বাংলাদেশে ৩৭৭ ধরা আইনে বিসমকামী যৌনতা ছাড়া সব যৌনতা আপরাধ। এই আইন অনুযায়ী কেউ সমকামিতা করলে অপরাধী হিসেবে চিহ্নত হয়ে কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। শাস্তির ভয়ে বাংলাদেশের সমকামীরা প্রকাশ্যে আসে না। আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বারংবার সমকামীদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে সমকামীদের সংখ্যা নেহাতই কম না। জুলহাজ মান্নান ও মহবুব তনয় নামের দুজন সমকামী অধিকার কর্মীর হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে সমকামিতা ইস্যুটি বাংলাদেশের মডিয়ায় চলে আসে। এই হত্যাকান্ডের পর আর কোন হত্যাকান্ড না ঘটলেও সমাজে সমকামীদের নির্যাতন বন্ধ হয় নি। শত শত নির্যাতনের মধ্যে দুই একটি নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ হয়। এ রকম কিছু নির্যাতনের ঘটনা আমরা আজ তুলে ধরবঃ-
১. পারিবারিক নির্যাতনঃ একজন সমকামী ব্যক্তির যৌন প্রবৃত্তির কথা প্রকাশ হওয়ার পরপরই প্রথম নির্যাতনের শিকার হতে হয় পরিবার থেকে। ২০১৭ সালে খুলনার সাজ্জাদ নামক একজন সমকামীর আত্মহত্যার কাহিনী মিডিয়ায় চলে আসে। সাজ্জাদ ছিল সমকামী। তাই সে কোন নারীকে বিবাহ করতে চায় নি। কিন্তু তার পরিবার বিবাহর জন্য চাপ সৃষ্টি করে এবং বিবাহ ঠিক করে। সব কিছু জানার পর সাজ্জাদ পালিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয় কিন্তু বাস ছাড়তে দেরি হওয়ায় পরিবারের এক সদস্যের হাতে ধরা পড়ে। তারপর তাকে জোর করে বিবাহ দেয়া হলে বিবাহের রাতেই বিষপান করে আত্মহত্যা করে। শুধু এটিই নয়, ঢাকার জয় খন্দকার নামের এক ব্যক্তিকে বিবাহ করতে বাধ্য করা হয় এবং পরে তার পরিবারের কাছে বিষয়টি জানাজানি হলে তার স্ত্রী তাকে হুমকি দেয়। যার ফলে তিনিও ঘুমের ঔষধ সেবন করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে অনেক চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি বেঁচে যান।
২. সমাজ কর্তৃক নির্যাতনঃ পরিবারের পরেই আসে সমাজ থেকে নির্যাতন। রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার সুমন নামক একজন রুপান্তরকামী এ রকম নির্যাতনের শিকার হন। ছোট বেলা থেকে সুমনের চলাফেরা একটু ভিন্ন ধরণের। রুপান্তরকামী হওয়ার কারণে কিছুটা মেয়েদের মতো চলাফেরা ছিল তার। আর এতেই সমাজের মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। যারা ফলে সমাজে তাকে নানাভাবে হেনস্তা এবং অপমাণিত হতে হয়। অবশেষে অপমাণের হাত থেকে বাঁচতে গ্রাম ছেড়ে এখন ঢাকায় বসবাস করছে সুমন।
৩. ধর্মীয় নির্যাতনঃ সমকামীদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো ও নির্যাতন করার পিছনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও পিছিয়ে নেই। এ রকমই একটি নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরেন ঢাকার আসফাক নামের একজন সমকামী ব্যক্তি। তিনি তার জীবনের একটি ঘটনা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, তখন তার বয়স ষোল, সতের বছর চলছে। ভালবেসেছিলেন গ্রামেরই সমবয়সী আরেকজন ছেলেকে। আর এই অপরাধে গ্রামের মসজিদ কমিটি বিচারের আয়োজন করে। সেই বিচারে তার পরিবারকে অপমান করা হয় এবং তাকেও শারীরিকভাবে নির্যাতনের করে রক্তাক্ত করা হয়। সেই সময়ের নির্যাতনের কিছু দাগ এখনও তার শরীরে রয়েই গেছে। শুধু তাই নয় তারা ভালবাসার মানুষটিকেও কেড়ে নেয়া হয়েছিল বলে দুঃখ প্রকাশ করেন আসফাক।
