বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিচার হয় না।
সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে বলা হচ্ছে যে এ ধরনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও শাস্তি না হওয়ায় পরিকল্পিত হামলা ও নির্যাতন থামছে না।
২০১৩ সালে পাবনার সাথিয়া উপজেলার বনগ্রাম বাজারে ধর্মীয় অবমাননার ভুয়া অভিযোগে অর্ধশত হিন্দু বাড়ীঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
বনগ্রাম বাজারে স্থানীয় ব্যবসায়ী বাবলু সাহার ছেলে রাজীব সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ফেসবুকে ইসলামের কটূক্তি করে পোস্ট দেয়ার। বনগ্রাম হাটের দিনে শত শত লিফলেট বিলিয়ে সাধারণ জনগণকে উত্তেজিত করা হয়।
কিন্তু পরে পুলিশের তদন্তে দেখা যায় রাজীব এরকম কোনো পোস্ট দেয়নি।
অথচ ধর্মীয় অবমাননায় উসকানি পেয়ে সেদিন হাজার হাজার লোকজন সাহাপাড়ায় হামলা করে। এলাকার প্রায় ৩০-৩৫টি হিন্দু বাড়িতে ভাঙচুর এবং বাজারে কেন্দ্রীয় কালী মন্দিরসহ বাবলু সাহার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালায়। বাড়ীতে ভাঙচুর করে পারিবারিক মন্দিরে আগুন দেয় আর প্রতিমা ভাঙচুর করে।
বাড়ীতে হামলা, মন্দির ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আতাইকুলা থানায় মামলা করেছিলেন বাবলু সাহা।
বনগ্রাম বাজারে নিজের দোকানে বসে তিনি বিবিসিকে বলেন, “তিন বছরের উপরে হয়া গেল, কই কিছুই হয় না!ওরা (পুলিশ) বলতিছে যে উপযুক্ত সাক্ষী না হওয়া পর্যন্ত বিচার শেষ হবে না। সাক্ষী কেউ দিতি চায় না বিচারও হয় না।”
মি. সাহা বলেন, সাক্ষী খুঁজলে ভয়ে কেউ নাম বলতে চান না এবং সাক্ষ্যও দিতে চান না।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এলাকায় ওই হামলার সময় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপি জামায়াত এবং সাধারণ মানুষের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে জানা যায়।
স্থানীয় পূজা উদযাপন কমিটির সহসভাপতি সত্যেন্দ্রনাথ সূত্রধর শুরু থেকে এ ঘটনা ও মামলার খোঁজখবর রাখছেন।
তিনি বলেন, মামলার অনেক আসামী জামিনে মুক্ত হয়েছে। মামলা থেকে নাম কাটানোর চাপও আছে বাদীর ওপর।
“দলীয় নেতৃস্থানীয় যারা তাদের নিজেদের ছেলেদেরকে সেভ করিছে, তারাই প্রশাসনের সাথে ধরেন যোগাযোগ করে নরমাল আসামীদের ঢুকায় দিয়ে নরমাল ধারায় কেস দিছে। আমি কেস যতটা বুঝি, ধারা অনুযায়ী আসামীদের তেমন কিছু হবে না।”
পুলিশ জানাচ্ছে, ওই ঘটনায় তিনটি মামলা হয়। পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছে যার চার্জশিট দেয়া হয়েছে।
তবে বসত বাড়ী মন্দিরে হামলা ভাঙচুর মামলায় বাবলু সাহার মামলাটি পুলিশের কাছ থেকে এখন সিআইডি তদন্ত করছে।
পাবনা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন “বাবলু সাহার মামলায় অজ্ঞাত আসামীর সংখ্যা তিন চার হাজার। যেহেতু অনেক লোকের এখানে সংশ্লিষ্টতা তাই যাচাই বাছাই করতে, বিচার বিশ্লেষণ করতে একটু সময় যাচ্ছে”।
“তিন বছর সময়টা একটু বেশি আমাকে বলতেই হয়। তারপরও আমার মনে হয় যাচাই বাছাই করার ক্ষেত্রে একটু সময় নিতেই হয়। নাহলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায় না” বলেন মি: রহমান।
পাবনার সাহাপাড়ার ক্ষতিগ্রস্তরা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে।
তবে ভুক্তভোগীরা মনে করেন সাম্প্রদায়িক হামলার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও দ্রুত বিচার না হলে বাংলাদেশে এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে গত ৫ বছরে বাংলাদেশে ২৮০৩টি হিন্দু বাড়ীঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
অথচ পুলিশের হিসেবে দেখা যায় এই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ২৭৩টি।
২০০১ সাল থেকে এক হাজার তিনশোর বেশি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছে মাইনরিটি ওয়াচ,এবং সংস্থাটির সভাপতি রবীন্দ্র ঘোষ বলছেন, বাংলাদেশে এরকম বহু ঘটনায় মামলাও হয় না।
তিনি বলেছেন, “অনেক সময় আমাদের উপস্থিতিতে মামলা নিচ্ছে। কিন্তু মামলা নেয়ার পর দেখা যাচ্ছে এইটা বছরের পর বছর এফআরটিএ হচ্ছে না চার্জশিটও হচ্ছে না। সেখানে পুলিশের যে গাফিলতি সেটা প্রণিধানযোগ্য”।
মি: ঘোষের মতে “মামলা নিতে গেলে দ্রুত বিচার আদালতে মামলা নেয়া উচিত। বাংলাদেশে এ আইনতো আছে। তো এই সেকশনে মামলা নেয়া হচ্ছে না কেন? এসব ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে এবং পুলিশের পক্ষ থেকে উদাসীনতা আছে”।
বর্তমান আইনে সুষ্ঠু বিচার ও শাস্তি না হওয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে এখন সংখ্যালঘু নিরাপত্তায় আলাদা আইন করারও দাবি তুলেছেন।