শরীফার জীবনকাহিনীঃ এক অনন্য উপাখ্যান

.

আমার শৈশবে সকলে আমাকে পুরুষ শিশু মনে করতো। অবশ্য, সময়ের সাথে সাথে আমি নিজেই উপলব্ধি করলাম যে, দেহের গঠন পুরুষসুলভ হলেও আমার অন্তরাত্মা নারীর মতো। আমার মহিলাদের পরিধেয় পরিধানে এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। পরিবার থেকে কেউ আমার এই অভিপ্রায়ে সহায়তা করতে রাজি ছিল না। গোপনে গোপনে আমি আমার বোনেদের সাজগোজের জিনিসপত্র ব্যবহার করে নিজেকে সাজাতাম। ধরা পড়লে মুখের ওপর বকাঝকা এবং প্রায়শ শারীরিক শাস্তি সহ্য করতে হত। আমার অন্তর সদাই মেয়েদের সাথে খেলাধুলায় মেতে উঠতে চাইত, কিন্তু তারা আমাকে তাদের খেলার সাথী হিসেবে গ্রহণ করত না। স্কুলে, পাড়ায়, এমনকি নিজের ঘরেও আমি অবহেলিত ছিলাম। নিজের এই ভিন্নতা নিয়ে আমি প্রচণ্ড কষ্ট পেতাম, একাকীত্ব অনুভব করতাম।

.

এক অনন্য দিনে, আমার সাক্ষাৎ হয় একজন এমন ব্যক্তির সাথে, যিনি সমাজের চোখে নারী হলেও নিজেকে পুরুষ বলে মনে করতেন। আমি তাঁর মধ্যে আমার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেলাম। তিনি আমাকে শিখালেন, আমরা নারী বা পুরুষ নয়, আমরা হলাম এক অনন্য লিঙ্গের প্রতিনিধি। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন এক অপূর্ব স্থানে, যেখানে লিঙ্গের সাধারণ বিভাজনের বাইরে নানান প্রকার মানুষের বাস। হিজড়াসম্প্রদায়ের এই সব মানুষের জীবনযাপন এক গুরু মায়ের নির্দেশনায় পরিচালিত হয়। এই নতুন স্থানে আসার পর আমি আর একা মনে করিনি, নিজেকে বিশেষ বা অন্য কিছু মনে হয়নি। আমি এই নতুন পরিবারের সাথেই থেকে গেলাম। এখানকার নিয়মাবলী, ভাষা এবং রীতিনীতি আমার পূর্ববর্তী পরিবারের চেয়ে ভিন্ন। আমরা একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিয়ে এক সার্বিক পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। পুরানো পরিবারের কথা মনে পড়লে হৃদয়ে কিছুটা ব্যথা অনুভব হয়, তাই মাঝে মাঝে তাদের কাছে ফিরে যাই।

.

বাড়ি ত্যাগ করেছি বিংশ শতাব্দীর দুয়োরে। তখন থেকে আমি আমার নতুন পরিবারের সাথে নগরের নানা প্রান্তে গিয়ে নবজাতক এবং নববধূকে আশীর্বাদ করে জীবিকা অর্জন করি। মাঝে মাঝে অর্থ সংগ্রহের জন্য মানুষের কাছে হাত পাতি। আমাদেরও ইচ্ছা করে, সমাজের বাকি সদস্যদের মতো একটি স্বাভাবিক, মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতে। তবে আজও অধিকাংশ মানুষ আমাদের সাথে মিশতে চায় না, যোগ্যতা থাকলেও কাজের সুযোগ দেয় না। কিন্তু আজকের প্রজন্ম আমাদের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল। বর্তমানে অনেকে আমাদের মতো নিজ গৃহে বসে শিক্ষা লাভ করছে, জীবিকার সন্ধানে ব্যস্ত। বিশ্বের বহু দেশে আমাদের মতো মানুষেরা অন্যান্য নাগরিকদের মতোই জীবন যাপন করছে। বাংলাদেশেও পরিবর্তনের হাওয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০১৩ সালে রাষ্ট্র আমাদের অস্তিত্ব স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য কাজ করছে, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সক্রিয় প্রচেষ্টা চলছে। নজরুল ইসলাম ঋতু, শাম্মী রানী চৌধুরী, বিপুল বর্মণের মতো বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর অনেক ব্যক্তি সমাজ ও পেশাগত জীবনে সাফল্য অর্জন করেছেন।

.

মোট কথা, এটি একটি উদ্দীপনাময় জীবনগাথা। এই কাহিনী মাধ্যমে শিশুমনে জেন্ডার নির্ধারণের বৈচিত্র্যকে সহজভাবে ধারণ করার প্রয়াস চালানো হয়েছে। লিঙ্গ নির্ধারণে মানুষের যেহেতু হাত নেই, তাই প্রতিটি প্রাণের প্রতি সমতার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতির সার্বভৌম আবেদন।

.

আমরা এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ফার্মেসি শিক্ষার্থী ওয়ালিদ ইসলামের উদাহরণ তুলে ধরতে পারি, যিনি এখন তেহরানের বাংলাদেশ দূতাবাসে এক অভিজ্ঞ কূটনীতিক হিসেবে কর্মরত। তাঁর আইডেন্টিটি ক্রাইসিস উপলব্ধির মধ্য দিয়ে আমাদের জানান দেয় যে, পরিচয়ের সংকট অত্যন্ত বেদনাদায়ক, তাই তিনি পরিচয় প্রকাশে বাধ্য হয়েছেন।

.

ভুল আমাদের পাঠ্যবইয়ে নয়, ভুল আমাদের ধারণায়। আজকের প্রজন্ম আমাদের চেয়ে আরও অগ্রসর, সহিষ্ণু এবং মুক্তমনা।

.

অতএব, যে শিক্ষক পাঠ্যবইয়ের বিশেষ অধ্যায়ের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক ক্রোধ প্রকাশ করেছেন, তাঁর মতবাদ বিশ্লেষণ এবং আলোচনার বাইরে। বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ও তার প্রণেতারা আমাদের গভীর সম্মান এবং প্রশংসা অর্জন করেছেন।

.

বাংলাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ আইন ও ধার্মিক মূল্যবোধ মেনে চলতে গিয়ে, আমাদের উচিত প্রত্যেকের বিশ্বাস ও মর্যাদাকে সম্মান করা।