ধ্যানঃ ধর্ম ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে

 

 

 

এই প্রবন্ধের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের মতামত গুলো অনুবাদ করেছেন শ্রদ্ধেয় কাজী রহমান। শুরুতেই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

ধ্যান এ আবার কি? এটা কি কোন চর্চার বিষয় হল! শুধু শুধু চোখ বুঝে সময় নষ্ট তার চেয়ে বরং এদিক ওদিক উকিঝুকি মারাই শ্রেয়! যারা এত দিন ধ্যানের কথা শুনেই অবজ্ঞা ভরে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলতেন তাদের জন্য খারাপ সংবাদ দিচ্ছেন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান।

নব নব আবিষ্কার ও নতুনত্বের সন্ধানে মত্ত থাকা পশ্চিমাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে বিশেষ করে মনোজাগতিক চিকিৎসা শাস্ত্রকে আরো সহজ, সুলভ, গ্রহণ যোগ্য উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সেই পশ্চিমা চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের আগ্রহ এখন প্রাচীণ ভারতের সাধু, সন্ন্যাসি, মুনি, ঋষি চর্চিত আচার ধ্যান সাধনায়। যাকে বৌদ্ধদের পরিভাষায় ভাবনা, হিন্দু পুরাণে তপস্যা, ইসলামে বলে তাফাক্কুর। যদিও ভাবনা, তপস্যা ও তাফাক্কুরে উদ্দেশ্য ও আচরিত পদ্ধতিতে স্থূল পার্থক্য দেখা যায়। তারপরেও ইংরেজীতে সবগুলোকে এক কথায় বলা হয় মেডিটেশন(Meditation)।

মানুষের দেহ মন জুড়ে এই প্রাচীণ ধ্যানবিদ্যার কার্যত কোন প্রশান্তির ছায়া পড়ে কি? নাকি তা শুধু কেবল দার্শনিক তত্ত্বে আজো সীমাবদ্ধ? এই সব জটিল তত্ত্বের নির্মোহ সত্যতা যাচাইয়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি কাজে লাগিয়ে ধ্যান নিয়ে শুরু হয়েছে নানা কৌশলগত পরীক্ষা নিরীক্ষা ও প্রায়োগিক গবেষণা। ইতিমধ্যে ইতিবাচক কিছু চমকপ্রদ ফলাফলও আগ্রহ বাড়িয়েছে গবেষকদের। উৎসাহি বিশেষজ্ঞরা তা কাজে লাগিয়ে আরো অনেক দূর এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানকে।

তার আগে জেনে নিই ধ্যান কি ও কেন?

সংস্কৃত ‘ধ্যৈ’ ধাতু থেকে ধ্যান শব্দটির জন্ম। ‘ধ্যৈ’ ধাতুর অর্থ ‘চিন্তা করা’, অর্থাৎ বিক্ষিপ্ত মনটাকে কোন একটি বিষয় বা বস্তুকে অবলম্বন করে সেই বিষয় বা বস্তুর প্রতি মনকে স্থির রেখে যাবতিয় চিন্তা শুন্য করার নামই ধ্যান। শুরুর দিকে ধ্যানের উদ্দেশ্য ভিন্ন থাকলেও বর্তমানে ধ্যানের মূল উদ্দেশ্য মন তথা মস্তিষ্কের এলোমেলো চিন্তা, বিক্ষিপ্ত ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করে মনকে স্থিতিশীল রেখে মনকে অনাবিল এক প্রশান্তির মাঝে ডুবিয়ে রাখা। আমাদের স্বপ্ন বিলাসী, কামুক, রহস্যে ঘেরা অবুজ মনটা নিজের হলেও তাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা যারপরনাই ব্যর্থ। মনে আবদ্ধ থাকে নানা কিসিমের চাহিদার বেড়া জালে। চাহিদা মিটাতে না পারলে বাড়ে দুঃখ, আসে হতাশা। আবার এক চাহিদা পূর্ণ হলে উৎপন্ন হয় আরেক চাহিদা। স্বেচ্ছাচারী মনের এই চাহিদা ও যত্রতত্র ছুটে চলা সবটাই ঘটে বিশেষ করে চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও স্পর্শের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনভাবে। নিয়ত হাজার রকম চিন্তার উদয় বিলয়ের লক্ষ্যহীন প্রতিযোগিতা চলে আমাদের নিরেট মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে। চিন্তার তড়িৎ উৎপত্তি বিলয়ের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় সংঘর্ষে মন সর্বদাই অস্থির হয়ে উঠে। এই অস্থির মনটাকে বাগে আনতেই আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে “তন্ত্র” সাধনাকে ভিত্তি করে প্রাচীণ শিক্ষা, সভ্যতা, ঐতিহ্য, দর্শনশাস্ত্র সমৃদ্ধ ভারতবর্ষে আবিষ্কৃত হয়েছে বিভিন্ন ধ্যান পদ্ধতির। পদ্ধতিগুলোর সংষ্করিত একটি রূপ উদ্দেশ্যগত সফলতার আলোকে বহিঃবিশ্বে পেয়েছে ব্যাপক জন সমর্থন।

