করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসায় বেহাল দশা

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ-অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে। অনেক রোগী অভিযোগ করেছেন, জ্বর, সর্দি-কাশির মতো লক্ষণ থাকলেই এসব হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও অন্য রোগের চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল -ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা বন্ধ করেও দেওয়া হয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক চিকিৎসা না দিলে লাইসেন্স বাতিলসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে হাসপাতাল মালিকরা বলেছেন, সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন এবং সমন্বয় ছাড়া শুধু হুমকি দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না।

বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারি পর্যায়ে কয়েক দফা নির্দেশনা, বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের প্রতিশ্রুতির পরেও চিকিৎসার বেহাল চিত্র বদলায়নি। ফলে সাধারণ রোগীরা হচ্ছেন ভোগান্তির শিকার।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পাওয়ার এমন অনেক অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এমন ভূক্তভোগীর অনেকের অভিযোগ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমেও অনেক আলোচনা হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে কিছুদিন আগে অব্যাহত অভিযোগের মুখে সেবা দেয়া না হলে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকের লাইসেন্স বাতিল করা হবে-এমন সতর্কবার্তা দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে।

হৃদরোগ, কিডনি সমস্যাসহ জটিল নানা রোগ নিয়ে যারা বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন তাদের আগে করোনাভাইরাসের পরীক্ষার রিপোর্ট দেখাতে বলা হচ্ছে আর তা না দেখালে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ৬৯টি হাসপাতাল রয়েছে। এছাড়া সারাদেশে বেসরকারিখাতে শুধু হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে ১০ হাজারের বেশি। অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিক এই সংকটের মূহুর্তে বন্ধ করে রাখার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মালিকদের সাথে দফায় দফায় আলোচনার পরও মানুষ সেবা পাচ্ছে না।

বাংলাদেশে এরমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সোয়া লাখ এবং সংক্রমণ মৃত্যু দেড় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ভাইরাসের ব্যাপক সামাজিক সংক্রমণের কারণে এখন ঢাকার বাইরে‌ও প্রত্যন্ত এলাকায় প্রচুর রোগী শনাক্ত হচ্ছে। প্রতিদিনই হাজারো মানুষ আক্রান্ত হওয়ায় মারাত্মক চাপে পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। 

রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার বাইরে এখন স্বাস্থ্যসেবার ওপর চাপ বাড়ছে। ঢাকার বাইরে যে রোগীরা সংক্রমিত হচ্ছে সেই অনুপাতে  সেখানকার হসপিটাল ফ্যাসিলিটি কম। শুধুমাত্র ক্রিটিক্যাল রোগীরাই কেবল হাসপাতালে যাচ্ছেন কিন্তু প্রয়োজনীয় সেবা চাহিদা মতো নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে অ্যাকটিভ কেইস ৭০ হাজারের বেশি। তার ৫ শতাংশের যদি আইসিইউ সুবিধা প্রয়োজন হয় তাহলে সেটা সাড়ে তিন হাজার রোগী। আমাদের দেশে কোভিড রোগীদের জন্য আইসিইউ আছে ৩৪০টি যা এই পরিমাণ রোগীর অনুপাতে চাহিদার মাত্র ৯.৫%। 

করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন সংকটাপন্ন রোগীর জন্য আইসিইউ থেকে এখন বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে উচ্চচাপে অক্সিজেন সরবরাহ করা। ক্রিটিকাল রোগীদের জন্য জীবন রক্ষা করতে পারে এই ব্যবস্থা। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে দেশের মাত্র ২৩টি সরকারি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। বাকী হাসপাতালে চাহিদা পূরণের জন্য রয়েছে প্রায় ১৬ হাজার অক্সিজেন সিলিন্ডার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে সারাদেশে এ পর্যায়ে কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ আছে ১১ হাজারের মতো হাসপাতাল বেড। বর্তমানে সরকারি বেসরকারি সব হাসপাতালেই এখন কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। 

ঢাকার বাইরে সরকারি দু-একটি হাসপাতালের রোগীদের মেঝেতে রেখেও চিকিৎসা সেবা দিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এছাড়া অনেকক্ষেত্রে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই ছাড়পত্র দিয়ে নতুন রোগী ভর্তির ঘটনা ঘটছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে বাংলাদেশে ৬৫৪টি সরকারি এবং ৫০৫৫টি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির সময় রোগীর চাপ ও আতঙ্কে সাধারণ রোগীরাও অতি জরুরি না হলে হাসপাতালে যাচ্ছেন না। করোনাভাইরাস মহামারিতে সংকট তৈরি হয়েছে সাধারণ রোগের চিকিৎসায়।

করোনাভাইরাস মহামারিতে আরেকটি বড় সংকট দেখা দিয়েছে ডাক্তার নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা বড় অংশ আক্রান্ত হওয়ার কারণে। ডক্টরস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের তথ্যে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৪শ ৩৬জন স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ৬৬ জন। এর মধ্যে ৬০ জন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্ত হয়েছেন ১৩৭৬ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছে এবং জানাচ্ছে ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সবার সহযোগিতা দরকার। এই মুহূর্তে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ থাকা সর্বোচ্চ রোগীর তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সাত নম্বরে। গত বেশ কিছুদিন ধরে যে পরিমান টেস্ট করা হচ্ছে তার ২০-২৩ শতাংশ পর্যন্ত আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছে।