সন্ধ্যায় দ্বীনের আলো

লিখেছেন জর্জ মিয়া
আমার পাশের ফ্ল্যাটের মালিকের মেয়ের বিয়ে, আজকে গায়ে হলুদ। এ বাড়ির গেট সব সময়ই আটকানো থাকে। এ বাড়ির তৃতীয় তলা এবং চতুর্থ তলায় দু’টি হিন্দু পরিবার বাস করে। বিয়ে উপলক্ষে এই বাড়ির গেট আজকে সারাদিন খোলা দেখলাম। আমার এক আত্মীয় এই ফ্ল্যাটের দোতলার বাসিন্দা। কোনো কারণ ছাড়াই শুধুমাত্র বাসার গেট খোলা, এই কারণেই অনেকবার গেলাম। বাধাহীন যাতায়াত, স্বাধীনতা যাকে বলে আর কী! জাঁকজমক করেই বিয়ে হচ্ছে। তাও আবার এমন ধুমধাম করে, যা শরিয়ত বিরোধী এবং হিন্দুদেরকে বাড়ি ভাড়া দেয়া হচ্ছে আর এক অন্যায়। আমিরে মোজাদ্দেদিয়া আল ইসলামের শাখা অফিস এই মহল্লায় থাকার কারণে তাদের কানে খবরটা যেতে খুব বেশি দেরি হয়নি। ব্যান্ড পার্টির আওয়াজেই তাদের কাছে খবর পৌঁছে গেছে। এতদিন তারা জানতো না, এই বাড়িতে কোনো বিধর্মী ভাড়া থাকে। আমিরে মোজাদ্দেদিয়া আল ইসলাম-এর সদস্যরা সন্ধ্যার দিকে মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষণ পরেই চলে এসেছেন। বাড়িতে সুনসান নিরবতা। ছোট ছেলে-মেয়েগুলো শুধু “আল্লা আল্লা” করছে। আমিরে মোজাদ্দেদিয়া আল ইসলামের নাম এ দেশের সবাই কমবেশি শুনেছে। তাদের কাজই হচ্ছে দেশকে ইছলামী দেশে রূপান্তর করা। গতকালও এক হিন্দুর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। লক্ষ্মী নামের আমার এক বান্ধবীকে তুলে নিয়ে গেছে, এখনো খোঁজ মেলেনি তার। মোহাম্মদ রফিক নামের আমার বাল্যবন্ধু এই সংগঠনটির এই অঞ্চলের প্রধানের দায়িত্বে আছে। সে-ই অপারেশনের নেতৃত্বে থাকবে আজ। অন্তত ভাবসাব দেখে তাই মনে হচ্ছে আমার।

“যে যেখানে ছিলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকুন,” হুংকার ছাড়লো মোহাম্মদ রফিক। “মেয়ের বাবা কে? যার সাথে বিয়ে হচ্ছে, সে ছেলের বাবা কি এখানে উপস্থিত আছেন?”
“আসসালামু আলাইকুম, হুজুর,” উত্তর দিলো জনৈক। “জ্বি, মেয়ের বাবা আছেন, উনি মূর্ছা গেছেন আপনাদের আসার সংবাদ শুনে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি।”
“ছেলের বাবা কোথায়? এখানে নেই নাকি?”
“আসসালামু আলাইকুম, হুজুর” উত্তর দিলো বর। “আব্বা আসেননি এখনো। চলে আসবেন, পথেই আছেন।”
“তুমি আমাকে সালাম দিলে; তুমি কি মুছলিম?”
“জ্বি, হুজুর, আমি মুছলিম সুন্নী।”
“তোমার পোশাক কি তাই বলে?” বলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে একই কথা আবারও বললো রফিক। “এই ছেলের পোশাকে বোঝা যায় কি, এ মুছলিম নাকি অন্য ধর্মের?”
“জ্বী না, হুজুর, একে দেখে বোঝা যাচ্ছে না, এই ছেলে মুছলিম কি না!” তার সঙ্গের লোকগুলো জবাব দিলো।
“তাহলে এই ছেলের দাবি ভিত্তিহীন!”
এদিকে মেয়ের বাবার জ্ঞান ফিরেছে। ভদ্রলোক সরকারী আমলা ছিলেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত। সালাম দিয়ে সদর কক্ষে প্রবেশ করলেন।
রফিক জানতে চাইলো, “আপনি কে?”
“আসসালামু আলাইকুম হুজুর। আমি মুনার বাবা।”
“আপনার মেয়ের আজকে বিয়ে দিচ্ছেন এই ছেলের সাথে?”
“জ্বি হুজুর। আল্লার ইচ্ছেতে আজকে বিয়ে হচ্ছে তাদের। আপনাদের দাওয়াত দিতে যেতে পারিনি বলে দুঃখিত। তবুও আপনারা এসেছেন, আমার খুবই ভালো লাগছে। আপনারা আমার মেয়েকে দোয়া করে যাবেন। আমার মেয়ে যেন সুখে থাকে।”
“অবশ্যই আমরা দোয়া করবো। আল্লাহ যদি চান, তবে আপনার মেয়ে সুখে থাকবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ বিয়ে ইছলাম মতে হচ্ছে না। রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, যতটা সম্ভব অনাড়ম্বরভাবে বিবাহ সম্পন্ন করতে এবং তিনি এ-ও বলেছেন, প্রত্যেক মুমিনার জন্য একজন মুমিন নির্ধারিত। কিন্তু আপনার মেয়েকে যার সাথে বিয়ে দিচ্ছেন, সে ছেলে বেশরিয়তি মনোভাবাপন্ন এবং পশ্চিমা ইহুদি সংস্কৃতি থেকে প্রভাবিত। এ রকম ছেলের সাথে আপনার মেয়ের বিয়ে হতে পারে না। আপনি যেহেতু একজন মুছলিম, সেহেতু আপনার মেয়ে হবেন পর্দানশীল এবং দ্বীন ইলম প্রাপ্ত পুরুষের স্ত্রী। কিন্তু আপনার মেয়েকে যে-ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছেন, সে মোনাফেক। একজন দ্বীনি মুমিনার কোনো মোনাফেকের সাথে বিয়ে হতে পারে না। কাজেই এ বিয়ে হতে পারে না।”
“হুজুর তাহলে উপায় কী? কে করবে আমার মেয়েকে বিয়ে? তাছাড়া ওদের সাথে আমাদের সবকিছু পাকাপাকি করেই এই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। সবাইকে নিমন্ত্রণও দেয়া হয়ে গিয়েছে। এখন যদি এ বিয়ে না হয়, তাহলে আমার মুখ দেখবো কী করে সমাজে? আর সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মুনা আসলামকে ভালোবাসে। দীর্ঘদিন ধরেই ওদের মধ্যে সম্পর্ক!”
“নাউজুবিল্লাহে মিন জালেক! ছিঃ ছিঃ! এত অধঃপতন! আমার আল্লার রাসুল বলেন, প্রেম-ভালোবাসা এসব বিবাহের আগে সম্পুর্ণ নিষেধ। প্রেম করতে চাইলে সেটা হতে পারে আমার আল্লা আর তার পেয়ারা হাবিব রসুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে। এ ব্যতীত অন্য প্রেম হতে পারে না। আপনার ছেলেমেয়েকে ইসলামী শিক্ষাদানে ত্রুটি ছিলো, এটা এখন স্পষ্ট হয়েছে। আপনারও সাজা হতে পারে।”
সংগঠনের মধ্য থেকে একজন চিৎকার করে বলছে, ‘নারায়ে তাকবীর’, বাকিরা বলছে, ‘আল্লাহু আকবর’! মুহুর্মুহু ধ্বনিতে বাড়িটা কেঁপে উঠছে মনে হচ্ছে। রফিক হাত ইশারা দিয়ে থামতে বললো সবাইকে। থেমে গেছে সবাই।
রফিক আবারো বলতে শুরু করলো, “এই ছেলে মুছলিম হয়েও এখন অন্য ধর্মের সংস্কৃতি ধরে রেখেছে তার পোশাক-আশাকে। প্যান্ট-শার্ট স্যুট-বুট কোনো সুন্নতি পোশাক নয়। এ ছেলেকে আমাদের সংগঠনের খেদমতে লাগিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হোক। আর এই মেয়ের যেহেতু আজকেই বিয়ে, সেহেতু এমন শুভ কাজকে পণ্ড করলে আল্লাহ নারাজ হবেন। সুতরাং এ মেয়েরও বিয়ে অন্য কারো সাথে দিয়ে দেয়া হোক, যিনি কোরান-সুন্নাহর আলোকে আমাদের চোখে একজন দ্বীনি বান্দা। এ মেয়েকে বিয়ে দেবার আগে এর নাম রাখা হোক মোসাম্মত খাদিজা বিবি। আজ থেকে এ নামই এই মেয়ের নাম। ভুলেও যেন কেউ অন্য নামে না ডাকে।”
মাথা নিচু করে ভাবছে কিছু একটা মোহাম্মদ রফিক। তারপর মাথা তুলে একজন সদস্যর দিকে তাকিয়ে বললো, “এখানে আমি অনেক পাত্রই দেখছি আমাদের সংগঠনের, কিন্তু যোগ্য বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে না কাউকেই। তাছাড়া সামর্থ্যের দিক থেকেও অনেকেই অনেকের থেকে আগে-পিছে আছে। কী করা যায়?”
সেই ব্যক্তি বললো, “হুজুর, বেয়াদবি না নিলে আপনাকে আমি একটা উপদেশ দিতে পারি। আপনি যদি মোসাম্মত খাদিজা বিবিকে আপনার বিবি করে নেন, আমার মনে হয় না এখানে কারো দ্বিমত থাকবে। তাছাড়া এই বিপথগামী মেয়েটিকে আল্লাহর রাস্তায় পরিচালনার জন্য হলেও আপনার মত একজন আল্লাহর সৈনিকের তাকে বিয়ে করাটা জরুরি বলেই আমি মনে করি।”
রফিক এবার সবার দিকে তাকালো। তাকানোর ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে, সবার মতামত জানতে চাইছে সে। সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রফিক বুঝে নিলো, নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ। তখন সে বললো, “তবে তাই হোক। আমি মোসাম্মত খাদিজা বিবিকে নিকাহ করে আমার চতুর্থ বিবির মর্যাদা দিতে চাই। কাজী সাহেবকে ডাকা হোক। আর সমস্ত আলো নিভিয়ে দেয়া হোক। শুধু ঘরেরগুলো ছাড়া। কারণ এগুলা অপচয়। অপচয়কারী শয়তানের ভাই।”
কাজী সাহেব এলেন, ৩ বার কবুল বলে রফিক তাকে বিয়ে করে ফেললো। এদিকে এশার আযান পড়ে গেছে, নামাজে যেতে হবে। মেয়ের বাবা আবারো মূর্ছা গেলেন। আসলামকে ধরে নিয়ে গেছে আমিরে মোজাদ্দেদিয়া আল ইসলাম এর টর্চার সেলে। আগে তাকে পিটিয়ে ইহুদিদের ভূত তাড়াতে হবে মাথা থেকে।
রফিক তখন বললো, “এশার আজান পড়ে গেছে। সালাতে যেতে হবে মসজিদে। এখানে, শুনেছি, দুটো হিন্দু পরিবার আছে। তাদেরকে বলে দেয়া হোক, নামাজের পরে আমি আসছি। তাদেরকেও এক আল্লাহ ও এক নবীর তরিকায় চলতে হবে। মুসলমান হতে হবে। এ মহা সওয়াবের কাজ আমিই করবো ইনশাল্লাহ। আমার আল্লাহ যদি চান, তবে অবশ্যই আমাকে এ কাজে সাহায্য করবেন। আল্লাহ ছাড়া আর কোন সাহায্যকারী নেই। থাকতে পারে না। আর যদি হিন্দু পরিবার দু’টি চায়, তবে তাদেরকে একটি সুযোগ দেয়া হোক। আমাদের ফিরে আসার আগেই তাদেরকে এ স্থান ত্যাগ করতে। কেননা, আমার আল্লাহ বলেছেন, লা ইক রাহা ফিদ্দিন – ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। সবাই মসজিদের পানে চলো – ফি আমানিল্লাহ।”
(কাল্পনিক গল্প)