লিখেছেন নরমপন্থী
আজকে ঝাল শুটকির ভর্তা দিয়া ভাত খাইলাম। ভালই লাগলো। খাইতে খাইতে একটা গল্পের কথা মনে পড়ল। কিছু ছেলেভোলানো গল্প আছে, যা আমাদের মগজের কার্যক্ষমতা বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, যাতে সমাজব্যবস্থা শৈশবেই আমাদের পায়ে ধর্মের বেড়ি পরাইতে পারে। শৈশবে এই রকম একটা গল্প পড়ছিলাম, বা হয়তো শুনেও থাকতে পারি, ঠিক মনে নাই। গল্পের বিশেষত্বটুকু পরিষ্কার মনে আছে। কারণ এই সব গল্প আমাদের মগজের মধ্যে একধরনের সীমাবদ্ধতার দেয়াল তৈরি করে।
“একবার এক বুজুর্গের সাথে তর্কে লিপ্ত হলো স্বয়ং শয়তান। বুজুর্গ তার অতিকায় জ্ঞানভাণ্ডার ব্যবহার করে যুক্তি-তর্ক করতে থাকলো। একই সাথে শয়তান তার শয়তানি যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে বুজুর্গের যুক্তি-বিবেচনাকে পরাভূত করতে চেষ্টা করলো। এক পর্যায়ে দেখা গেল, দুর্ভাগ্যবশত বুজুর্গ ঈশ্বর/আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণে ব্যর্থ। তারপর বিচক্ষণ বুজুর্গ বলল, “দূর হ, শয়তান! তুই যতই যুক্তি দেখাস, আমি সবকিছু উপেক্ষা করে অন্ধভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে যাব।”
উক্ত গল্পের মাধ্যমে অন্ধভাবে কোনো বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে রাখার গুণকীর্তন করা হয়েছে। এইভাবে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মনে (পরকালের শাস্তি আর ঈশ্বর-শয়তানের কথা বলে) অন্ধবিশ্বাসের রক্ষা করার প্রবণতাকে অনুকরনীয় এবং কৃতিত্বের কাজ বলে শেখাতে শুরু করা হয়।
তারপর আমরা বয়সের গণনায় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষে পরিণত হই, যখন আমাদের সম্বল ১.৩ বা ১. ৪ কেজি ওজনের মগজ আর একগাদা স্মৃতি আর তথ্যাদি, যার কিছু অংশ শৈশবশিক্ষার নামে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা সামাজিক জীব হওয়ার সুবাদে নিয়মতান্ত্রিকভাবে হজম করেছি। আর তাই ঝাল শুটকির ভর্তা দিয়া ভাত ডলা দিয়া খাইতে হয়ত এখনও ভালো লাগে। কারণ শৈশবে হয়ত আমাদের চারপাশে সবাই এই রকম ঝাল এবং দুর্গন্ধযুক্ত খাবারকে স্বাদের পরিচায়ক বলে ভাবতে শিখিয়েছে। অথচ আমরা কি কখনো ভেবে দেখি আগুনে পোড়ার মত অনুভূত হওয়া ঝাল যন্ত্রণার খাবার ভালো লাগার কি কোনো যৌক্তিক কারণ আছে? বুঝলাম, আমাদের যা ভালো লাগে, তা হয়তো আমৃত্যু ভালো লাগবে, তার মানে এই না যে, আমরা আমাদের নিজস্বতা থেকে এক মুহুর্তের জন্য দূরে গিয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ চিন্তা করতে শিখতে পারব না। কোনো অনভ্যস্ত পশ্চিমা শেতাঙ্গের মুখে এই ধরনের খাবার তুলে দিলে কী হতে পারে, তা আমরা কল্পনা করতে পারি। আমাদের কাছে আমাদের খাবার, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ধর্মবিশ্বাস ভালো লাগে, তার কারণ আমরা এইটাতে অভ্যস্ত হয়েছি। একই নিয়মে সবাই সবার পিতামাতা থেকে পাওয়া বিশ্বাসকে সত্য মনে করে বসি।
