বাংলাদেশের সার্বজনীন শারদীয়া দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লায় একটি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। যার জের ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে। যার সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে রংপুরের পীরগঞ্জে। এখানে গুজব ছড়িয়ে হিন্দু এলাকায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে যে সাম্প্রদায়িক উসকানির ঘটনাগুলো ঘটছে সেখানে পাকিস্থানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র হাত থাকা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়না। অতীতেও এই ধরনের ঘটনা যেহেতু ঘটেছে।
অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ছক কেটে এই ঘটনাগুলোকে সাজানো হয়েছে। ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এই ধরনের গুজব ছড়ানোর ঘটনা এবং তাই নিয়ে পরবর্তীতে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অত্যাচার তাদের মন্দিরে ভাংচুর এগুলো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং পরিকল্পিতভাবেই সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য এই ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব ঘটনার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত এবং হেফাজত জড়িত তার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার মানে কি দেশ কে মৌলবাদী, কট্টরপন্থী, উগ্রবাদী বানিয়ে ফেলার পায়তারা চলছে?
বিশেষ করে কুমিল্লা ও ফেনীর ঘটনায় সরাসরি বিএনপি-জামায়াত এবং হেফাজতের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে রয়েছে। তবে শুধু যে দেশীয় অপশক্তিগুলো কাজটি করেছে এমনটি নয় বলেই মনে করছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাই যদি হয় তাহলে কি দেশটা দেশি-বিদেশি উচ্ছন্নবাদীদের দখলে চলে যাচ্ছে? অসাম্প্রদায়িক দেশ, সব ধর্মের লোকদের পারস্পরিক সম্পর্ক, শ্রদ্ধাবোধের তাহলে কি কোনই মূল্য নেই? এই দেশ কি তাহলে শুধু দাড়ি-টুপিওয়ালাদের? অন্য ধর্মের লোক কি এদেশে অবাঞ্চিত? যদি তা না হয় তাহলে এভাবে বারবার তাদের উপরে হওয়া জোর জুলুমের বিচার কোথায়?
উল্লেখ্য, গত কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশে পাকিস্থানি গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’ সক্রিয় বলে দেশের শীর্ষ সকল গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করে তার মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করা হচ্ছে। যার মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীকে উসকানি দেওয়া। এখন বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন বলে জানা গেছে। কিন্ত শুধু তথ্য জানলেই তো হবে না এই ধরনের ঘটনার তদন্ত করে তার বিচার এবং পুনরায় যাতে না ঘটে সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থাও নিতে হবে।
এসব ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ বিরোধী কোনো চক্র অথবা বাইরের কোনো দেশের সম্পৃক্ততা, অর্থায়ন কিংবা প্রত্যক্ষ মদদ ও সহায়তা আছে কি না তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
এর আগে বাংলাদেশের যতবারই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা করা হয়েছিল ততবারই এর পেছনে পাকিস্থানের ভূমিকা দৃশ্যমান ছিল। আরেকটু পেছনে ফিরলে দেখা যায়, ৮০’র দশকে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে যাওয়া বাংলাদেশের কয়েকটি উগ্র ধর্মীয় সংগঠনের হাজার হাজার সদস্যকে সামরিক ও নাশকতার প্রশিক্ষণ দিয়েছিল পাকিস্থানি সামরিক বাহিনী নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে।
সে সময় হেফাজত নেতা মামুনুল হকের পিতা যুদ্ধাপরাধী আজিজুল হক এবং তার খেলাফতে মজলিসের জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। এছাড়াও আইএসআই’র প্রশিক্ষকরা বাংলাদেশে এসেও গোপনে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। এছাড়াও চট্টগ্রামের জঙ্গি নেতা ইজহারুল ইসলামও একই সময়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ পান আফগানিস্তানে।
এক পর্যায়ে ইজহারুল ইসলাম উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় বোমা বিশেষজ্ঞ হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেন। তার হাত ধরে উপমহাদেশে আইইডি (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বা হাতে তৈরি বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ পায় উপমহাদেশের হাজার হাজার জঙ্গি। ইজহারুলের বড় ছেলে হারুন ইজহারও একইভাবে প্রশিক্ষিত হন। ২০১৩ সালে চট্টগ্রামের লালখান বাজারস্থ তার মাদ্রাসায় এমন বোমা তৈরির সময় বিকট বিস্ফোরণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এছাড়া ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনায় পাকিস্থানের গোয়েন্দা সংস্থা এবং কয়েকজন পাকিস্থানি প্রশিক্ষিত জঙ্গির সম্পৃক্ততার খবর পুরনো। ২১ আগস্টে ব্যবহৃত গ্রেনেড ও সামরিক সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণ প্রস্তুতিতেও আইএসআই সম্পৃক্ত ছিল সরাসরি। যা জঙ্গি মুফতি হান্নানের জবানবন্দিতে জানা যায়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নাশকতার ঘটনায় পাকিস্থানের সম্পৃক্ততার এখানেই শেষ নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মামুনুল হক গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, মামুনুল হক নিয়মিত পাকিস্থানে যাওয়া-আসা করতেন। সেখান থেকে তিনি একটি জঙ্গি সংগঠনের হয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য নির্দেশনা পেয়েছেন। মামুনুল হকের বোনের স্বামী পাকিস্থানের ওই জঙ্গি সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি সেই সুবাদে পাকিস্থানের নাগরিকত্বও পেয়েছেন। সরকারের নাকের ডগা দিয়ে এতসব ঘটনা কিভাবে ঘটছে তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
এসব বিষয় নজরে রেখে এখন নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে যেভাবে গুজব ছড়িয়ে সন্ত্রাস এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা করছে সেটির পেছনে জড়িত কারা? ধর্ম অবমাননার প্রশ্ন তুলে সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো, হত্যা করা ইত্যাদি পাকিস্থানে নিয়মিতই ঘটে। পাকিস্থানে অমুসলিমদের ঘরের পেছনের নর্দমায় কোরআন ফেলে অবমাননার অভিযোগে পুড়িয়ে হত্যাকাণ্ডের খবরও অনেকের মনে আছে। তাহলে কি বাংলাদেশও আরেক উগ্রবাদী পাকিস্তান হওয়ার পথে হাটছে?
তাই বলা যায়, শুধুমাত্র বাংলাদেশের উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী যে কাজটি করছে না এটি মোটামুটি নিশ্চিত। তবে এখানে পাকিস্থানের ভূমিকা কী এবং আইএসআই এখানে আদৌ জড়িত কি না সে ব্যাপারে আরো তদন্ত প্রয়োজন।