সিনেমাটি দেখলাম টিভিতে। ফারুকী একটি কুয়ার তলদেশ থেকে নিজের সংকীর্ন চিন্তার আদলে সমাজের অধিকাংশ মানুষের ইমেজ নির্মাণ করে এসেছেন এতোকাল- এবং ওগুলোকেই সমাজের চলমান বাস্তবতা হিসেবে হাজির করেছেন। সেলুলযেডে যে ইমাজিনারি বাস্তবতা হাজির হয় তার প্রায় পুরোটাতেই নির্মাতা নিজে প্রতিফলিত হন-বিশেষত ন্যারেটিভের মধ্যে দিয়ে। বিষয়টা অনেকখানি সেই চোর এবং সাধুর গল্পের মত। একজন রাতভর চুরি এবং আরেকজন ধ্যান সেরে ভোরবেলা স্নান করতে গিয়ে পরস্পরকে দেখেন। চোর ভাবে সাধু তারচেয়েও বড় চোর, সাধু ভাবে চোরটা না জানি কত বড় সাধু। যাহোক, ডুবের ফারুকীও ঠিক আগেকার একই চরিত্রের ফারুকী-সত্যি বলতে কি তিনি আমাকে এতোটুকুও হতাশ করেননি। হতাশ করেছেন ফাহমিদ ভাইসহ আরো দুয়েকজন যাদের বিচারের প্রতি আমি আস্থা রাখি। সরেজমিন সিনেমা দেখে এসে ডুব নিয়ে তাদের পর্যালোচনা আমার আগপাশতলা ফাঁপানো ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। যদিও্ তাদের অবস্থানটা আমি খানিকটা বুঝতে পারি, দেশি সিনেমাকে তারা প্রমোট করতে চাইছেন, মানুষজনকে হলে যেতে উৎসাহিত করছেন। এবং সেটা করতে গিয়ে ডুবন্ত মানুষের মত হাতের কাছে খড়কুটো যা কিছু পাচ্ছেন তাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন।
মানবিক সম্পর্কের সংকট ও টানাপোড়েন নিয়ে অসংখ্য সিনেমা দেখা হযেছে। সর্বশেষ এই ধরণের গল্প নিয়ে ঋতুপর্ন ঘোষের ‘আবহমান’ ছবির কথা মনে পড়ছে। ডুবের গল্পের সাথে আবহমানের গল্পের বেশ মিল রয়েছে। তবে এখানে শেষ পর্যন্ত কোনো গল্প নেই, ওটা হুমায়ুন আহমেদের বায়োগ্রাফি হয়ে উঠেছে- নির্মাতার প্রচেষ্টাই ছিল কেবল সেইটি। সবকিছু প্রায় হুবহু, নুহাশপল্লীর জায়গাতে নয়নতারাও আছে। কিন্তু ইন্টারেস্টিং হচ্ছে, এই সিনেমায় জাবেদ হাসান যেভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন তার সাথে হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর কোনো মিল নেই-কেবল এই জায়গাটিকেই বদলে দেয়া হয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ মারা গিয়েছিলেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে, ৬৬ বছর বয়সে। যখন তিনি মারা যান তখনো জীবনের প্রতি তীব্র আসক্তি ছিল তার- তিনি তার সুন্দরী তরুনী স্ত্রী এবং ছোট ছোট শিশুদের হাত ধরে বাঁচতে চেয়েছেন আরো অনেক বছর। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জীবনের রূপ-রস-গন্ধের প্রতি মোহ ছিল হুমায়ূন আহমেদের। কিন্তু তার চরিত্রের রূপদানকারী জাবেদ হাসানের মৃত্যু একেবারেই অন্যরকম। সম্পর্কের নানান টানাপোড়েন যাকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে দিয়ে জীবনীশক্তি শুষে নিয়েছে- তার মৃত্যুর কারণও এটাই।