এক কথায় ধ্যান বলা হলেও তপস্যা, তাফাক্কুর ও ভাবনা এক জিনিস নয়। তাদের মধ্যে উদ্দেশ্য ও বিশ্বাসে আছে যোজন ফারাক। সংক্ষেপে দেখা যাক ধ্যান বিষয়ে শাস্ত্রীয় মতগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য।

হিন্দু ধর্মে তপস্যা বা ধ্যানঃ

বর্তমান হিন্দু ধর্ম বৈদিক যুগের ব্যাপক সংষ্কারের ফসল। প্রাচীণ বেদ, পুরাণ, মহাভারত, উপনিষদে তপস্যার যে বর্ণনা আমরা পাই সেখান থেকে সরে এসে বর্তমানে ধ্যানের উদ্দেশ্য ও সংজ্ঞা অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে নবরূপ লাভ করেছে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। প্রাচীণ হিন্দু শাস্ত্রে তপস্যার প্রচুর পৌরনিক কাহিনিতে পূর্ণ, যাতে প্রতিফলিত হয়েছে সে যুগের মানুষের বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। তপস্যা বা ধ্যানের যে উদ্দেশ্য আমরা সেখানে দেখি তা মূলত করা হত কঠোর কৃচ্ছতা সাধন করে দেবতাদের তুষ্ট করে বর লাভের আশায়। এই কিছুকাল আগেও অনেক কালী সাধক ও শিব সাধককে ইতিহাসে পেয়েছি যারা দৈব জ্ঞানলাভ, কালী বা শিবের নৈকট্য লাভের আশায় ধ্যান করতেন।

এখন দিন পাল্টেছে। বিশ্বাসে এসেছে পরিবর্তন। দেবতার বরে মানুষের আর আস্থা নেই। পুরানো বিশ্বাসের রং পাল্টে হিন্দু শাস্ত্রকে আধুনিক বিশ্বাসের সাথে তাল মেলাতেই নতুন দাবি তোলা হয়েছে, ধ্যানের মাধ্যমে একটি বিশুদ্ধ আত্মার সন্ধান পেতে পারে নিজের মাঝেই। ভগবতগীতায় ধ্যানের ওপর আছে বিশেষ অধ্যায়। আর পতাঞ্জলির সময় থেকে যোগসাধনায় যুক্ত হয়েছে ধ্যান। যার পরিণতি সমাধির স্তরে।

ইসলামে তাফাক্কুর বা ধ্যানঃ

ইসলামী বিশ্বাস মতে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, ধন সম্পদ ইত্যাদি প্রদানের মালিক আল্লা। মানুষের জীবনকে দুঃখ কষ্টের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত করে আল্লাভক্তির পরীক্ষা নেওয়া তার জটিল পরিকল্পনার অংশ মাত্র। সত্যিকার ইসলাম পালনকারীদের কার্য্যতঃ ধ্যান চর্চার কোন প্রয়োজন নেই। স্রষ্টা ও নবী মুহাম্মদের উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা রাখাই ইসলামের মূলভিত্তি।

