্দর ও পরিপাটি সিনেমাটি হল “অন্য পালা”। 

ঘটনা প্রবাহঃ জমিদার বাড়ির ছেলে জন্ম সূত্রে সমকামী। কিন্তু তার বাবা মা তা বুঝতে পারে না বা অনেকটা বুঝতে চায় না। ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ আনে। প্রথম বউ তার প্রাপ্য বুঝে না পেয়ে ছেলেকে ছেড়ে চলে যায়। বাবা মা ছেলেকে দ্বিতীয় বিয়ে দেয়। নব বধু গরীব ঘরের চার কন্যার ২য় কন্যা। লক্ষ্মী প্রতিমার মত চেহারা। বউয়ের কেন সন্তান হয় না এই নিয়ে শ্বশুর শাশুড়ির খোটা নাচ্রার অভাব নাই। কিন্তু তাদের সমকামী ছেলে তো কখনোই স্ত্রীর সাথে এক বিছানায় ঘুমায় না। এমন কি স্ত্রীকে তার প্রাপ্য মর্যাদাটুকুও দেয় না। ছেলে নিজেকে রাধা বলে ঠাওর করে। তার ধ্যান জ্ঞান সব কিছু কৃষ্ণর জন্য। সে কৃষ্ণকে পূজা করে। কৃষ্ণর জন্য মালা গাঁথে। রাধার মত তার চলন বলন হাভ ভাব। সে সব সময় স্ত্রীকে সখী বলে সম্বোধন করে। পুরুষ দেহে যে নারী হৃদয় বন্ধী সে কথাও সে তার স্ত্রীকে ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয়। 
এমন সময় জমিদারবাড়িতে এক সাধক আসে। বাড়ির সবাই সাধককে ভগবানের মত পূজা করে। সাধকের পুজায় জমিদার পুত্র মশগুল। এক রাতে জমিদার পুত্র বিবাহিত স্ত্রীকে ফেলে রেখে সাধকের ঘরে রাত্রি যাপন করতে যায়। স্ত্রী তাকে অনুসরণ করে সাধকের জানালার ফাঁকা দিয়ে দেখতে পায় তার অগ্নি সাক্ষী করে বিয়ে করা স্বামী আরো একজন পুরুষের সাথে রঙ্গ লীলায় মশগুল। সে মানসিক ধাক্কাটা সামলে নিতে পারে না। আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেয়। বিষ খায়। কিন্তু স্বামী ও পরিবারের অন্যদের সহযোগিতায় সে বেঁচে যায়। বউয়ের বাবা মায়ের তলব পড়ে। মা সব শুনেও মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে পারেন না। বিবাহিত মেয়েকে ফিরিয়ে নিলে গ্রামে কানাকানি পড়ে যাবে। ছোট দুটি মেয়ে এখনো অবিবাহিত। তাদের তো বিয়ে দিতে হবে। সে তার স্বামীকে ক্ষমা করে। 
এক রাতে ঝড় ওঠে। সমকামী স্বামী তার সুন্দরী স্ত্রীকে অনুরধ করে সে যেন উপরের ঘরে গিয়ে সাধক বাবার ঘরের জানালা গুলো বন্ধ করে আসে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে জানালা লাগাতে যায়। উভকামি সাধক ধ্যান মগ্ন অবস্থায় ছিলেন। জানালা লাগিয়ে বউ যখন ফিরে আসছিল অমনি সে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ধর্ষিত হয় ভণ্ড সাধক দ্বারা। ধর্ষিতা বধু মুখ ফুটে কেউকে কিছু বলতে পারে না। কিন্তু বাড়ির পিসি মা বিষয়টা বুঝে ফেলেন। কেননা পিসি মা’ই কেবল তার ব্যাথা বুঝতে পারেন। এর পরে সেই রাতে স্বামী সাধকের বিছানায় নিজ বধুর কোমরের তাবিজ আবিস্কার করেন। তাবিজ ফেরত দিতে এসে তারও বুঝতে বাকি থাকে না তার সখী (স্ত্রী) তারই স্বপ্ন পুরুষ সাধক বাবা দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছে। সে কষ্ট পায়। এর পর থেকে স্বামী চরিত্রকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না সিনেমার পর্দায়। আসলে কি সে আত্মহত্যা করেছিল না স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল তা জানা যায় না। কিন্তু সিনেমার শুরুই হয় এই স্বামীর ২৫ বছর প্রয়াণ দিবসকে কেন্দ্র করে উজ্জাপিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। স্বামীকে পাওয়া যায় বাধানো ছবির ফ্রেমে। 
