স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ক্রমাগত হয়রানি, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন জাতিসত্তা, ভাষা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সরকার বা প্রশাসনের ব্যার্থতার কারণেই সম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে। সহিংসতা এবং বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা ঠেকাতে প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ কম নয়।
সরকার এবং প্রশাসন কঠোর অবস্থান না নেয়ায় হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতায় বাড়ছে। হামলার আগে তা প্রতিরোধে সরকার বা প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দল, কারও কোন ভূমিকা নাই।
যদিও আওয়ামী লীগ সরকারকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ বান্ধব বলে মনে করা হয়। কিন্তু এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে হোক আর যেকারণেই হোক হামলার আগে তা প্রতিরোধে সরকার বা প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দল কারও কোন ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায় না।
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিপীড়নের অভিযোগ নতুন করে সামনে এসেছে। এর আগেও কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, কুমিল্লার মুরাদনগর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, ঢাকার মিরপুরে বিহারিদের ওপর, পাবনার সাঁথিয়া, রংপুরের গঙ্গাচড়া, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা দেশে-বিদেশে বেশ আলোচিত হয়েছিল।
সাধারণভাবে এসব নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনায় বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন ও দলগুলোকে দায়ী করা হয়েছিল। আবার অনেকেই মনে করে থাকেন, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি যতটা না ধর্মীয়, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক।
মূলত ক্ষমতাসীনরা সংখ্যালঘুদের জমি-জমা দখল নিতে ও নিজেদের অপরিহার্যতা প্রমাণের কৌশলের অংশ হিসেবেই নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক রূপ দেয়। আর এসব কারণেই যেকোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও রাজনীতি হয় কিন্তু ঝুলে থাকে এর বিচার। নেপথ্যে ক্ষমতাসীনরা জড়িত থাকায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা যায় না বলেও অভিযোগ আছে। প্রায় প্রতিবছরই ঘটে যাওয়া এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সবগুলোর পেছনেই মূলত সম্পদ দখলের রাজনীতি। নতুন ইস্যুতে পুরনো ঘটনা চাপা পড়া ও রাষ্ট্র নিশ্চুপ থাকায় হামলাকারীরাও প্রশ্রয় পায়।
২০২০ সালের উপাত্ত দিয়ে বছর শেষে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, তা সত্যিই উদ্বেগের। সংগঠনগুলোর দাবি, বিদায়ী বছরে সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৪৯ জনকে হত্যা করা হয়। এছাড়া ২৪৪টি পরিবার ও মন্দিরে লুটের অভিযোগও রয়েছে। এর মধ্যে কেবল লুটের ঘটনাতেই ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ৩২২ কোটি ২১ লাখ ৯৩ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম নিয়ে কোনো হানাহানিতে বিশ্বাসী নয়। যুগ যুগ ধরে এদেশে সব ধর্মের মানুষ কোনো ধরনের বিভেদ ছাড়াই নিজ নিজ ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে আসছে এবং পারস্পারিক ভ্রাতৃত্বের মধ্য দিয়ে বসবাস করে আসছে। তাহলে আজ কেন তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এই দেশের স্বাধীনতায় তাদেরও যথেষ্ট অবদান ছিলো। তাদেরকেও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তাহলে আজ কেন তারা অবাঞ্চিত বোধ করবে? অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব তাদের সব ধরনের অধিকার নিশ্চিত করা এবং এদেশের নাগরিক হিসেবে তাদের প্রতি হওয়া যেকোন অন্যায়কে কঠোর হস্তে দমন করা। সরকার কি পারছে এভাবে সংখ্যালঘুদের জাতিসত্তা রক্ষা করতে?
এদেশের জনগণ ভয়ংকর দুঃসময়ের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। ভয়াল পরিবেশের কারণে এদেশে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে পারেনি এবং তাদের নিরাপত্তাও দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আওয়ামী সরকার বিরোধী মত ও দলের নেতাকর্মীদের দমন ও নির্যাতনে ব্যস্ত থাকার কারণে সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তার বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। আর এজন্য একের পর এক নিরীহ মানুষের ওপর হামলা, নির্যাতন ও জুলুম অব্যাহত রয়েছে।
ঐক্যবদ্ধ জনগণের প্রবল সাহসের কাছে কখনোই কোনো অশুভ শক্তির উত্থান সম্ভব নয়। এদেশের সব সম্প্রদায়কে যে কোনো উসকানির মুখে বিভ্রান্ত না হয়ে সাম্প্রদায়িক ঐক্য বিনষ্টকারী দুস্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে এখনই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যারা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মম হামলা চালাচ্ছে তারা মানবজাতির শত্রু।