আমি আমিষ খাই না। এটা কোন সমস্যা নয়। কিন্তু যারা আমিষ খায় তাদের ব্যপারে যদি বলি “ছিঃ ছিঃ এরা প্রাণি হয়ে প্রাণির মাংস ভক্ষণ করছে, এদের হত্যা করা উচিৎ” এবং চাপাতি নিয়ে হত্যা করার জন্য তেড়ে আসি। তখনই সেটা সমস্যা হয়ে দাড়ায়।
শুধু সমস্যাই নয় তখন হয়ত আপনারা রোগী হিসেবে আমাকে মানসিক ডাক্টারের কাছে পাঠাবেন। হ্যা, সমাজের মঙ্গলের জন্য পাঠানোও উচিৎ। নিজেদের অজান্তে এ রকম রোগী কিন্তু আপনাদের অনেকেই। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছি। যৌনতার দিক থেকে আপনি বিসমকামী। বিসমকামী হওয়ার কারণে সমলিঙ্গের কারও সাথে ভালবাসা এবং প্রণয়ের কথা চিন্তাও করতে পারেন না। সমকামিতার কথা ভাবলেই আপনার অরুচি লাগে। হ্যা, লাগাটাই স্বাভাবিক এবং অন্যায় কিছু না।
কিন্তু নিরামিষভোজী হওয়ার কারণে আমিষভোজীদের হত্যা করতে যাওয়া আমার যেমন অন্যায় তেমনি বিসমকামী হওয়ার কারণে সমকামীদের হত্যা এবং ঘৃণা ছড়ানো আপনারও অন্যায়। হয়ত বলবেন আপনার ধর্মে পাপ। হ্যা, আমিও স্বীকার করছি আপনার ধর্মে পাপ। আপনি ধর্মের বিধান মেনে সমকামিতা থেকে দূরে থাকতেই পারেন সেটা আপনার নিজস্ব ব্যপার। কিন্তু আপনি পছন্দ করেন না কিংবা আপনার ধর্মে পাপ বলে অন্য কাউকে পছন্দ করতে দেবেন না, এটা কেমন যুক্তি?
হ্যা, কেউ যদি আপনাকে সমকামিতা করতে বাধ্য করে তখন তার বিরুদ্ধে বলাটা আপনার জন্য যৌক্তিক। কিন্তু কার বিছানায় কে কাকে সঙ্গি করেছে সেটা খুঁজে খুঁজে হত্যা করতে তেড়ে যাওয়া আর আমার আমিষভোজীদের প্রতি তেড়ে যায় মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি? আমিষভোজীরা যেমন আমার কোন ক্ষতি করে নি তেমনি সমকামীরাও আপনার কোন ক্ষতি করে নি। ভেবে দেখুন তো, সমকামীরা কি কখনও বিসমকামীদের সমকামী হয়ে যেতে বলেছে? বিসমকামীদের যৌনতায় বাধা দিয়েছে? আপনাদের চোখের সামনে যৌন কার্য করতেছে? খোলা জায়গায় রাস্তা-ঘাটে যৌন কার্য করতেছে? না, এ রকম কিছুই করে নি।
এ রকম কিছুর উপযুক্ত প্রমাণ দেখাতে পারবেন না। তাহলে কি শুধু ধর্মই একমাত্র বিদ্বেষের কারণ? না, তবে এটা ঠিক যে বিদ্বেষ ছড়ানোর পিছনে ধর্মগুলোরও বিশেষ অবদান আছে। কিন্তু ধর্মগুলোই একমাত্র কারণ নয়। আমরা যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষপট দেখি তাহলে দেখব এখানে প্রতি বছর হিন্দুদের জাঁকজমক পূজার আয়োজন হয়। মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী পুজা পাপ। কিন্তু যতটা বিদ্বেষ পূজার ক্ষেত্রে দেখা যায় তার চেয়ে হাজার হাজার গুণ বেশি বিদ্বেষ সমকামীদের প্রতি।
আবার অনেক স্যেকুলার বামপন্থি রাজনৈতিক গোষ্ঠিকেও সমকামীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে দেখা যায়। তারা কি এই আশঙ্কায় ভোগে যে সমকামীদের বৈধতা দিলে পৃথিবী জনশূন্য হয়ে পড়বে? কিন্তু এটা তো একেবারে যুক্তিহীন দাবি। কারণ পৃথিবীতে জনসংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে আর ১০% সমকামী যদি বাচ্চা জন্মদান প্রক্রিয়া বন্ধ করে তাহলে বাকি ৯০% বিসমকামীও কি বাচ্চা জন্মদান প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেবে? তারাও কি সবাই সমকামী হয়ে যাবে? যদি তা না হয় তাহলে পৃথিবী জনশূন্য হওয়ার আশঙ্কার মতো অযৌক্তিক দাবি উত্থাপন হয় কি করে? আসলে সমকামীদের অপরাধী চিহ্নিত করার পিছনে যৌক্তিক কোন দাবিই নাই। তবুও মানুষ কেন সমকামী বিদ্বেষী এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি বিজ্ঞান থেকে। আসুন দেখে নেই হোমোফোবিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞান কি বলেঃ-
