সা’দ ইবন মুয়াজ আউস গোত্রের আবদুল আশহাল শাখার সন্তান। আউস গোত্রের নেতৃত্ব ছিল এই আবদুল আশহাল শাখার হাতেই। সা’দ নিজে আউস গোত্রের একজন প্রভাবশালী নেতা। তার প্রতিবেশী বণু কুরাইজা ইহুদীরা ছিল তাদের মিত্র। এই দুই গোত্র একে অপরকে নিরাপত্তা এবং দেখভাল করতে বংশ পরম্পরায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। সা’দ কুরাইজা ইহুদীদের সামাজিক পারিবারিক অতিথি আপ্যায়নে নিজে ও তাদের অংশিদার করেছে বহু বছর। গোটা আউস গোত্র বণু কুরাইজা ইহুদীদের প্রতি কি পরিমাণ কৃতজ্ঞ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল সেটা আমরা কাহিনীর পরের অংশে দেখতে পাবো। তার আগে সা’দ সম্পর্কে আরেকটু বলি। এই সা’দকে বলা যেতে পারে নওমুসলিম জিহাদীদের নিষ্ঠুরতার প্রবাদপুরুষ। নিজ গ্রামবাসী স্বজনদের গণহত্যা করতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীদের দেখেছি। গ্রাম সম্পর্কীয় মুখচেনা আত্মীয়দের কতখানি ঘৃণার বিনিময়ে হত্যা করা সম্ভব ভাবলে বিস্মিত হতে হয়…।
নবী মুহাম্মদের মদিনায় হিযরত করার আগে সা’দ ইবন মুয়াজ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মদিনার প্রভাবশালী সম্পদশালী পৌত্তলিকরা মক্কার কুরাইশদের ধর্মাবতার হিসেবে খবরদারীতে ক্ষুব্ধ ছিলো। শুরুতে মুহাম্মদ আবদুল মোত্তালিবের ধর্মকে সংস্কার করে কুরাইশদের কায়েমী স্বার্থ খর্ব করতে চেয়েছিল। এতে মদিনা থেকে আসা হজ যাত্রীরা সমর্থন জানায় মুহাম্মদকে। তাদেরই একদল মুহাম্মদের কাছে শপথ করেন তারা তার অনুগামী হবেন। তার অনুসরণ করবেন। মদিনায় দ্রুত মুহাম্মদের অনুসারী বাড়ার্ এটাই ছিল প্রধান কারণ। সা’দ শুরুতে ইসলামের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান থাকলেও পরে ইসলামের তখন পর্যন্ত যে গেরুয়া রঙের সন্ন্যাসী আলখেল্লা পরনে ছিল তাতে আকৃষ্ট হয়ে মুহাম্মদের অনুসারী হয়ে উঠেন।
আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইসলামের তেমনই গেরুয়া বসন দেখে মুহাম্মদের অনুসারী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ মদিনায় আসার পর তার একের পর এক কর্মকান্ড তাকে খটকায় ফেলে দেয়। মক্কার বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণের যুক্তি উবাইয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। মুহাম্মদের যুদ্ধ এবং মদিনার বসবাসরত ইহুদীদের প্রতি ক্রমশ বিরূপ হওয়া নিয়ে আবদুল্লাহ ইবন উবাই ছিলেন ক্ষুব্ধ। তিনি একবার ইহুদীদের প্রতি ন্যায় বিচার আদায় করতে মুহাম্মদের গায়ের চাদর টেনে ধরেছিলেন। কুরআনে অনেকবার এ কারণে উবাইকে ‘মুনাফিক’ বলে সমালোচনা করা হয়েছে।
সবার উপর প্রভাব বিস্তার সমান হয় না। কারোর উপর একেবারেই হয় না। মুহাম্মদের মানুষকে প্রভাবিত করার অসম্ভব ক্ষমতা ছিল। তার জ্বালাময় বক্তৃতা শুনে তার অনুসারীরা পতঙ্গ যেমন আগুনে ঝাঁপ দেয়া ঠিক তেমনি তারাও অন্ধের মত নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ঝাঁপ দিতো শত্রু শিবিরে। সা’দ সেরকই একজন ছিলেন। মুহাম্মদ তাকে হিপনোটাইজ করেছিল। সব বিরিঞ্চিবাবাদের এই গুণটি থাকে। সা’দ তার গুরুর চোখের ভাষা বুঝত। মুহাম্মদকে খুশি করাই সা’দের জীবনের তখন একমাত্র লক্ষ্য। বণু কুরাইজাদের জীবনে সা’দ কিয়ামত নামিয়ে এনেছিল মুহাম্মদের ইচ্ছার কথা আন্দাজ করতে পেরেই। কারণ মুহাম্মদ সা’দকে বণু কুরাইজা ইহুদীদের শাস্তির বিষয়ে ফয়সালা করতে নিযুক্ত করেছিলেন। কেন সা’দকে নিযুক্ত করেছিল এবার সেই অংশটুকু জানা যাক…।
