লিখেছেন জুলিয়াস সিজার
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক এবার বইমেলার শুরুর আগেই ‘উসকানিমূলক’ লেখা না ছাপানোর জন্য প্রকাশকদের সতর্ক করে দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘উসকানিমূলক’ লেখা কী? কোন ধরনের লেখা উসকানিমূলক লেখার পর্যায়ে পড়ে এই দেশের প্রেক্ষাপটে? উত্তরটা একদম সহজ: “যেসব লেখায় ‘ইসলাম’ ধর্মের গঠনমূলক সমালোচনা থাকে, যেসব লেখা ইসলাম ধর্মের যে কোনো ‘পয়গম্বর’ নবী-রাসুলকে নিয়ে সমালোচনা থাকে, আরও পরিষ্কার করে বললে – যেসব লেখা এ-দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়, সেসব লেখা এই দেশের প্রেক্ষাপটে উসকানিমূলক লেখার পর্যায়ে পড়বে।”
উসকানিমূলক লেখার যে-সংজ্ঞা এ-দেশের কাঠমোল্লারা নির্ধারণ করে দিয়েছে, আপাতত তা ধর্মের সমালোচনা এবং নাস্তিকতা বিষয়ক বইগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে, যে-কারণে এখনও তা দেশের খুব বেশি মানুষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠেনি। বরঞ্চ আধুনিক মুসলমান (!) বলে পরিচিত মডারেট মুসলমানেরা এতে আরও খুশিই হবেন।
তাই ২০০৪ সালে হুমায়ুন আজাদকে কোপানোর পরেও যেমন প্রেমকুমার সাহিত্যিকেরা দিব্যি মেলায় গিয়ে মুখে মিটিমিটি হাসি ধরে রেখে মেলায় ঘুরেছেন, অটোগ্রাফ দিয়েছেন ভক্তদের, এবারও ঠিক তাই করবেন; বাংলা একাডেমি মহাপরিচালকের এমন বক্তব্যের পরেও। যেমন, গত বছর অভিজিৎ রায়কে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার পরেও বইমেলাতে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি।
তবে উসকানির এই সীমা ধর্মের সমালোচনামূলক বই, নাস্তিকতার বইয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আস্তে আস্তে এই সীমা বাড়বে এবং বাড়তে বাড়তে ছড়িয়ে পড়বে। যেমন,
– কুরান বলে, মাটি দিয়ে আদম আর আদমের হাড় থেকে নারী হাওয়ার সৃষ্টি। বিজ্ঞান বলে ভিন্ন কথা। বিজ্ঞানের আস্থা ডারউইনের বিবর্তনবাদে। অতএব ‘বিবর্তবাদ’ এ দেশে নিষিদ্ধ করে দাও।
– ইসলাম বলে, সূর্য সেজদা দিতে দিতে আল্লাহর আরশের নিচে চলে যায়, সেজন্য রাত হয়। ওদিকে বিজ্ঞান বলে, আহ্নিক গতির জন্য রাত হয়। মোল্লারা খেপে উঠবে, ‘কী সব গতি-টতি পড়ানো হচ্ছে!’ আর মুসলমানদের কোমল, ভঙ্গুর ধর্মানুভূতিকে অত্যধিক সম্মান করা রাষ্ট্র সেটাও মেনে নেবে।
এর পর প্রেমকুমার সাহিত্যিকদের প্রেমের উপন্যাসে নায়ক-নায়িকাকে হাত ধরে হাঁটানো যাবে না গল্পে! বেগানা ছেলেমেয়েদের হাত ধরে হাঁটাহাঁটি অনৈসলামিক। নায়ক-নায়িকার নামও হয়তো ঠিক করে দেবে মোল্লারা। তখন প্রমকুমারেরা লিখবেন: “নদীর পার ধরে হেঁটে যাচ্ছে মুমিন এবং কুলসুমা। নাহ, হাত ধরাধরি করে নয়। বিয়ের আগে পরপুরুষকে ছোঁয়া নিষেধ। মাঝখানে দেড়হাত দূরত্ব রেখে শরীয়া মোতাবেক হাঁটছে তারা। কুলসুমা সারা শরীর পর্দা করে। ট্যাং ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কুলসুমার ট্যাং-এর দিকেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে মুমিন।”
তখন এসব বেরোমান্টিক আরবি-বাঙালি সাহিত্য আর পাঠক খাবে না। তখন আজকের নির্বিবাদী প্রেমকুমার সাহিত্যিকদের হুঁশ ফিরবে। দুঃখজন ব্যাপার হচ্ছে তখন আর কিছুই করার থাকবে না। এভাবে উসকানির সীমা একসময় বাড়তে বাড়তে বইমেলার বাইরে চলে আসবে।
– তখন ছেলে-মেয়েদের আলাদা আলাদা ক্লাসে বসাবে মোল্লারা।
– পার্কে ইটিশপিটিশ করার জন্য মডারেটদের পাছায় দোররা মারবে।
– রিকশার হুড তুলে রোমান্স করা যাবে না।
– অনলাইনে নারী-পুরুষ চ্যাটিং হারাম ঘোষণা করা হবে।
এভাবে উসকানি আর ইসলামের ঠেলায় একদিন মডারেট মুসলমানদেরই নাভিশ্বাস উঠে যাবে।
ইসলামিক দেশগুলোর কাজই হচ্ছে সময়ের তুলনায় পিছিয়ে যাওয়া। আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, সৌদি আরব, পাকিস্তান কোথায় শিল্প-সাহিত্য কিংবা বিজ্ঞান ও দর্শনের মূল্য আছে, বলুন? এসব দেশে মূল্য আছে শুধু ফতোয়া আর গোঁড়ামির। এসব দেশের ইতিহাস শুধু পিছিয়ে যাওয়া আর পিছিয়ে যাওয়ার। বাংলাদেশই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
বাংলাদেশও সে-পথেই এগোচ্ছে। যে-দেশের মানুষের রোল মডেল সৌদি আরব, সে-দেশ তো অন্ধকারের দিকেই এগোবে, সে-দেশে মুক্তচিন্তা আর প্রগতিশীলতা তো নিষিদ্ধ হবেই, সে-দেশের গন্তব্যই হচ্ছে পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো একটা নরকে পরিণত হওয়ার। এটাই তো অমোঘ নিয়তি।