‘ফোবিয়া’ শব্দটির এসেছে গ্রিক থেকে। যার অর্থ কোন কিছুর প্রতি অযৌক্তিক ভীতি।
১৯৬০ সালে মার্কিন মনোবিজ্ঞানী জর্জ ওয়েইনবার্গ প্রথম ‘হোমোফোবিয়া’ শব্দটি তৈরি করেন।
তিনি তার সোসাইটি অ্যান্ড দ্যা হেলদি হোমোসেক্সুয়াল বইয়ে লিখেছিলেন, “কোন রোগীকে আমি সুস্থ মনে করবো না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি সমকামীদের প্রতি তার বিদ্বেষ কাটিয়ে উঠতে পারবেন।”
ইতালির রোমে এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেডিকেল সেক্সোলজির একজন অধ্যাপক ইমানুয়েল এ জানিনি।
তিনি হোমোফোবিয়াকে মানসিক অসুখ বলে বর্ণনা করেছেন।
২০১৫ সালে জার্নাল অফ সেক্সুয়াল মেডিসিনে এই বিষয়ে তার একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়।
বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি হোমোফোবিকদের ‘দুর্বল-চিত্তের ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
তিনি তার গবেষণায় হোমোফোবিয়াকে সাইকোসিটিসিজমের সাথে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করেছেন।
সাইকোসিটিসিজমের সাথে রাগ ও আগ্রাসী মনোভাবের সম্পর্ক রয়েছে। হোমোফোবিয়াকে তিনি অবচেতন নিরাপত্তা-হীনতার সাথেও সম্পর্কিত বলে মনে করেন।
অধ্যাপক জানিনি তার গবেষণায় হোমোফোবিয়ার মাত্রা মাপার চেষ্টা করেছেন। সেজন্য তিনি ৫৫১ টি ইতালিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর জরিপ চালিয়েছেন। এরপর অন্য ধরনের মানসিক রোগের সাথে তার একটি তুলনা করেছেন। তার মতে যে ব্যক্তির মধ্যে হোমোফোবিয়া বা সমকামিতায় যত বেশি ঘৃণা তার মধ্যে সাইকোসিটিসিজমের মাত্রাও বেশি। তিনি মনে করেন হোমোফোবিয়া একটি মানসিক ব্যাপার যা থেরাপির মাধ্যমে নিরাময় করা সম্ভব।
এবার আধুনীক বিজ্ঞানে দেখে নেই সমকামিতা নিয়ে বিজ্ঞান কি বলেঃ-
১৯৭০-র পর থেকে, বিশ্বজুড়ে বহু স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং আচরণগত-সমাজবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ সমকামিতাকে মানব যৌন অভিমুখীতার একটি স্বাস্থ্যকর প্রকরণ হিসেবেই দেখেন। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে অস্ট্রেলীয়া ও নিউজিল্যান্ডের মনোরোগ সংস্থা সমকামিতাকে অসুস্থতার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেয়। এর কিছু মাস পরে মার্কিন মনোচিকিৎসক সমিতি মানসিক অসুস্থতা হিসেবে সমকামিতার সংজ্ঞাকে বাতিল করে।
মার্কিন মনোচিকিৎসক সমিতির প্রতিনিধি কাউন্সিল ১৯৭৫ সালে এবং এরপর অন্যান্য স্বাস্থ্য ও মনস্তত্ব বিষয়ক বৃহত্তর সংস্থাগুলো উক্ত নতুন সংজ্ঞা অনুসরণ শুরু করে, যার মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯০ সালে মানসিক বিকৃতির তালিকা থেকে সমকামিতাকে বাতিল করে দেয়।
বর্তমান বিশেষজ্ঞদের মতে, সমকামিতা কোন মানসিক ব্যাধি নয়। কয়েক দশক ধরে গবেষণা ও ক্লিনিকের অভিজ্ঞতার ফলে প্রধান প্রধান স্বাস্থ্য ও মনোস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, এসব প্রবৃত্তি মানুষদের স্বাভাবিক যৌনতার একটি ভিন্ন প্রকরণ মাত্র। নারী ও পুরুষের মধ্যেকার সম্পর্কের মতোই সমলিঙ্গীয় সম্পর্কও স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর।
পরিশেষে বলব যারা উন্নত চিকিৎসা সেবা নিতে ইউরোপ,আমেরিকার পথ ধরেন কিন্তু সমকামিতার ইস্যু নিয়ে ওসব দেশের বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণাকেই অস্বীকার করেন তারা হোমোফোবিয়া রোগে আক্রন্ত এবং তাদের চিকিৎসা প্রয়োজন ।