সাংবাদিকের কি আদৌ স্বাধীনতা আছে?

বর্তমান সময়ে ভীষণ রকমের অস্থিরতা বিরাজমান পুরো পৃথিবী জুড়ে। আমাদের দেশেও ক্রমাগত উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে পড়ছে। এই উগ্রতা এবং অসহিষ্ণুতা মোকাবিলায় মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা ক্রমশ কমে আসছে। কিন্ত এই উগ্রতা, অসহনশীলতা, সন্ত্রাসবাদ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। মানুষের বাকস্বাধীনতা যেমন প্রয়োজন তেমনই সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও প্রয়োজন। কেননা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন। সাংবাদিকরা ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সহজেই জনমত গঠন করতে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারেন।আমাদের দেশে অহরহই সাংবাদিকতার ওপর রাজনৈতিক আক্রমণ হচ্ছে এবং প্রযুক্তির অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ আরোপের সুযোগ নিয়ে কঠোর কালাকানুন তৈরি করা হচ্ছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে কঠিন করে তুলছে।একটি দেশের নাগরিক হিসেবে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভারসাম্য রক্ষায়, শ্রেণির-বিভেদ দূর করতে সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি মানুষের মানবিক মর্যাদাও সমুন্নত রাখতে হয়। একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তার নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা সংবিধান তথা দেশের প্রচলিত আইনে বহুভাবে বলা আছে। সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের পরই আসে মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন। সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। আর এই অধিকার নিশ্চিত করতে সাংবাদিক সমাজ তাদের লেখনীর মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।সংবাদপত্র হলো সমাজের আয়না। আর দেশ, জাতি ও সরকারকে এই আয়না দেখাতে সাহায্য করেন সাংবাদিকরা। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করার গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে। তাছাড়া রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সরকার এবং বিরোধী দলের পথনির্দেশনা তৈরি করে দেয় সংবাদপত্র। যার কারিগর হলো সাংবাদিক সমাজ। রাষ্ট্র পরিচালনায় হাজারো আইন রয়েছে। প্রয়োজনে নতুন নতুন আইনও তৈরি করা হয়। কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অত সহজ কাজ নয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সংবাদপত্র তথা সাংবাদিক সমাজ অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে।সমাজে বিদ্যমান নানাবিধ অসঙ্গতি, অন্যায়-অবিচার, সাফল্য-ব্যর্থতা সংবাদপত্রে প্রতিফলিত হয়। এতে আপামর জনসাধারণের পাশাপাশি সরকার ও দেশ উপকৃত হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশে সংবাদ এখন আর নিছক কোনো তথ্য নয় বরং বিনোদন ও জ্ঞানের ভাণ্ডার পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার। অবাধ তথ্য প্রবাহের এ যুগে তাই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।বাংলাদেশে বিভিন্ন কৌশলে গণমাধ্যম বন্ধ, নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এমনকি সাময়িক বন্ধ হবার নজীর আছে। সাংবাদিকদের উপর বেশকিছু চাপ আছে। কখনো সেটা কর্পোরেট, কখনো বিজ্ঞাপন বা প্রভাবশালী কোন মহলের কাছ থেকে আসে। এছাড়াও বাইরে আরো একধরণের চাপ আছে, যেটা অনেক সময় সাংবাদিকদের সেলফ সেন্সরশিপে বাধ্য করে। দেশের প্রচলিত আইন কিংবা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট অথবা ৫৭ ধারার মামলা যেটাই হোক সেগুলো সাংবাদিকদের মাথায় আগে থেকেই থাকে। সে ভাবে আমার প্রতিবেদনের কারণে আমাকে ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। ফলে সে আগে থেকেই সেলফ সেন্সরশিপে চলে যায়। কিছুদিন আগেও ঢাকা থেকে একজন সংবাদকর্মী রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হবার দু’মাস পর তাকে পাওয়া যায় নারায়ণগঞ্জে। এসব ঘটনা কার নির্দেশে কিংবা কিভাবে ঘটছে তা কখনোই স্পষ্ট হয়না। আবার আরেকদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কথায় কথায় মানহানির মামলা এখন এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আর মানহানির মামলা—এই দুটো জিনিস আমাদের সাংবাদিকতা জগতে বিরাট ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সে জন্য সাংবাদিকদের সেলফ সেন্সরশিপ সাংঘাতিক বেড়ে গেছে। এখন অনেক সংবাদই তাই আর ছাপা হয় না।এসব বিভিন্ন কারণে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হচ্ছে এবং সাংবাদিকদের কাজের পরিসর ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। সব মিলিয়ে সাংবাদিকতা এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও ব্যবসায়িক তিন দিক থেকেই এখন ক্রান্তিকাল।