ইসলাম আর্বিভাবের পর ইসলামী শাসকদের পররাজ্য দখলে নেওয়ার তীব্র ইচ্ছার ফলশ্রুতিতে সুফিবাদ নামে এক আধ্যাত্মিক দর্শন সন্তপর্ণে ইসলামে জায়গা করে নেয় সেখানকার সংস্কৃতির ছায়া ব্যাবহার করে। যেখানে ফকির, আউলিয়া, পীর, দরবেশ বলে কথিত ভিন্ন মনন সম্পন্ন কিছু ধার্মিক ব্যক্তির অনুপ্রবেশ ঘটার সুযোগ হয়। যদ্দুর শোনা যায় তাঁরা ধ্যান চর্চা করতেন। ধ্যানের মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধির করে স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মুলকথা। স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বিরাজমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যামে উপলব্ধি করাকেই সূফী দর্শন বা সূফীবাদ বলে। ইসলামী পন্ডিত ইমাম গাজ্জালী সূফীবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে – “আল্লাহর ব্যাতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে প্রবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ন রূপে আল্লাহুতে নিমগ্ন হওয়ার নামই সূফীবাদ”।

ইসলামে ধ্যানের ভাব, ঈশারা, ভাষা, উদ্দেশ্য সব আল্লাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। চিন্তার সীমারেখায় আল্লাকে কল্পনা, আল্লার গুনগান, তাঁর সৃষ্টির মহীমা নিয়ে চিন্তা, আল্লার জিকির করা ইত্যাদি ঈশ্বর বিষয়ক চিন্তার মধ্যেই ধ্যান সীমাবদ্ধ। অন্য বিষয় বা উদ্দেশ্যে অবলম্বনে ধ্যান ইসলামে একেবারেই অপাঙতেয়

বৌদ্ধ দর্শনে ভাবনা বা ধ্যান:

সব ধর্মের একমাত্র লক্ষ্য যেখানে কোন দেবতা বা ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ বা পরমাত্মা লাভের চেষ্টা, ঈশ্বরকে পাশ কাটিয়ে বৌদ্ধদের চরম লক্ষ্য সেখানে নির্বান। বুদ্ধ মানব মনকে কেন্দ্র করেই তাঁর ধর্ম দ্বার উন্মোচন করেছিলেন। বুদ্ধের মতে প্রত্যেকের জীবনে দুঃখ আছে, দুঃখ নিবারণের বা নির্বাপনের পথও আছে। বুদ্ধের মতে এই অশান্ত, চঞ্চল, লোভ, দ্বেষ, হিংসা, জটিলতা, কুটিলতা, ভালোবাসা, আবেগ, ভয়, শংকা, ঘৃণায় পরিপূর্ণ মনটাকে যদি কৌশলে বশীভূত করা যায় তবেই দুঃখ মুক্তি সম্ভব অর্থাৎ নির্বান লাভ সম্ভব। যে কৌশলের ছত্রছায়ায় দুঃখকে পরাজিত করা যাবে তার নাম ভাবনা বা ধ্যান। বৌদ্ধ ধর্মে ভাবনা দুই প্র্রকারঃ- সমথ ভাবনা ও বিদর্শন ভাবনা।

সমথ ভাবনা হল কোন বস্তু বা বিষয়কে অবলম্বন করে স্বল্প সময়ের জন্য বা খন্ডকালীন ধ্যান।

বিদর্শন কথার অর্থ বিশেষ উপায়ে দর্শন। বির্শন ভাবনা হল নিজ শরীরের যে কোন বিষয়কে অবলম্বন করে সেই বিষয়ের উপর মনকে আশ্রিত করে দীর্ঘ সময় ধরে গভীর ধ্যান। ধ্যানীর একাগ্রতার উপর নির্ভর করে কয়েক দিন থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত বিদর্শন ভাবনার আয়ুষ্কাল হতে পারে।