এইরকম খাবারদাবারের মতো অনেক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা একটা নির্দিষ্ট সমাজে বেড়ে ওঠার কারণে অভ্যস্ত। কিন্তু একটা সময় পরে আমাদের বিবেচনা শক্তির পরিপক্কতা আসা উচিত, যাতে আমরা আমাদের ভালো লাগা সত্ত্বেও এই ভালো-লাগা সত্য মনে হওয়ার পেছনের বিষয়গুলো নিরেপক্ষভাবে বিবেচনা করতে পারি। একজন পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গের যেমন তার শূকরের মাংস দিয়ে তৈরি খাবারদাবার ও তার চারপাশ থেকে পাওয়া ধর্ম ভালো লাগে, আমাদের ভালো লাগে আমাদের জিনিসপত্র, আমাদের চিন্তাভাবনার ধরন। দীর্ঘ মেয়াদে আজ থেকে শত বছরের পরিসরে আমাদের সভ্যতার কোন বিষয়গুলো ভবিষ্যতের মানব সভ্যতার জন্য মঙ্গলদায়ক হবে এবং কোন বিষয়গুলো ভবিষ্যতের মানব সভ্যতার বিপর্যয় ডেকে আনবে, তা নিয়ে ভাববার সময় আজই।
আমাদের চিন্তাভাবনা ও যৌক্তিক বিবেচনার জন্য প্রতিবন্ধকতামূলক মধ্যযুগীয় গ্রন্থাবলী আমাদের জন্য মঙ্গলদায়ক কি না, বর্তমান পৃথিবী জুড়ে ধর্মীয় হানাহানি দেখেই তা অনুমান করা যায়। পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত জীবনব্যবস্থা এবং তাদের অগ্রগতির অর্জনের পেছনে তাদের ভালোমন্দ এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত পরিছন্ন আলোচনার পর্যালোচনার সুযোগ এবং ফরাসী বিপ্লব-পরবর্তী মুক্তচিন্তার পরিবেশ অনেকাংশে অবদান রেখেছে। মানবমগজের কিছু বিবর্তন জনিত সহজাত প্রবণতার এবং সীমাবদ্ধতার কারণে পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষ হয়তো কখনই ধর্মবিশ্বাস থেকে সরে আসতে পারবে না। তাই ধর্ম হয়ত কখনোই পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে না। একই কারণে পৃথিবীর ইতিহাসে ধর্মের গোঁড়ামিমুক্ত মানবতাবাদী দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিরা সব সময়েই সংখালঘু ছিল। আজও তাই যারা নিজেদের ঐ সীমিত সংখ্যক দায়িত্বশীল জনগোষ্ঠীর সদস্য হতে সাহসিকতার সাথে বাস্তবতাকে জানতে বুঝতে, শিখতে বা জানতে সক্ষম, তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বিবর্তনজনিত স্বার্থপর জিন (gene)-প্রসূত মানবসমাজে তথাকথিত ধর্ম-জাত-কূলের নামে যে-স্বার্থপরতার অনাকাঙ্খিত চর্চা চলতে থাকে, তা ভনিতাবিহীনভাবে স্বীকার করে নিতে এবং বুঝতে হবে, যাতে আমরা আমাদের ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় রেখে মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারি। আর যারা নাস্তিকতাভিত্তিক জীবনের উদ্দেশ্য অর্থহীন ভেবে আঁতকে ওঠে, তাদের উদ্দেশে প্রফেসর হুমায়ুন আজাদ একটা বাণী মনে পড়ে: “নিরর্থকতাকে মেনে নিয়েই নিরর্থকতার মুখোমুখি হতে হবে, ঝিনুকের ব্যাধিকে পরিনত করতে হবে মুক্তোয়