প্রশ্ন হচ্ছে, সবকিছু একই থাকলেও মৃত্যুটা বদলে গেলো কেন? এখানে আবারো সেই চোর আর সাধুর প্রসংগ মনে পড়ে। নির্মাতার অন্তর্গত চিন্তাই সিনেমার ন্যারেটিভের গতিপথ বানায়। মানব চরিত্রের বহমানতা এবং বিশাল বিস্তৃত ক্যানভাসের রঙ যার দেখার ক্ষমতা নেই সে যখন ন্যারেটিভ বানায়-তাকে সেই পুরোনো ক্ষুদ্রতার চাষবাষেই ফেরত যেতে হয়। ডুব সিনেমায় এর পুরো কোপটিই পড়েছে পার্নো মিত্র ওরফে নীতুর উপর। এই আখ্যানে তার চরিত্রটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ন কিন্তু চরিত্রটি বিস্তারে নির্মাতার কোনো মনোযোগ ছিল না। তার চরিত্রে কাট কাট ভাবে আইকনিক কিছু ভিলেনত্ব আরোপ করা হয়েছে, ব্যস এটুকুই। ছোটবেলা থেকেই সে খারাপ, ইর্ষাপরায়ন এবং দায়িত্বহীন। অধস্তন লোকদের সাথে তার ব্যবহার কর্কশ- এসব বৈশিষ্ট্যের বাইরে নীতুর চরিত্রের অন্য কোনো দিক আমাদের সামনে আসে না।
আর তাই জাভেদ হাসানের সাথে তার সম্পর্কে আবেগ-অনুভূতি কিছুই আমাদের জানা হয় না। বরং জাভেদ হাসানের মেয়ে ও নীতুর বান্ধবী সাবেরীর বয়ানে আমরা জানতে পারি- এখানে সম্পদের প্রতি লোভটাই আসল, অন্য কিছু নয়। বান্দরবনে জাভেদ হাসান এবং তার স্ত্রী মায়ার কথোপকথনে আমরা ইঙ্গিত পাই যে গতানুগতিক সম্পর্কের একঘেয়েমীতে সে আক্রান্ত, উত্তাল প্রেমের নস্টালজিক দিনগুলোর কথাই তার কেবল মনে হচ্ছে। মায়া তখন তার কাছে জানতে চায়, তার মানে কী এই যে তাদের সম্পর্কের বর্তমান বলে কিছু নেই? এই কথা শুনে জাভেদের মুখশ্রীতে একটা ইল্যুশন আমরা দেখি- কিন্তু ওখানে ওই এবস্ট্র্যাক্ট ইলুশনের আড়ালে কামুকতার গল্পও নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তার কোনো বিস্তার আমরা পরবর্তীতে পাই না। এরপর যাবতীয় ইনস্টিংকটের আধার হয়ে কেবল হাজির হতে থাকে নীতু- জাভেদকে আমরা দেখি ডিফেন্স করতে ব্যস্ত। ভেতরে ভেতরে স্ত্রী সন্তানের সাথে জাভেদের দূরত্ব এবং এক পর্যায়ে বিচ্ছেদ ঘটে। আমরা দেখি জাভেদ নীতুকে বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। কিন্তু এটা দেখানোর আগ পর্যন্ত সাধারণ দর্শকের কাছে স্পষ্ট হয় না যে জাভেদের নীতুর প্রতি কোনো আসক্তি, ভালবাসা বা মোহ আছে- মনে হয়, নীতু জাভেদের অলস টাইম কাটানোর বা সিগারেট শেয়ার করে খাওয়ার সঙ্গী বা বড়জোর একঘেয়ে সংসারজীবনে বৈচিত্র আনার চাটনি- যার সাথে শারিরীক সংসর্গও হতে পারে। অবশ্য নির্মাতা এখানে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন। অধিকাংশ সিকোয়েন্সই যথাযথভাবে স্টাবলিশ করার তাগিদ তার ছিল না, তিনি করেনও নি। কারণ গল্পটাতো দর্শকের জানা। তাই এই সিনেমাতে খাপছাড়াভাবে জাভেদ হাসান আর নীতুর সংসারজীবন চলে আসলেও দর্শক অবাক হয় না। কারণ হুমায়ুন আহমেদ শাওনকে বিয়ে করেছিলেন।
টুকরো টুকরো কযেকটি নান্দনিক দৃশ্য ছাড়া আর পুরো সিনেমাই খাপছাড়া দৃশ্যাবলীর জোড়াতালি। যারা দেশি চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করতে চান, দর্শককে হলে ফেরাতে চান তাদের জন্য এইটা নেহাতই ভুষি মাল, এ দিয়ে হবে না। দর্শকরাও যখাসাধ্য চেষ্টা করছে। আজ সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে স্টার সিনেপ্লেক্সে হলভর্তি দর্শক দেখে আমার সেটাই মনে হলো। এরাও দেশি ছবিকে ভালবাসতে চান, উৎসাহ দিয়ে হলে আসতে চান। আর সেকারণে এরকম একটি ছবি দেখতেও দলে দলে প্রেক্ষাগৃহে আসেন।