বৌদ্ধ মতে ভাবনার মাধ্যমে মনকে এমন এক উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব যেখানে সুখে দুঃখে মন আর দোলায়িত হবে না। মন স্থির নিশ্চল থাকবে। এ অবস্থায় মনে সর্বদা প্রশান্তির ছোঁয়া বিরাজ করে।

বর্তমানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে “সিলভা মেথড”, “কোয়ান্টাম মেথড”, “আর্ট অফ লিভিং”, “যোগাসন”, “প্রাণায়ন” ইত্যাদি আকর্ষনীয় নামের ধ্যান পদ্ধতির পেছনে মানুষ যে হারে অর্থ ও সময় ব্যয় করছে তার একমাত্র কারণ অস্থির উত্তপ্ত চিত্তকে প্রশান্ত করতে মনে একটু শান্তির কোমল বর্ষণের চেষ্টা। মানুষ তার মস্তিষ্কের এলোমেলো চিন্তা রাজ্যে ঝড় নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে জীবনকে স্থিতিশীল, সুশৃঙ্খল ও প্রশান্তিময় করার যে প্রয়াস চালাচ্ছে আজ, তা বুদ্ধের সৌম্য কান্ত ধ্যান মূর্তির প্রচ্ছন্ন প্রভাবে সৃষ্ট তা স্বীকার করলে সম্ভবত অসত্য বলা হবে না।

এই প্রভাবের একটি ঢেউ ভারত বর্ষের সীমানা পেরিয়ে তিব্বত, চায়না, জাপান ঘুরে পশ্চিমা বিশ্বে আছড়ে পড়েছে অন্যদিকে আরেকটি ঢেউ আফগানিস্তানের সিল্ক রোডের উপর দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে ইরান, ইরাকে।

ষাট সত্তুর দশকে মেডিটেশন বা ধ্যান চর্চায় বিশ্বজুড়ে যে নতুন আগ্রহের সূ্চনা হয় তাতে বুদ্ধের দুঃখ মুক্তি দর্শনের প্রভাবকে খাটো করে দেখার কোন উপায় নেই। দেহ ও মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে টিএম, বা ট্রান্সেনডেন্টাল মেডিটেশন, সহজ যোগ, নেচারাল স্ট্রেস রিলিফ, ফাইভ রিদম, থিটা হিলিং, সিলভা মেথড, ডা. হার্বার্ট বেনসনের রিলাক্সেশন রেসপন্স, ডা. কাবাত জিনের মাইন্ডফুলনেস বা মনোনিবেশায়ন ইত্যাদি আধুনিক নামের যে ধ্যান পদ্ধতির কথা আলোচনার টেবিলে উঠে আসুক না কেন, সব বৌদ্ধ দর্শনের বিশ্বব্যাপী পরিচিতির আলোকেই গতিশীলতা পেয়েছে এ সত্যকে মনে হয় লুকানো যাবেনা।

আড়াই হাজার বছর পূর্বে ধ্যানকে আশ্রিত করে বুদ্ধের আত্ম উপলব্ধি দুঃখ মুক্তির ভাবনা দর্শন শুধু কি তত্ত্ব কথায় সীমাবদ্ধ? এটা কি শুধুই মিথ হয়ে কাগজের মোড়কে আজো টিকে আছে? একে বাস্তবে রূপ দেওয়া আদৌ কি সম্ভব? হাজার বছর ধরে প্রতিধ্বনিত হওয়া এই বিশ্বাসের সত্যতা যাচাইয়ে আমেরিকা, বৃটেন, কানাডার চৌকস, অনিসন্ধিৎসু গবেষক, বিজ্ঞানীরা ধ্যানকে টেনে হাজির করালেন আধুনিক পরীক্ষাগারে। প্রাপ্ত ফলাফল দেখে তাঁরা নিজেরাই আজ বিস্মিত, তাঁরা হতবাক। তাঁরা দেখলেন মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নানা রোগ প্রতিরোধে নিয়মিত ধ্যানচর্চার কার্যকরি ভূমিকার সুফল তাঁদের গবেষণার জালে ক্রমেই ফেঁসে যাচ্ছে।

বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় মিডিয়া বিবিসির প্রচারিত একটি ডকুমেন্টারি হতে জানা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একদল স্নায়ুবিজ্ঞানী তিব্বতের ধ্যান চর্চা করেন এমন কিছু বৌদ্ধভিক্ষুর মস্তিষ্ক স্ক্যান করে ধ্যানে তাঁদের মন বা মস্তিষ্কে পরিবর্তন সম্পর্কে নিশ্চিত হন। গবেষকরা ওই সব ভিক্ষুকে একটি এফএমআরআই নামক একটি যন্ত্রের ভেতর বসিয়ে ধ্যান করান। ধ্যানের ফলে তাঁদের মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে কি ধরনের পরিবর্তন আসে তা একটি স্ক্যান যন্ত্রের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করে ওই ভিক্ষুদের মস্তিষ্কের স্তরগুলোতে একধরনের পরিবর্তন তাঁরা লক্ষ্য করেন।

এ প্রসঙ্গে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষকদলের বিজ্ঞানী জোরান জোসিপভিক জানান-

তিনি আশা করেছিলেন যে তিনি এটা ধরতে পারবেন যে কিভাবে কিছু কিছু তপস্বী বা ধ্যানী তার চারপাশের চেতনাকে একাকার করে ফেলে ইহজাগতিক বিষয়ে অদ্বৈত বা একাত্মময় পর্যায়ে পৌঁছে যায়।

তিনি আরো বলেন- “ধ্যান নিয়ে একথা বলা যায় যে যারা প্রচুর ধ্যানচর্চা করে, তাদের ভেতর ধ্যানের মাধ্যমে মনোযোগ দক্ষতার চাষ হয়। ডঃ জোসিপভিক বলেন, আয়ত্বে আনা সেই দক্ষতা দিয়ে তারা তাদের জীবনকে প্রশান্ত ও সুখময় হতে সাহায্য করতে পারে”।

গত দশ বছর ধ্যান বিষয়ক গবেষণা বেশ সন্তোষজনক মনে হয়েছে, দেখা গেছে যে মস্তিকের কর্মক্ষমতা বাড়াতে এটা আসলেই সক্ষম, এটা যে সম্ভব তা ইতিপূর্বে আমাদের জানাই ছিল না।

বিবিসির এই অত্যন্ত আকর্ষনীয় ও কৌতুহল উদ্দীপক ডকুমেন্টরিটি কেউ আগ্রহী হলে দেখতে পারেন এখান থেকে

আমাদের দৈনন্দিন জীবণে বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা করা মিডিয়া Science Daily এর সূত্র থেকে জানা যায় যুক্তরাজ্যের ইউনির্ভারসিটি স্কুল অব ট্রান্সলেশন মেডিসিন এর গবেষক ড: ব্রাউনের ধ্যান বিষয়ে এক গবেষণায় সিদ্ধান্ত পৌঁছেন ধ্যান ব্যাথা উপশমে সাহায্য করে।

তিনি বলেন-

“গবেষণার ফলাফলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ধ্যান মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। ধ্যান মস্তিস্ককে শুধুমাত্র বর্তমান নিয়ে ভাবায় তাই ওটা না বাচক আন্দাজি ভবিষ্যৎ ঘটনার কথা ভেবে সময় নষ্ট করে না। সম্ভবত এই জন্যই অবসাদের কারণে ঘটা সেই দীর্ঘস্থায়ী ব্যাথা উপশমে; ধ্যান কার্যকরী ভূমিকা রাখে”।