সময়ের সাথে সাথে বর্তমান অতীতে রুপান্তরিত হয়। ভবিষ্যৎ বর্তমান হয়। ধর্ষিতা বউ যথারীতি গর্ভবতী হয়। সে একটা পুত্র সন্তানেরও জন্ম দেয়। গ্রামের চিরাচরিত প্রথাকে ভেঙ্গে তিনি তার ছেলেকে হোস্টেলে রেখে পড়ালেখা কোরান। ছেলের বয়স ১৬ বছর হলে তাকে পাঠিয়ে দেন বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য। ছেলে বাবার ২৫ বছর প্রয়াণ দিবসকে উজ্জাপন করার জন্য বিদেশ থেকে গ্রামে আসে। ছেলে দেখতে যেন সোনার টুকরো। যেমন তার উচ্চতা, তেমন তার পেটানো শরীর। আদর্শ পুরুষালী তার চলনে বলনে। মায়ের বয়স হয়েছে। আর কত দিন? ছেলের এবার বিয়ে দিতে হয় তো। না হলে মৃত্যুর সময় সংসারের চাবি, জমিদার বংশের প্রথা আর এই রাধা মাধবের মূর্তি কার হাতে তুলে দিবেন? ছেলের পিসি ছেলের জন্য বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আসে। মেয়ের ছবি দেখে ছেলের পছন্দ ও হয় বলে সকলে ধারনা করা শুরু করে। গ্রামের অন্যরা অবশ্য কানাকানি করে সাহেব ছেলে নিশ্চয়ই মেম সাহেবা বিয়ে করে আনবে। এদেশের মেয়ে তার মনে ধরার কথা না। 
মা ছেলেকে ডেকে প্রশ্ন করে। ছেলে তেমন কোন সদুত্তর দেয় না। মাও ধরে নেয় ছেলে হয়ত কোন মেম সাহেবাকেই বিয়ে করে বিদেশ বিভুয়িয়ে স্থির হবে। তার যত চিন্তা তার রাধা-মাধব নিয়ে। কেননা এই রাধামাধবের ভার তো সে তার সেই সমকামী স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। যে তাকে শারীরিক সুখ না দিলেও তার ভালো বন্ধু ছিল। তাকে ভালবাসত, তাকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। 
এমন সময় জমিদার পুত্রের প্রয়াণ দিবসকে কেন্দ করে বাড়িতে আবার আগামন ঘটে বৃদ্ধ সেই ভণ্ড সাধকের। ধর্ষিতা বউয়ের চুলে পাক ধরেছে। চেহারায় সেই জৌলুষ নাই। কিন্তু ভণ্ড সাধকের প্রতি তার ঘৃণা শেষ হয় না। তিনি সাধককে জানিয়ে দেন এই বাড়িতে আপনাকে পূজা করার মত আর কেউ অবশিষ্ট নাই। সুতরাং আপনার এখানে না থাকাই ভালো। কিন্তু বয়স বেড়েছে, মৃত্যুর সময় কাছিয়ে এসেছে বলেই সে শেষ কটা দিন এই বাড়িতে থাকতে চায়। অনেক অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে থাকার অনুমতি দেয় এই পৌড় মহিলা। কিন্তু সাধকের খাতির যত্নে আর তেমন মন নাই। 
অদ্ভুত হলেও সত্য যে, সাধকের প্রথম (যৌবনে) আগমনের সাথে সাথেই দর্শক অপূর্ণ গল্পটাকে সাজিয়ে নিতে পারবে। হয়ত অনেকে সেটাই করবে। কিন্তু পরিচালক যে শেষে এসে খেল দেখাবে সেটা আমিও ভাবিনি। গল্প এগিয়ে চলে। 
বাড়িতে অনুষ্ঠান শেষ হলে সবাই চলে যায়। শুধু সাধকই পাকাবাকি আস্থানা গড়ে। কিছুদিন পরে অসুখে ভুগে সাধকের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তিনি তার বীজে, জমিদার পুত্রের স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেওয়া অবৈধ সন্তানকে একবার চোখের দেখা দেখতে চান। কিন্তু ছেলের মা রাজি হন না। নিজের পুত্রকে না দেখেই সাধক দেহ ত্যাগ করে। সাধকের চিতা জলার পরে বাড়ির চাকর বাকররা এই মহিলার কাছে এসে জানতে চায় যে, সাধক বাবার ভস্ম কে গঙ্গা বিসর্জন দেবে? তিনি কি তার জীবদ্দশায় কারো নাম বলে গেছেন কি না? বা তার বংশের কেউ বেঁচে আছে কি না?? 