৪. ক্রাইম এর শিকারঃ প্রায় প্রতিটি সমকামীর জীবনে এরকম অভিজ্ঞতা আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রংপুরে অবস্থিত রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী তুলে ধরেন কিছুদিন আগে তার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা। ফেসবুকে পরিচিত হয় একজন ব্যক্তির সাথে। কিছুদিনের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন ভালবাসার সম্পর্কে। মাসখানিক যেতেই সেই ছেলে তাকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি জনশূন্য ( মানুষ তেমন যায় না সব সময়) কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকে আরও কিছু বখাটে ছেলেকে রেখে এসেছিল। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর ভয় দেখিয়ে একের পর তাকে ধর্ষণ করে। তারপর গলায় ধারাল অস্ত্র ধরে বাড়িতে ফোন দিয়ে বিশ হাজার টাকা আনতে বাধ্য করে। বিকাশের মাধ্যমে বিশ হাজার টাকা তারা নিয়ে নেয়। এসব ঘটনা বাহিরে জানানো বন্ধ করার জন্য জীবননাশের হুমকি দিয়ে যায়। তার মোবাইল থেকে ব্যক্তিগত কিছু তথ্য তারা হাতিয়ে নেয় এবং নিজেদের সব তথ্য ডিলেট করে দেয়। এই হুমকিও দেয় ব্যপারটা আদালতে গেলে উল্টো তাকেই শাস্তি পেতে হবে আর তারা ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং আদালতে হাত আছে বলেও জানিয়ে দিয়ে যায়।
৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্যাতনঃ গতবছর নাবিল সামছ নামে একজন সমকামী যুবক একটি ইউটিউব ভিডিওতে নিজের সমকামী যৌন প্রবৃত্তির কথা খোলাখুলিভাবে স্বীকার করেন।( ভিডিওটি দেখুন এখানে ) । আর এই ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাকে বহিষ্কার করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয় রুপান্তরকামীরা। সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রথম জীবনেই স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ে।
৬. রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্যাতনঃ রাষ্ট্র সমস্থ্য নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যে কোন সমস্যায় আইনের আশ্রয় গ্রহণ ও সমতা লাভের অধিকার আছে প্রতিটি মানুষের। বাংলাদেশে এই অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়েছে যৌনসংখ্যালঘুরা। সঠিক বিচার প্রত্যাশা করা তো দূরের কথা বরং বিচার চাইতে গেলে পড়তে হবে ৩৭৭ ধারার যাতাকলে। ২০১৬ সালে আদালত কর্তৃক নির্যাতিত হয় খাদেজা ( ছদ্মনাম) নামের একজন লেসবিয়ান নারী। আরেকজন নারীকে ভালবাসার অপরাধে তাকে জেলও খাটতে হয়। এ নিয়ে BBC BANGLA তে একটি খবরও প্রকাশিত হয়। ( এখানে দেখুন )
৭. নিরাত্তাহীনতাঃ যৌনসংখ্যালঘুদের অধিকার ও ন্যায্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করতে গিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য বার জীবন নাশের হুকমীর সম্মুখীন হন বলে জানান নীলয় নীল (ছদ্মনাম) নামের একজন LGBT অধিকার কর্মী। তিনি জানান বাংলাদেশে পরিবার,সমাজ,রাষ্ট্র ও জঙ্গি গোষ্ঠির কাছে সব সময় নিজেকে অনিরাপদ বোধ করি।
বাংলাদেশে গোপনে এ রকম অসংখ্যা নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলে। এসব নির্যাতনের নেই কোন প্রতিকার ব্যবস্থা। যার ফলে দিন দিন সমকামীদের জীবন উঠেছে দুর্বিষহ। এসব নির্যাতনের প্রতিকারের আশায় দিন গুনছে বাংলাদেশী সমকামীরা।