তিনি আরো বলেন-“ যদিও আমরা দেখেছি, তপস্বীরা বা ধ্যানীরা ব্যাথার কথা কমই ভাবে আর সেটাকে ততটা বেদনাদায়কও মনে করেনা, তবুও আমাদের কাছে এটা খুব একটা পরিষ্কার না যে ধ্যান কিভাবে ধীরে ধীরে মস্তিকের কর্মপদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে করে এই ব্যাপারটা ঘটায়”।

“যাহোক, দুরারোগ্য এই ব্যাথার জন্য নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি যে অতি গুরুত্বপূর্ণ সেই ব্যাপারটা পরিষ্কার। ব্যাথা বেদনায় ভোগা শতকরা ৪০ ভাগ মানুষই বলেন যে তাদের বেদনার উপশম ব্যাবস্থা অপ্রতুল”।

এছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন গবেষকদের পরিচালিত আরো বেশ কিছু গবেষণার ফলাফলে প্রমাণ পাওয়া গেছে মানসিক সুস্থিরতা নিশ্চয়তার মাধ্যমে ধ্যান রক্তচাপ, হৃদ রোগের ঝুঁকি, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি হ্রাস করতে কার্যকরি ভূমিকা রাখে।

ধ্যান নিয়ে এত সুফল এত নিশ্চয়তা প্রাপ্তির ঘোরে ধ্যান অভ্যাস কারীদের ভুলে গেলে চলবে না ধ্যান কখনো ঔষুধের বিকল্প নয়। তবে নিয়মিত ধ্যান চর্চা আমাদের শরীরকে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত রোগ যন্ত্রণার প্রকোপ থেকে রক্ষা করে সেই সাথে মানসিক স্তরকে সবল করে যা মনকে প্রশান্ত করে, আমাদের অধিক মনোযোগী হতে সাহায্য করে, সেটা আজ বৈজ্ঞানিক সত্য। বিষয়টা এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- নিয়মিত শরীরচর্চায় যেমন আমারা হাত, পা, বুকের পেশী বাড়িয়ে শরীরের বাহ্যিক অঙ্গগুলোকে শক্তিশালী, দৃঢ়, মজবুত, পেটা করে শরীরের কাঠামোকে আমূল বদলিয়ে নিয়ে আকর্ষনীয়, ফিট ও রোগমুক্ত করতে পারি, তেমনি নিয়মিত ধ্যান চর্চা করে অনুরূপ মস্তিষ্কের আভ্যন্তরিন শক্তিকে বাড়িয়ে ফিট ও মজবুত করতে পারি যা মনকে প্রশান্ত ও রোগ প্রতিরোধে বিশেষ সহায়তা করে।

ধ্যান চর্চা এখন আর সীমাবদ্ধ নেই শুধু হিমালয়ের খাঁজে, পাহাড়ের গুহায়, নির্জন অরণ্যে, বট বৃক্ষের ছায়ায় বা সুনসান শ্মশান ঘাটের জীর্ণশীর্ণ কঙ্কালসার সাধু সন্ন্যাসী বা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছে। ধ্যানকে হাসপাতাল ঘুরিয়ে ধরে আনা হয়েছে এখন আধুনিক জেলখানায়। লক্ষ্য কারারুদ্ধ নয়, লক্ষ্য লোহার গারদে বাস করা অপরাধীগুলোর মনে ঘাপটি মারা অন্ধকার প্রবণতাগুলো দূর করে তাদেরকে সত্য সুন্দর আলোর ঝলমলে পথে নিয়ে আসা। আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, ভারত এই কাতারে তো রয়েছে সম্প্রতি বৃটেনেও পরীক্ষামূলক ভাবে চালু করেছে অপরাধীদের ধ্যান প্রশিক্ষণ। ধ্যান নিয়ে বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রায় দারিদ্রের অজুহাতে বাংলাদেশও পিছিয়ে থাকতে রাজি নয় আর।