দর্শক হয়ত ভেবে নেবে এমন একটি চূড়ান্ত দোদুল্যমান সময় এসে কাহিনী শেষ হবে। কিন্তু না। অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান দিলেন সেই পিসি মা। জিনি বধুকে সব সময় বুকে করে আগলে রাখতেন। ততদিনে তিনি প্যারালাইজড হয়েছেন। তিনি আকারে ইঙ্গিতে জমিদার বংশের বিদেশ ফেরত ছেলের নাম বলেন। কেউ না জানলেও এই পিসি তো জানেন যে এই সন্তানের প্রকৃত বাবা এই ধর্ষক সাধক। অগত্যা মাকে তাই মেনে নিতে হয়। মা যায় ছেলের ঘরে। গিয়ে দেখতে পান তার ছেলে স্কাইপিতে কোন একজনের সাথে ইংরেজি ভাষায় রসের কথায় মশগুল। মা প্রথমে ধরে নেন কোন একজন বিদেশী মেম হয়ত হবে। কিন্তু তিনি আরও একটু এগিয়ে আসলে আবিস্কার করেন তারই গর্ভের সন্তান কোন এক বিদেশী সমকামী ছেলের সাথে প্রেম বাক্যে বুদ হয়ে আছে। 

গল্পটা এখানেও শেষ হতে পারত। কিন্তু না। মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে ছেলে মায়ের দিকে এগিয়ে আসে। মায়ের দুনিয়া ততক্ষণ ভেঙ্গে চুড়ে খান খান। ছেলে এসে মাকে জানায়- তুমি চাইলে আমি এখানেই সেটেল্ড হব। তোমার কাছেই থাকব। তোমার ইচ্ছাই আমার শেষ ইচ্ছা। 
মা খুব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন- তার আর দরকার হবে না। আমি অনেক বড় ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে যাচ্ছিলাম। ভগবান আমাকে রক্ষা করেছে। তুমি বিদেশে ফিরে যাও। যাকে কথা দিয়েছ, যাকে ভালোবাস তার সাথেই আজীবন কমিটেড থাক। মানুষের গড়া প্রথার থেকে শরীরের নিজেস্য প্রথা বড় সত্য। 
যে মা রাধা মাধবের মূর্তি নিয়ে, ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে এতো বেশি সেন্সেটিভ। যাকে তার বিদেশ ফেরত ছেলে ব্যাকডেটেড বলে হাসিতামাশা করে। সেই মা’ই যখন পৃথিবীর সকল স্বাধীনতাকে নিজের ছেলের নামে উৎসর্গ করে তখন আপনা আপনিই তিনি একজন আদর্শ মায়ে পরিনত হন। 
– 
সিনেমার কারিগরি দিক বাদ দিলে নিঃসন্দেহে একটি অসাধারণ সিনেমা এটা। সিনেমা জুড়ে রয়েছে বেশ কিছু অপূর্ব শ্রী কৃষ্ণ কৃত্তন। সিনেমার গল্প বর্ণনার জন্য পরিচালক বেঁছে নেন ঘটমান বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে কল্পনার বুনন। অসাধারণ দক্ষতায় পরিচালক গল্প বলেছেন। সমকামিতা সকল বিতর্কের উর্ধে উঠে কৌশলে তিনি সুন্দর করে গল্প বলে চলেছেন। সব থেকে ভালো লেগেছে এটাই যে বিকৃত যৌনতার ছড়াছড়ি না দেখিয়ে তিনি বেঁছে নিয়েছেন সমকামী পুরুষের মনের আকুলতা আর আবেগকে। 

মনের কথা গুলো কত অবলীলায় বল্যে গেল ছেলেটা। নিজের মা তাকে বুঝতে পেরেছে এটাইবা কম কি? এরকম সাধারণ আর স্বাভাবিক জীবনই আমি চেয়েছিলাম। যেখানে আমার পরিবার আমায় বুঝবে। আমাকে  নতুন করে বুঝবে । আমায় আবার তাদের মাঝে বাঁচার সুযোগ করে দেবে। এই সমাজ আমাকে মেনে নেবে। আমার দেশে আমি বাঁচার মতো বাঁচব। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবো।কতদিন আমি প্রানভরে নিঃশ্বাস নিতে পারি না। কতদিন আমি ভাল করে ঘুমতে পারি না। কত না পাওয়া যন্ত্রণা! আহারে কত যন্ত্রণা!