বদর যুদ্ধের অভাবনীয় সাফল্যের পরে ইসলামে লক্ষ্য বদলে যেতে থাকে। ইসলাম তখন মক্কা-মদিনা দখল করে মুসলমানদের শাসন কায়েম করার স্বপ্ন দেখছে। এই স্বপ্নের পথে যারা কাঁটা হয়ে দেখা দিবে ইসলাম তাদেরকে সমূলে উপড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না। মদিনার ইহুদীদের কাছে নিজেকে নবী দাবী করে কোন রেসপন্স মুহাম্মদ পাননি। ইহুদীদের সঙ্গে নিয়ে তার যে প্লাণ ছিল কার্যত তা ব্যর্থ হয়েছে। তাই মদিনার ইহুদীদের তিনি আর মদিনায় রাখতে চান না। ভবিষ্যতে এরা তার মনোবাসনার বাস্তবায়নের পথে বাঁধা হতে পারে। এই ভেবে মদিনার বণু নাযিরকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। আবদুল্লাহ ইবন উবাইয়ের হস্তক্ষেপে বণু নাযির ইহুদীদের হত্যার পরিবর্তে তাদের দেশ ছেড়ে চলে যাবার বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছিল । বণু কুরাইজাদের স্বস্তি ছিল আউস গোত্রের লোকজন যারা তাদের শত শত বছরের মিত্র। মুহাম্মদ যখন বণু করাইজাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনলেন এবং তাদের কঠোর শান্তির ইচ্ছা প্রসন করলেন তখন আউস গোত্রের আনসাররা মুহাম্মদকে বললেন, হে নবী, বণু কুরাইজারা আমাদের মিত্র। আউসদের শত্রু খাযরাজদের বিরুদ্ধে কুরাইজা ইহুদীরা আউসদের সঙ্গে ছিলেন। তারা কুরাইজাদের বিরুদ্ধে কঠোর না হতে দাবী জানাতে লাগল। অবস্থা বেগতিক দেখে মুহাম্মদ এক কঠিন চাল খেললেন। তিনি বললেন আউস গোত্রের কেউ কুরাইজাদের কি শাস্তি হওয়া উচিত ঠিক করে দিলে তোমরা মেনে নিবে? আউস গোত্রের লোকজন হ্যা বললে মুহাম্মদ সা’দ ইবন মুয়াজের নাম প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাবে আউস আর ইহুদীরা খুশি হয়ে মেনে নেয়। কারণ তারা জানত সা’দ ইবন মুয়াজ তাদের মিত্র বণু কুরাইজা ইহুদীদের বিরুদ্ধে কঠোর কোন সাজা দিবে না। অন্তত প্রাণে মারার মত কোন বড় সাজা সে দিতে পারবে না।
কল্পনা করুন আপনার গ্রামের হিন্দু পাড়ায় আপনাদের সাত পুরুষের সুসম্পক। একে অপরের নিমন্ত্রণে বাড়িতে আসেন- যান। বৌদি বলে যাদের সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা করেছেন, যাদেরকে অমুকদা, তমুকদা বলে সম্বধন করেছেন- তাদের আপনি হত্যা করার হুকুম দিলেন। নারীদেরকে বললেন তাদেরকে মুসলমান বাহিনীর হাতে তুলে দিতে। তাদের শিশুদের দাসে পরিণত করতে…। কি নিজেকে কিছুতে মানিয়ে নিতে পারছেন না এমন চরিত্রে? ১৪০০ বছর আগে ঠিক এরকমটাই করেছিলেন সা’দ ইবন মুয়াজ তার প্রতিবেশী বণু কুরাইজা ইহুদীদের সঙ্গে।
ইহুদীরা জানত না সা’দ ততদিনে এক অমানুষে পরিণত হয়েছে। আউস গোত্রের লোকজন তাদের মিত্র ইহুদীদের প্রতি কঠোর না হতে সা’দকে অনুরোধ করতে থাকে। জবাবে সা’দ বলেন, ‘আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন নিন্দুকের নিন্দার বিন্দুমাত্র পরোয়া সা’দের নেই।’ তারপর সে বণু কুরাইজাদের সাজা ঘোষণা করে- ‘আমি আমার রায় ঘোষণা করছি, তাদের মধ্যে যারা যুদ্ধ করার উপযুক্ত তাদেরকে হত্যা করা, তাদের নারী ও শিশুদেরকে দাস-দাসীকে পরিণত করা এবং তাদের ধন-সম্পদ বন্টন করে দেওয়া হোক।’
যাদের সঙ্গে সা’দের গ্রাম চাচা, বড় ভাই, ভাতিজা, ভাবী আর বোনের সম্পর্ক ছিল এই সেদিনও, সা’দ তাদের হত্যা করতে বললেন এবং সেই নারীদের মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে বললেন!
রায় শুনে মুহাম্মদ সন্তুষ্ঠচিত্তে বললেন, ‘সাত আসমানের ওপর থেকে আল্লাহ যে ফায়সালা দিয়েছেন তুমিও ঠিক একই ফায়সালা দিয়েছ’।…
(তথ্যসূত্র: সীরাতুনবী, ইবন হিশাম, উসুদুল, আল-ইসাবা, তাবাকাত, তাহজীবুত তাহজীর, আসহাবে রাসূলের জীবনকথা- মুহাম্মদ আবদুল মা’বুদ)